বার্থ সংকটে ব্যাহত ইস্পাতের কাঁচামাল খালাস

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে বিশ্ববাজারে কাঁচামালের সরবরাহ সংকট ও উচ্চমূল্য দেখা দেয়। এ কারণে বড় ধাক্কা লাগে দেশের ইস্পাত খাতে। আর এখন বন্দরের বার্থ (নোঙরস্থান) সংকটে মেল্টিং স্ক্র্যাপ (পুরোনো লোহার টুকরো) হাতে পেতে দেরি হচ্ছে। ফলে নতুন ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। ইস্পাত শিল্পের জন্য আমদানি হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল এটি। যে কারণে সময়মতো এ কাঁচামাল না পেয়ে ভারী এ শিল্প-কারখানায় সরবরাহ ও উৎপাদন ব্যবস্থায় ভারসাম্য আনতে পারছেন না উদ্যোক্তারা।
বন্দর ও শিল্পোদ্যোক্তাদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইস্পাত তৈরির কাঁচামাল মেল্টিং স্ক্র্যাপ নিয়ে বন্দরের বহির্নোঙরে আসা জাহাজ পণ্য খালাসের সুযোগ পেতে বেশ বিলম্ব হচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা ৫৮টি জাহাজে মোট ১৩ লাখ ২৮ হাজার টন স্টিল স্ক্র্যাপ আনা হয়েছে। মাসভিত্তিক হিসাব বিবেচনায় নিলে গত সেপ্টেম্বরে ১ লাখ ৪২ হাজার ৫১০ টন বহনকারী পাঁচটি জাহাজের গড়ে বার্থিং বিলম্ব হয়েছে দুই থেকে নয়দিন। এরপর অক্টোবরে ২ লাখ ৮৪ হাজার টন বহনকারী ১৩টি জাহাজ ৩ থেকে ১৫ দিন, নভেম্বরে ৩ লাখ ১০ হাজার ৯৫২ টন বহনকারী ১৪টি জাহাজ ১১ থেকে ২১ দিন, ডিসেম্বরে ১ লাখ ৫৫ হাজার টন বহনকারী সাতটি জাহাজ ৭ থেকে ১৮ দিন সময় লেগেছে।
অন্যদিকে চলতি বছরের গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে যথাক্রমে ২ লাখ ৯২ হাজার ৯২৩ টন বহনকারী ১৪টি জাহাজ ২১ থেকে ২৩ দিন এবং ১ লাখ ৪২ হাজার ৬৮২ টন বহনকারী পাঁচটি জাহাজ গড়ে ১৩ থেকে ২৬ দিন পর্যন্ত বার্থিংয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ।
ইস্পাত খাতে নেতৃত্ব দেয়া বিএসআরএম, আবুল খায়ের গ্রুপ, কেএসআরএম, রহিম স্টিল, জিপিএইচ, আনোয়ার ইস্পাত, আরএসআরএমসহ প্রথম সারির সব কোম্পানিই এ সংকটে পড়েছে। পরিস্থিতি জটিল হতে থাকায় এসব শিল্পোদ্যাক্তার পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ)। সংগঠনটির পক্ষ থেকে দেয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরে স্টিল স্ক্র্যাপের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো বার্থ (নোঙরস্থান) ব্যবস্থা না থাকার কারণে জাহাজে আসা বিপুল পরিমাণ স্টিল স্ক্র্যাপ খালাসের ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত বিলম্বের সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ইস্পাত পণ্য উৎপাদনের জন্য দেশের ইস্পাত কারখানাগুলো সময়মতো এ কাঁচামাল পাচ্ছে না। যে কারণে ভয়ানক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে নোঙরজনিত বিলম্বের (বার্থিং ডিলেই) কারণে জাহাজগুলোকে বিরাট অংকের বিলম্ব মাশুল পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে স্টিলের কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চিঠিতে ইস্পাত খাতের উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে জাহাজবাহিত বিপুল পরিমাণ স্টিল স্ক্র্যাপ খালাসের (আনলোডিং) জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে কমপক্ষে দুটি সুনির্দিষ্ট বার্থ বরাদ্দ পেতে আবেদন করা হয়েছে।
ইস্পাত খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএসএমএর চেয়ারম্যান ও আনোয়ার ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মানোয়ার হোসেন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, জাহাজে করে আসা শিল্পের কাঁচামাল পেতে বিলম্বের কারণে উদ্যোক্তারা স্টিল পণ্য উৎপাদনে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে জাহাজ নোঙরে বিলম্ব মাশুল পরিশোধ করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। চট্টগ্রাম বন্দরের বিকল্প হিসেবে যেসব প্রকল্পের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোও কার্যত এ বন্দরের বিকল্প হতে পারেনি। গত মাসে প্রায় ১ লাখ ৪৩ হাজার টন নিয়ে আসা পাঁচটি জাহাজের বার্থিং ডিলেই গড়ে দুই থেকে তিন সপ্তাহ হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ী হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা এটা সর্বোচ্চ দুই থেকে তিনদিন হতে পারে। ইস্পাত খাতের জন্য সুনির্দিষ্ট বার্থ বরাদ্দ পেলে এ সমস্যা অনেকটাই সমাধান হবে।
রড তৈরিতে প্রাথমিক কাঁচামাল হিসেবে অপরিহার্য উপাদান মেল্টিং স্ক্র্যাপের বেশির ভাগই উন্নত দেশ থেকে আমদানি করা হয়। কাস্টমসের আমদানি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বছরে গড়ে ৪৫ লাখ টন মেল্টিং স্ক্র্যাপ আমদানি হচ্ছে। এর বাইরে সর্বোচ্চ আট-নয় লাখ টন জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ড ও স্থানীয়ভাবে মেল্টিং স্ক্র্যাপের সরবরাহ পাওয়া যায়। অর্থাৎ চাহিদার সিংহভাগই আমদানিনির্ভর।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ইস্পাত পণ্যের উৎপাদন ও চাহিদা বছরে প্রায় ৫৫ লাখ টন। তবে জিপিএইচসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কারখানা সম্প্রসারণ পদক্ষেপে সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা এখন ৯০ লাখ টন। আগামী দুই বছরের সম্ভাব্য চাহিদা হিসাব করে আগে থেকেই সক্ষমতা তৈরি করে রেখেছেন উদ্যোক্তারা।
বন্দর ব্যবহারকারীরা জানান, ১০ বছর পর পণ্য পরিবহন বেড়ে কত হতে পারে, তা হিসাব করে আগে থেকেই অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করতে হয়। বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য জেটি, যন্ত্রপাতি ও পণ্য রাখার চত্বর—এ তিনটি অবকাঠামো সবচেয়ে বেশি দরকার।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী ফোরাম ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, কাঁচামাল পাওয়ার ক্ষেত্রে সময় বাড়তে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই উদ্যোক্তাদের উদ্বেগ তৈরি করেছে। দক্ষতা ও অবকাঠামো সুবিধা বাড়িয়েই পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হবে। পণ্য পরিবহন কেমন হতে পারে সেটা নিরূপণ করে ৮ থেকে ১০ বছর আগেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখলে সংকটগুলো সামনে আসে না।
তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, পতেঙ্গা টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শেষের দিকে। পাশাপাশি ইয়ার্ড নির্মাণও হচ্ছে। বে টার্মিনালে নির্মাণকাজ চলছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ছোট ছোট সংস্কারকাজ হাতে নিয়ে জাহাজের অপেক্ষমাণ সময় কমিয়ে আনতে কাজ করে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান এ প্রসঙ্গে বলেন, কোনো একটি নির্দিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীদের আলাদাভাবে বার্থ বরাদ্দ দেয়ার বিষয়ে নিয়মের মধ্যে থেকেই করতে হবে। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধ ওঠার পর স্বাভাবিকভাবেই জাহাজ আগমনের চাপ বেড়েছে। পতেঙ্গা টার্মিনাল প্রায় শেষদিকে। এছাড়া বে টার্মিনালের কাজও এগিয়ে যাচ্ছে। বন্দরের প্রয়োজন মতো বেসরকারি জেটি ব্যবহার করার সুযোগ রাখা হয়েছে। আজই (গতকাল) স্ক্র্যাপ নিয়ে আসা একটি জাহাজ প্রথমবারের মতো ভেড়ানো হয়েছে বেসরকারি জেটিতে। এভাবেই আমরাও দক্ষতা ও সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে যাচ্ছি।
বন্দরের তথ্যমতে, কর্ণফুলীর দক্ষিণপাড়ে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা জেটিতে গতকাল মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো ভিড়েছে স্ক্র্যাপ নিয়ে আসা বড় জাহাজ। এমভি ডিনা ওশান নামের জাহাজটি ভেড়ানো হয় কর্ণফুলী ড্রাইডকের জেটিতে। ১৫৪ মিটার লম্বা সাড়ে ৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজটি বিএসআরএম গ্রুপের ১৫ হাজার ২২ টন স্ক্র্যাপ নিয়ে এসেছে।
বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, বন্দরের মূল জেটির পাশাপাশি বেসরকারি জেটিতে পণ্য খালাসে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হলো। বহির্নোঙরে জাহাজের অপেক্ষমাণ সময় কমানোর জন্য এটাও একটা ভালো পদক্ষেপ। বিএসআরএম গ্রুপের অধীনে আট কারখানা মিলে বছরে রড উৎপাদনক্ষমতা ১৬ লাখ টন। আর বিলেট উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ২০ লাখ টন। নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদনের জন্য কারখানায় দ্রুত কাঁচামাল জোগান পাওয়াটা খুবই জরুরি।