জলাবদ্ধতার নিরসন হবে কবে?

0

মাত্র তিন ঘন্টার বৃষ্টিতে রাজধানীর জলাবদ্ধতার সেই পুরনো চিত্র ফিরে আসে। অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, উত্তরাসহ মতিঝিল, কাকরাইল, ফকিরাপুল, শান্তিনগরসহ অনেক সড়ক কোমর সমান পানিতে ডুবে যায়। এতে অফিসগামী মানুষসহ নগরবাসী অশেষ দুর্ভোগের শিকার হন। পানির মধ্য দিয়ে যানবাহন চলাচল করতে গিয়ে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। ঢাকার রাস্তায় এমন জলাবদ্ধতা ও জনদুর্ভোগের চিত্র নতুন নয়। বছরের পর বছর ধরেই এ চিত্রের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। বৃষ্টির চেয়ে অনেক কম বৃষ্টিতেও ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকার গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো ঘন্টার পর ঘন্টা পানিতে তলিয়ে থাকে। সিটি করপোরেশনের মেয়ররা বরাবরই রাজধানীর জলাবদ্ধতা, যানজট নিরসনের মত গতানুগতিক সমস্যা ও ফুটপাথ, নদী, খাল-জলাভূমি বেদখল মুক্ত করার প্রতিশ্রæতি দিয়ে থাকেন। তবে তাদের এ প্রতিশ্রæতি কখনোই পূরণ হয় না। যানজট, পানিবদ্ধতা, নদী ও খাল দখল বহাল তবিয়তেই থেকে যায়। গতকালের বৃষ্টিতে অচল ঢাকা আমাদেরকে আবারো নগরকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতার কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
একেকটি সমস্যার পেছনে আরো বেশ কিছু সমস্যার নেপথ্য ভূমিকা দেখা যায়। ঢাকার রাস্তায় পানিবদ্ধতার পেছনে রয়েছে অপরিকল্পিত ও অপর্যাপ্ত স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা, শহরের খাল দখল ও বেআইনী প্রক্রিয়ায় জলাভূমি ভরাটের মত ঘটনা। এসব সমস্যা নিরসনে দশকের পর দশক ধরে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও কোনো প্রকল্পই সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। এখনো ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করা যায়নিন। এসব খাতে ইতিমধ্যে বিভিন্ন সময়ে শত শত কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে খরচ করা হয়েছে। একদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থের সংকটের কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে একেকটি প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে প্রকল্প ব্যয় কয়েকগুণ দ্বিগুণ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। শহরের অভিজাত এলাকা ও ডিপ্লোম্যাটিক জোন হিসেবে পরিচিত গুলশান বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্পটি তিন দশকেও বাস্তবায়ন করা যায়নি। নব্বইয়ের দশকে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বর্তমান সরকার ৪১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে ২০১৩ সালের মধ্যে শেষ করার শিডিউল দিয়ে কাজ শুরু করলেও গত আট বছরে প্রকল্পের ব্যয় ১২ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হলেও কবে তা শেষ হবে তা কেউ জানে না। শহরের খাল ও লেকগুলোকে নদীর সাথে ইন্টারলিঙ্ক সিস্টেমে যুক্তকরা গেলে পানিবদ্ধতা অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। শুধু রাজধানী ঢাকায়ই নয়, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহরগুলো পানিবদ্ধতা ও যানজটের মত অভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত, যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। সেই সাথে বিশ্বের বাসযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান প্রতিবছরই তলানিতে অবস্থান করছে। পশ্চিমা কিছু দেশ তাদের কিছু অফিস ঢাকা থেকে সরিয়ে নিচ্ছে অথবা ঢাকায় থাকতে অনাগ্রহী হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। যে শহরে এক ঘন্টার বৃষ্টিতে রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে, যান চলাচলের গড় গতিবেগ পায়ে হাঁটার গতির চেয়েও কম সে শহরে কেউ বিনিয়োগ ও ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য আসতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। বিশ্ববাস্তবতার নিরিখে অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশে এফডিআই বা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে খরা চলছে। ঢাকার পানিবদ্ধতা, যানজট নিরসনের মত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সাথে যেমন দুই কোটি নগরবাসির দুর্ভোগ লাঘবের স্বপ্ন জড়িত, একই সঙ্গে এসব বিনিয়োগ ও প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে দেশের বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জাতির মর্যাদার প্রশ্নও জড়িত। চটকদার রাজনৈতিক বিজ্ঞাপণ দিয়ে নতুন নতুন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে রাজধানী শহরকে বাসযোগ্য রাখতে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ত্বরিৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। শহরের পানিবদ্ধতা নিরসনে ওয়াসা ও পানিউন্নয়ন বোর্ডের ব্যর্থতা পরিষ্কার। এখন সিটি কর্পোরেশনকে ব্যর্থতার দায়মুক্তির কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চায় নগরবাসি। বর্ষা এখনো শুরু হয়নি, কার্যকর উদ্যোগ নিলে বর্ষার আগেই পানিবদ্ধতার সমাধান কিছুটা হলেও সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের অজুহাত কাম্য হতে পারে না। আমরা দেখেছি, ওয়াসা থেকে রাজধানীর খাল সিটি করপোরেশনের হাতে হস্তান্তরের পর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বর্ষায় পানিবদ্ধতা থাকবে না বলে প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল। কিছু খাল উদ্ধার ও পরিস্কারও করা হয়। অথচ গতকালের কয়েক ঘন্টার বৃষ্টিতে রাজধানীর সড়কগুলো ডুবে যায়। আমরা মনে করি, বর্ষা শুরুর আগেই রাজধানীর পানিবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোর উদ্যোগ নেয়া উচিৎ। বর্ষায় যাতে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি না হয়, এ জন্য যা করা প্রয়োজন তাই করতে হবে। নগরবাসীর চলাচল সহজ করতে হবে।