কী অবস্থা সীমান্তে !

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ভারতে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস যেন এ দেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করেছে বাংলাদেশ। যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে এমন বাংলাদেশিরাই শুধু ভারতের বাংলাদেশ হাইকমিশনের অনাপত্তি ছাড়পত্র নিয়ে বিশেষ বিবেচনায় দেশে ঢুকতে পারবেন। কিন্তু গত দুই সপ্তাহে যেসব বাংলাদেশি বেনাপোল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন তাদের ৮০ শতাংশেরই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, গত মাসের শেষদিকে পররাষ্ট্র সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়। সেই বৈঠকেই বলা হয়েছে, শুধু ভিসার মেয়াদ যাদের শেষ হওয়ার পথে শুধু তারাই ফিরতে পারবেন। বাকিদের সীমান্ত খোলার অপেক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ তাদের আপাতত ওই দেশেই থাকতে হবে। এ সিদ্ধান্ত প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই যারা চিকিৎসার জন্য বা অন্যান্য কাজে দেশটিতে গিয়েছেন তারা প্রায় সবাই দেশে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে ভার্চুয়াল আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে দিল্লি হাইকমিশনে ও কলকাতার উপদূতাবাসে কর্মরত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আটকাপড়া বাংলাদেশিরা হাইকমিশনে গিয়ে বেপরোয়া আচরণ করছে। বাংলাদেশ থেকে অনেকে হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের ফোন করে ভিসার মেয়াদ আছে এমন বাংলাদেশিদেরও অনাপত্তিপত্র দেওয়ার তদবির করছেন। এমনকি অনেকে ভারতীয় প্রভাবশালীদের দিয়েও ফোন করে তদবির করছেন। তারা হাইকমিশনের রাস্তায় দাঁড়িয়েও চিৎকার-চেঁচামেচি করে দেশে ফেরার অনাপত্তিপত্র চান। এ অবস্থায় কর্মকর্তারা বাধ্য হন তাদের অনাপত্তিপত্র ইস্যু করার জন্য। দূতাবাসের কর্মকর্তারা কার ভিসার মেয়াদ আছে আর কার ভিসার মেয়াদ নেই সেটা দেখছেন না। যদিও একপর্যায়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গুরুতর অসুস্থদের ফেরার অনুমতি দেওয়ার নির্দেশনা দেয়। তারপরও ভিসার মেয়াদ আছে এমন বাংলাদেশিরাই ফিরে আসছেন।
বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে স্বাভাবিক সময়ে ৩৫০ থেকে ৪০০ জন বাংলাদেশে প্রবেশ করে। কিন্তু গত ২৬ এপ্রিল সীমান্ত বন্ধের পর থেকে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ মানুষ প্রবেশ করছে। সীমান্ত বন্ধের নিয়মনীতি কঠোরভাবে অনুসরণ না করলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে বলে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা মনে করেন। এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে যশোরের জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান বলেন, ‘সীমান্ত বন্ধ থাকার পরও যারা ফিরে আসছেন তাদের আমরা কোয়ারেন্টাইনে পাঠাচ্ছি। যশোরের বাইরেও বিভিন্ন জেলায় আমরা তাদের পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।’
যশোর জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত ২৬ এপ্রিল সীমান্ত বন্ধ হওয়ার পর রবিবার পর্যন্ত বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ২ হাজার ৭০০ জন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তাদের ৮০ শতাংশেরই ভিসার মেয়াদ ছিল। ভারত থেকে সরাসরি কভিড পজিটিভ রোগীও দেশে আসছে। পৃথিবীতে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে অন্য একটি দেশ থেকে কভিড পজিটিভ রোগী আসছে। এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত ১৬ জন কভিড পজিটিভ রোগী ভারত থেকে দেশে ফিরেছে। তারা দেশটি থেকে পজিটিভ সনদ নিয়েই দেশে এসেছে। তাদের স্থানীয়ভাবেও পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে একজনের শরীরে যে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে তা ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। কোয়ারেন্টাইন থেকে ১০ জন রোগী পালিয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে সাতজন ভারতফেরত, বাকিরা স্থানীয়। তাদের খুঁজে হাসপাতালে ফিরিয়ে এনেছে যশোর জেলা প্রশাসন। সম্প্রতি এদের মধ্যে সাত জন করোনা মুক্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশের কোনো জেলায়ই কোয়ারেন্টাইন করানোর মতো ব্যবস্থা নেই। হঠাৎ করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিলে যেকোনো জেলা প্রশাসনই অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে যাবে। যশোরের জেলা প্রশাসন অপ্রস্তুত অবস্থায় ছিল। কিন্তু এখন গুছিয়ে নিয়েছে। ভারতফেরতদের যশোর ও বেনাপোলের হোটেলে রাখা হয়েছে। কিছু যাত্রীকে অন্যান্য জেলায়ও পাঠানো হয়েছে। যারা ভারত থেকে এসেছে তাদের কেউই কোয়ারেন্টাইনে থাকতে চায় না। এ অবস্থায় তারা নানা দোষত্রুটি ধরার চেষ্টা করে। এটা ভালো না, ওটা ভালো না, বাথরুম পরিষ্কার না, মশাসহ আরও নানা অজুহাত দেখানোর চেষ্টা করে। এরপরও আরও একটা সমস্যা হচ্ছে হোটেল খরচ। সরকার বলেছে, সীমান্ত বন্ধ থাকার পরও যারা ফিরে আসছে তারা নিজ খরচে হোটেলে থাকবে। কিন্তু শুরুতে তারা কোনো খরচই দিতে চায়নি। কোয়ারেন্টাইনে যারা রয়েছে তাদের বক্তব্য হলোÑ তাদের জোর করে হোটেলে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তারা কেন খরচ দিতে যাবে। শেষ পর্যন্ত যশোর জেলা প্রশাসন কোয়ারেন্টাইনকারীদের হোটেল ও অন্যান্য খরচ ৫০ ভাগ কমিয়ে পুনর্নির্ধারণ করলে তারা সাড়া দিচ্ছে।’
এদিকে যশোর জেলাপ্রশাসনে যেসব কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন তাদের পক্ষে এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় সরকার আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে কর্মকর্তাদের যশোর পাঠাচ্ছে। এ পর্যন্ত যারা অন্য জেলা থেকে গিয়ে যশোরের জেলা প্রশাসনে দায়িত্ব পালন করছেন তারা হচ্ছেনÑ চুয়াডাঙ্গার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বিএম তারিক-উজ-জামান, মোহাম্মদ সাদাত হোসেন ও শহীদুল আলম। মেহেরপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মোহাম্মদ অনিক ইসলাম, মিথিলা দাশ, মাহমুদুল হাসান ও আহাম্মেদ মোফাচ্ছের।
গত ২৬ এপ্রিল থেকে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হলেও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এর দুদিন পর এ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ জারি করে। সেখানে বলা হয়েছে, পণ্য পরিবহন ছাড়া স্থল, নৌ ও বিমানযোগে যেকোনো ব্যক্তির ভারত হতে বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। শুধু ভিসার মেয়াদোত্তীর্ণ বাংলাদেশিরা ভারতের বাংলাদেশ হাইকমিশনের অনুমতি বা অনাপত্তি ছাড়পত্র নিয়ে বিশেষ বিবেচনায় দেশে আসতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রবেশকারীদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন পালন করতে হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। প্রতিবেশী এ দেশটিতে কভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। প্রতিদিন প্রায় চার হাজারের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। ভারতে করোনাভাইরাসের যে ভ্যারিয়েন্ট আবিষ্কার হয়েছে তা অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশও সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এত কড়াকড়ির পরও বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান মিলেছে।