বিশ্বব্যবস্থার মূল্যায়ন কি অপরিহার্য নয়

0

সালাহউদ্দিন বাবর
বিশ্ব আজ এক মহা সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। গত দু’বছরে কোভিড আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন আর আন্তর্জাতিক বলয়ে বহু কিছু ভেঙেচুরে দিয়েছে, ছিনিয়ে নিয়েছে অনেক কিছু। কোটি মানুষের স্বপ্নসাধ ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ দিন দুঃখী হয়ে পড়েছে, হতদরিদ্র হয়েছে বেশুমার আদম সন্তান। পৃথিবীর মানুষ তার অসংখ্য স্বজন সুহৃদকে চিরতরে হারিয়েছে। কিছুকাল আগে সংবাদপত্রে প্রকাশ কোভিড ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীতে ৬৯ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এই হিসাব হচ্ছে বিভিন্ন দেশের সরকারি হিসাব। বাস্তবে তার দ্বিগুণের বেশি মানুষ মারা গেছে বলে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের এক গবেষণা সংস্থার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে। সেই বিশ্লেষণে দেখা যায়, মহামারীর কারণে সৃষ্ট চিকিৎসাসঙ্কটে বিপুলসংখ্যক মানুষ মারা গেছে। সেই চিকিৎসাসঙ্কটে মৃতদের শুমারি করোনায় মৃত্যুর তালিকায় নেই। মৃত্যুর পাশাপাশি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে যারা সেরে উঠেছেন তাদেরও নানা দৈহিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। অর্থকষ্টে তাদের চিকিৎসা চালানো সম্ভব হচ্ছে না। কোভিডের কারণে স্বজন হারিয়েছে অগণিত মানুষ আজ শোকাবহ দিন যাপন করছে। শঙ্কা ভয়ভীতি অনটন আর মানসিক ভারসাম্যহীনতা নিয়ে অস্বাভাবিক এক জীবন যাপন করছে মানুষ। কেউই বলতে পারছে না কবে এই বালা দূর হতে পারে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিজ্ঞ অভিজ্ঞ স্বাস্থ্যবিষয়ক বিজ্ঞানী কারো কাছে এর জবাব নেই। সমাজ রাষ্ট্রের এ নেতাদের কেউই শোনাতে পারছে না মানুষকে কোনো অভয়বাণী। হতবিহ্বল সবাই। নিজেদের অসহায়ত্ব নিয়ে ইতঃপূর্বে কেউই এতটা কাতর ছিল কি না সন্দেহ।
বিশ্বের বহু জনপদের অবস্থা অনেকটা আমাদেরই মতোই। আর এটাও প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বিখ্যাত সেই বাণী ‘মানুষ মানুষের জন্য’, সেটি এখন যেন মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। সমাজে বহু ক্ষেত্রেই আগেও দেখা গেছে, কারো প্রাচুর্য আছে আর বেশির ভাগেরই নেই। কিন্তু সেখানে ভাগাভাগি করে নেয়ার মানসিকতা ছিল যৎকিঞ্চিৎ। আজ কোভিডের ভয়াবহ বিস্তার ও তার ধ্বংসলীলায় বিশ্বের বহু দেশ বিপর্যস্ত। কিন্তু এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে যারা প্রায় সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে তারা কিন্তু গভীর খাদে পড়তে যাওয়া দেশগুলোর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়া তো দূরের কথা, বন্ধ করে দিচ্ছে তার সব দুয়ার। তবে এ নিয়ে বাণিজ্যের জন্য তারা প্রস্তুত। পত্রপত্রিকায় এমন বহু খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, বিশ্বের শত শত কোটি মানুষ সর্বহারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে, ক্ষুধা আর রোগ শোকে জীবন তাদের ওষ্ঠাগত। সেখানে কিছু লোক কোভিডের এই দুর্যোগ নিয়ে বাণিজ্য করে তাদের সহায় সম্পদ বাড়িয়ে পাহাড়ের শীর্ষে পৌঁছে গেছে। আসলে কোভিড শুধু এটাই প্রমাণ করেনি যে লাখো মানুষ নিজ স্বার্থে কতটা অন্ধ হতে পারে। তার চেয়ে বড় কথা হলো, গোটাবিশ্ব ব্যবস্থায় কত যে গলদ রয়েছে, তার মূল্যায়ন এই প্রেক্ষাপটে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সাত শতাধিক কোটি মানুষ নিয়ে দুনিয়াটা আজ এক বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বনেতারা সঠিক পথে চলতে পারছে না বলে সঙ্কট আরো ঘনীভূত হয়ে পড়েছে। যিনি এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, আর সেই বিশ্ব কোন পথে কিভাবে চলবে তারও একটা নির্দেশিকতা দিয়ে দিয়েছেন, সেই মহান স্রষ্টার নির্দেশনা অনুসরণ না করার কারণেই বিপদ মানুষের পিছু ছাড়ছে না। মানুষ প্রতিনিয়ত ভুল করে। সেটি তার সীমাবদ্ধতার জন্য। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বাইরে গিয়ে কিছু ভাবা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু এর বাইরে বহু কিছু রয়েছে। যা কোনোকালেই তার পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না। বিশ্ব স্রষ্টা বলেছেন, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখো, কোথাও কোনো ত্রুটি আছে কি না। তোমাদের চোখ ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসবে কিন্তু কোনো খুঁত কোথাও খুঁজে পাবে না। তার পরও বিশ্বের বহু মানুষ চরম অহমিকায় ভোগে তার যৎসামান্য জ্ঞান গরিমা নিয়ে, তারা নিজেদের মনে করে সবজান্তা। তবে আজ কোভিড নিয়ে সৃষ্ট সঙ্কট বড় একটা ধাক্কা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেল অসীমকে বোঝা সসীমের পক্ষে বড়ই দুরূহ। তাই যত অহমিকা করা হবে তত নির্বুদ্ধিতার জালে এমন পেঁচিয়ে যেতে হবে যেখান থেকে কোনো ক্রমেই মুক্ত হওয়া, ছুটে আসা যাবে না। যেমন কোভিড বিভিন্ন দেশে ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ আর ধ্বংসের শক্তি বাড়াচ্ছে। যে কারণে মানুষের পক্ষে তাকে প্রতিহত করা দুরূহ হয়ে উঠেছে। মানব বিশ্বের সম্মুখে এর যে রহস্য তা ভেদ করা সম্ভব নয়।
সে যাই হোক, পৃথিবীতে বহু ছুতানাতা নিয়ে অনেক তত্ত্ব কথা আর নানা দর্শন দিতে কসুর করেন না বিশ্ব বিবেক বলে কথিত কিছু বুদ্ধিজীবী। বিশ্বের শতকোটি মানুষ কোভিডের টিকা পাওয়া নিয়ে যে অনিশ্চয়তা আর দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে তাদের সম-অধিকার নিয়ে টুঁ শব্দটি করছে না এসব ব্যক্তি। অথচ তারা মানবাধিকার নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হতে অনেক লম্ফঝম্ফ দিয়ে থাকেন। আজকে বিশ্বের দুস্থদের টিকা পাওয়া নিয়ে তারা নীরব নিথর। অন্যদের কথা বলে কী লাভ। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের আচার-আচরণ তো সেই একই রকম। যা কখনো কোনো ইস্যু হতে পারে না সেটিকেই তারা ইস্যু করেন। ধর্মপ্রাণ সৎ নীতিনিষ্ঠ মানুষের প্রতি তাদের যত ক্ষোভ আর উষ্মা অথচ দেশে কত অনাচার অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছে একটি শক্তিশালী মহল। সেই দুষ্কর্ম তাদের চোখেও পড়ে না গায়েও বাঁধে না। দেশের সামর্থ্যহীন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষ যাতে কোভিডের টিকা পেতে পারে সে সম্পর্কে সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের মতো এসব ক্ষমতাসীন মহলের খয়ের খাঁ বুদ্ধিজীবীরা কিছু বলছেন না। আজকে দেশের সব মানুষের টিকাপ্রাপ্তি নিয়ে যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে প্রশাসনের দূরদর্শিতার অভাবে, তা নিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের উদ্বেগ উৎকণ্ঠার শেষ নেই। প্রশাসন বেজার হতে পারে এই ভেবে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন তারা। কেবল রাষ্ট্রীয় খেতাব আর নানা সুযোগ সুবিধা পেতেই তারা যত পেরেশান। সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্ট নিয়ে তাদের কখনো মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি, শোনা যায়নি এর জন্য প্রশাসনের কোনো সমালোচনা তাদের মুখে। চূড়ান্ত সুবিধাবাদী এসব ব্যক্তি বহু ক্ষেত্রেই নিজ দেশের স্বার্থের কথা না ভেবে ভিন্ন একটি দেশের প্রতি ভাব-বিগলিত। বিশ্বসমাজের এসব বুদ্ধিজীবী কখনো বলেননি বা বলছেন না যে বিশ্বের মোড়লরা ভুল পথে নিয়ে চলেছেন বিশ্বজগৎকে। তাদের আত্মোপলব্ধি ঘটানোর জন্য সতর্ক করতে স্রষ্টা পৃথিবীকে যেভাবে সাজিয়েছেন, সেই গোছানো ব্যবস্থা তছনছ করে দিচ্ছেন প্রতিক্ষণে। মানুষকে হুঁশিয়ার হওয়ার জন্য ভয়াবহ ভূমিকম্প সুনামি আর বিশ্বের অনেক অঞ্চল সমুদ্রে বিলীন হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে, হাজারো রোগব্যাধি নানারূপে এসে বারবার মানব অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু তারপরও কোনো হুঁশ বোধ নেই কারো। বিশ্বে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এমন সব মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে, কেবল আত্মহত্যার আয়োজন করার সাথেই যার তুলনা করা যেতে পারে। এমন অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্য কল্পনার অতীত অর্থ ব্যয় করছে। তা যদি বিশ্বের হতদরিদ্র মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান আর শিক্ষার জন্য ব্যয় করার মতো সহানুভূতি দেখাত তবে এই ধরিত্রী থেকে বেদনা আর দুঃখ কষ্ট বহুলাংশে হ্রাস পেত। অথচ এমন সৎ চিন্তাচেতনা স্বার্থান্ধ দেশগুলোর ধারেকাছে ঘেঁষতে পারে না। এভাবে বিশ্ব থেকে মানবিকতার প্রস্থান ঘটছে। “পৃথিবীতে বহু ছুতানাতা নিয়ে অনেক তত্ত্ব কথা আর নানা দর্শন দিতে কসুর করেন না বিশ্ববিবেক বলে কথিত কিছু বুদ্ধিজীবী। বিশ্বের শতকোটি মানুষ কোভিডের টিকা পাওয়া নিয়ে যে অনিশ্চয়তা আর দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে তাদের সম অধিকার নিয়ে টুঁ শব্দটি করছে না এসব ব্যক্তি। অথচ তারা মানবাধিকার নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হতে অনেক লম্ফঝম্ফ দিয়ে থাকেন”
সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই যদি এমনটা বিরাজ করত তবে হয়তো বিশ্বের রূপ ভিন্ন হতো। তা হয়নি। কারণ সে সময় মানুষ এতটা হীন চিন্তার দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল না। বিশ্বসভ্যতায় অবদান রাখা বিজ্ঞানী ও সৎ নীতিনিষ্ঠ মানুষের মনের উদারতা ছিল। তাদের সব উদ্ভাবন ছিল পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আর আজ তা পরিবর্তিত হয়ে ব্যক্তি স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এভাবে আজকের বিশ্ব ব্যবস্থার যাবতীয় বিপর্যয়ের সূচনা করা হয়েছে। মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতার প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসতে চাই। মানুষ নাকি নিজেকে বড় বেশি ভালোবাসে। সব ক্ষেত্রেই নিজস্ব প্রাপ্তিকে প্রাধান্য দেয়া আর পৃথিবীতে দীর্ঘ দিন বেঁচে থেকে এর রূপরসগন্ধ ষোলো আনা উপভোগ করাই তার লক্ষ্য। কিন্তু বিশ্বের মোড়লরা তো মুহূর্তেই পৃথিবীকে ধ্বংসের আয়োজন নিয়ে এখন মেতে আছে। অথচ বিশ্বের সব ধর্ম ও জীবন ব্যবস্থাই এই বোধকে জাগ্রত করতে চায় যে, পৃথিবীর যে অফুরান সম্পদ, যা কিছু সুখ আনন্দ তার সব কিছুই সবাই সমভাবে নিরাপদে ভোগ করুক স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। মারণাস্ত্র তৈরি ছাড়াও যে কথা আগে বলা হয়েছে স্রষ্টা বিশ্বকে যেভাবে সাজিয়েছেন তা এখন তছনছ করা হচ্ছে। এর ফলে বিশ্বের পরিবেশ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর শিল্প কারখানা থেকে বিপুল পরিমাণে কার্বন আবহাওয়ামণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মক উষ্ণতার সৃষ্টি হচ্ছে সর্বত্র। কিছুকাল আগেও শীত বর্ষা গ্রীষ্মের যে শৃঙ্খলা ছিল তা আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়ার এমন ওলট-পালট হওয়ার ফলে সর্বত্রই শস্যের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। অথচ অপর দিকে পৃথিবীর জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বিশ্বের বহু দেশ তাদের খাদ্যঘাটতি নিয়ে মারাত্মক বিপাকে পড়েছে। এসব দেশের শিশুদের বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য পাওয়া তো দূরের কথা ন্যূনতমটুকুও ওরা পাচ্ছে না। বিপুলসংখ্যক শিশু পুষ্টিহীনতার কারণে হীনবল হয়ে বেড়ে উঠছে। এমন বহু দেশ রয়েছে যেখানে খাদ্য না পাওয়ায় শিশুকাল অতিক্রম করার আগেই অনেক শিশুর জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে। এ কী করুণ দৃশ্য। পৃথিবীতে সম্পদের সমবণ্টনের যে মানবিকতা তা এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে! কোথাও অর্থসম্পদ আর খাদ্যসামগ্রী উপচে পড়ছে। যেখানে উচ্ছিষ্ট করে নষ্ট করা হচ্ছে টনকে টন সুখাদ্য। অথচ সমস্যায় ডুবে থাকা দেশগুলোর জনগণ এমন সুখাদ্য কখনো স্বপ্নেও দেখে না। খাদ্যের অভাবে যেসব শিশুর মৃত্যু হচ্ছে তাদের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে স্রষ্টার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। যে শিশু খাদ্য না পেয়ে মৃত্যুবরণ করল, সে তো পরিণত বয়স পর্যন্ত এই সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচার অধিকার নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছিল। তাকে তো বাঁচতে দিলো না মানুষই। এতটুকু মমতা ভালোবাসা আর সহানুভূতি বিশ্ব তার প্রতি দেখায়নি। তার অধিকার কেড়ে নিয়ে মানবাধিকারের ফাঁকা বুলি আওড়াচ্ছে সেই শিশু হন্তারকরাই। অবাক লাগে তাদের চরিত্রের এই বৈপরীত্যের কথা ভেবে। এসব মর্মান্তিক ঘটনার এখানেই শেষ নয়, ভবিষ্যতে এমন বহু নজির সৃষ্টি হবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তন না ঘটালে। সে জন্যই বলেছি যে, বিশ্বব্যবস্থায় হাজারও ত্রুটি রয়েছে। যেহেতু চলমান এই ব্যবস্থা বিশ্বের মোড়ল দেশগুলোর স্বপ্নসাধ পূরণ করছে। তাই এসব নিয়ে ভাবার কোনো প্রায়োজন তারা বোধ করে না। নিজেদের ষোলো আনা স্বার্থের কোনো ব্যাঘাত তো ঘটছে না। তাই কোথায় কী ঘটল, কোথায় মানুষ খেতে পাচ্ছে কি পাচ্ছে না, তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথার কোনো কারণ নেই। নিজেদের ক্ষমতার মসনদ ঠিক রাখতে স্বদেশে স্বজনদের এতটুকু কষ্ট আর সঙ্কট কত দ্রুত সুরাহা করবে সে নিয়ে তাদের পেরেশানির কোনো কমতি নেই। অথচ সাধারণ নিয়ম এটাই যে, যারা সহায় সম্পদে, বিত্তবৈভবে শীর্ষে থাকে তাদেরকে পাশের লোকদের দিকেও ফিরে তাকাতে হয়। আজকের বিশ্বব্যবস্থায় সেই দীক্ষা নেই। নিজেদের জন্যই কেবল তারা সম্পদের পাহাড় গড়েছে। সেটিও কিন্তু অন্য জায়গা থেকেই লুটেপুটে নেয়া। সে কারণে বলছি যে, এই বিশ্বব্যবস্থা নিজ স্বার্থে গড়ে তুলেছে বৃহৎ দেশগুলো। আর তা পাল্টানো না হলে বিভিন্ন দেশ ও তার অধিবাসীদের রক্ষা করা যাবে না। স্রষ্টা বিশ্বের জন্য যে শৃঙ্খলার বিধান দিয়েছেন তার ব্যত্যয় যেভাবে ঘটছে তাতে তাঁর উষ্মার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। আর তাতে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে। কোভিড আর কতটুকু শক্তিধর তার চেয়েও হাজার গুণ বড় বিপদ এসে পৌঁছবে। সুদূর অতীতেও এমন সব ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছে, যা থেকে শিক্ষার নেয়ার সময়সীমা অতিক্রম হওয়ার পথে রয়েছে পৃথিবী।
তবে এ কথাও সত্য, যাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে এই অপ্রতুলতাকে জয় করার জন্য বুদ্ধি পরিকল্পনা আর অপরিসীম পরিশ্রম করে ভাগ্য বদলের চেষ্টা সবার আগে করতে হবে। তা না করলে এমনি এমনি সব কিছুর সুরাহা হয়ে যাবে না। যে চাষি শস্য বোনার মৌসুমে আলস্য করে তাকে সারা বছর ভুগতে হয়। পৃথিবী জ্ঞানবিজ্ঞান প্রযুক্তিতে অনেক দূর এগিয়েছে। এটা শুধু জেনে রাখলে চলবে না। বাস্তবে তা কাজে লাগাতে হবে। প্রথমে শুরু করতে হবে, বুঝতে হবে অধ্যবসায়ই সাফল্য নিয়ে আসতে পারে। স্থবির হয়ে বসে থাকলে শত বছরেও কিছু হবে না। যারা শুধু হাপিত্যেশ করে তাদের অগ্রগতি সম্ভব নয়। যে জাতি তার ভাগ্য বদলের চেষ্টা করে না স্রষ্টাও তাদের করুণা করেন না। যেসব দেশের প্রতি আগে ইঙ্গিত করা হয়েছে তাদের সম্পদের অপ্রতুলতা আছে বটে, কিন্তু তা সুরাহা করার ন্যূনতম চেষ্টা তদবির নেই। রাষ্ট্রব্যবস্থায় চরম অনিয়ম আর অযোগ্যতা সেই সাথে ক্ষমতাসীনদের অদূরদর্শিতা শত ভাগ। এত সবের পরও কিন্তু ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার কু-রাজনীতি চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিশ্ব ব্যবস্থার এই সঙ্কট কাটাতে কিভাবে কারা প্রচেষ্টা নেবে? যারা বিশ্ব মঞ্চে প্রধান নট তারা তো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। প্রতিযোগীদের কোন পথে সামলানো যাবে সেটি নিয়েই তাদের যত ভাবনা। পরস্পর হুমকি ধমকি এসবই চলছে প্রতিনিয়ত। কেউ যদি কারো পাশে দাঁড়ায় তবে বুঝতে হবে যে সেটিও কূটচাল। নিজস্ব শক্তির বলয় মজবুত করার জন্য তাদের উচ্ছিষ্টটুকু ফেলে না দিয়ে তাদের দেয়া হয়। নিঃস্বার্থ কোনো সাহায্য সহায়তা কেউ করবে তা ভাবাই যায় না। পৃথিবীবাসীর কল্যাণের নিমিত্তে নামকাওয়াস্তে রয়েছে এক বিশ্বসভা তথা জাতিসঙ্ঘ। তাকে আসলে বিশ্বসভা বলা যাবে কিভাবে। কেননা তা মূলত শক্তিধর কয়েকটি রাষ্ট্রের কুক্ষিগত হয়ে আছে। সাধারণ সদস্য দেশের জন্য কোনো মঙ্গল চিন্তা বা কোনো শুভ উদ্যোগ প্রচেষ্টা তাদের কোনো এজেন্ডা নয়। কোনো বিপদ আপদ থেকে বিশ্বকে রক্ষা করার জন্য এমন কোনো ভূমিকা এই সংস্থাকে করতে দেখা যায়নি। এখন কোভিডের কারণে বিশ্বের বিশেষ নিম্ন আয়ের দেশগুলো ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি। তাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য নেই যে টিকা ক্রয় করে মানুষের নিরাপত্তা বিধান করবে। বিশ্ব এ ক্ষেত্রে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছে? বিশ্বসভার মুখ্য সদস্যদের প্রায় সবাই টিকা উদ্ভাবন এবং নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের টিকাপ্রাপ্তি শুধু নিশ্চিতই করেনি তাদের বহু টিকা উদ্বৃত্ত রয়েছে। কিন্তু এই টিকা নিয়ে তারা বাণিজ্য করে বিপুল অর্থের অধিকারী হতে চলেছে। অথচ বিশ্বসভার মুখ্য সেসব সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গি তো হওয়া উচিত ছিল মানবিক আর সহানুভূতিপূর্ণ। বিশ্বসভার আরো দায়িত্ব ছিল শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইরত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু নিকট অতীত এবং বর্তমান সময় যেসব দেশে বিশেষ করে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি ইসরাইল যে যুদ্ধাপরাধ করছে সেটি নিয়ে জাতিসঙ্ঘ ও তার মুখ্য সদস্যদের ন্যূনতম সহানুভূতি নেই। বরং যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে উসকে দিচ্ছে তাদের জঘন্য অপরাধ জারি রাখার জন্য। তা ছাড়া অন্যান্য পরাশক্তি ও পাশ্চাত্যের উন্নত শক্তিশালী দেশগুলো চরম অমানবিকতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। এসবই ইসরাইলকে তার হত্যাযজ্ঞ চালাতে সাহস জোগাচ্ছে। ইসরাইলের বর্বর হামলায় অসংখ্য নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়েছে বেশুমার। বহু কোটি টাকার সহায় সম্পদ ধূলিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। আরো বেদনার বিষয় মুসিলম বিশ্বের প্রতিষ্ঠান ওআইসির ভূমিকাও জাতিসঙ্ঘেরই মতো। সম্প্রতি ফিলিস্তিনের হত্যাযজ্ঞ নিয়ে তাদের ভূমিকা নেই। আরো ন্যক্কারজনক ব্যাপার হচ্ছে, আরব বিশ্বের কয়েকটি দেশ ইসরাইলের সাথে কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপন, তাদের সাথে দহরম মহরম করছে।