খাদ্যসঙ্কটের আশঙ্কা

0

ধান-চাল ও আলুর দাম বাড়ার জন্য কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক পরিসংখ্যানের গড়মিলকে দায়ী করেছেন। বলেছেন, এসব কৃষিপণ্যের আবাদ, উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতার যে পরিসংখ্যান হয়েছে, তা সঠিক নয়। পরিসংখ্যানের এই গড়মিলের কারণেই এবার ধান-চাল ও আলুর দাম বেড়েছে। কৃষিমন্ত্রীর এই অভিযোগপূর্ণ বক্তব্যটি শুধু গুরুতর নয়, অত্যন্ত প্রতিধানযোগ্যও। বিভিন্ন ক্ষেত্রের পরিসংখ্যান নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন উঠতে দেখা যায়। দেশের পরিসংখ্যানবিদ ও বিবিএসের দেয়া পরিসংখ্যানে যেমন গড়মিল দেখা যায় তেমনি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার দেয়া পরিসংখ্যানের সঙ্গেও দেশীয় পরিসংখ্যানের মিল খুব কমই লক্ষ্য করা যায়। পরিসংখ্যানের অমিল-গড়মিল থেকে এ ধারনাই দৃঢ়মূল হয় যে, পরিসংখ্যান তৈরির ক্ষেত্রে, পদ্ধতি অনুসরণের ক্ষেত্রে কোথাও না কোথাও ত্রুটি বা বিচ্যুতি ঘটে। ফলে প্রকৃত ও মানসম্পন্ন পরিসংখ্যান মেলেনা। শুধু কৃষিক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও একথা সমনভাবে প্রযোজ্য। কৃষিমন্ত্রী সঠিক ও প্রকৃত তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে নির্ভরযোগ্য ও মানসম্পন্ন পরিসংখ্যান তৈরিতে দেশীয় পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য পরিসংখ্যানবিদ ও বিবিএসের কর্মকর্তাদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তার এ আহবানে সংশ্লিষ্টরা সাড়া দেবেন, স্বভাবতই আমরা সেটা কামনা করি। তবে যে কোনো ক্ষেত্রে প্রণীত পরিসংখ্যান যাচাইয়ের ভালো ব্যবস্থা না থাকলে, জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে সঠিক ও শুদ্ধ পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। আবাদ, উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা সম্পর্কিত পরিসংখ্যান তৈরির দায়িত্ব কৃষিপরিসংখ্যানবিদদের। তাদের কৃষিমন্ত্রণালয়ের সঙ্গেই সংযুক্ত থাকার কথা। তাদের তৈরি পরিসংখ্যান যদি সঠিক না হয়, বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিশীল না হয় তবে তার দায়-দায়িত্ব মূলত তাদের ওপরই বর্তায়। স্বয়ং-মন্ত্রণালয়ও দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। পরিস্যংখ্যানের গড়মিল ও ভুলের জন্য খেসারত গুনতে হয় জনগণকেই। কৃষিপণ্যের সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির নিষ্ঠুর স্বীকার হতে হয় প্রান্তিক ক্রেতা বা ভোক্তাদের। এবার হঠাৎ আলুর দাম বেড়ে যাওয়া, চালের দাম বেড়ে যাওয়া কিংবা অন্য কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে অন্যান্য কারণ যাই থাক, পরিসংখ্যানগত ত্রুটি-বিচ্যুতি ও গড়মিলও ছিল, সেটা অস্বীকার করা যাবে না।
খাদ্যসংক্রান্ত পরিসংখ্যান অর্থাৎ খাদ্যের চাহিদানির্ণয় যোগানের উৎস নির্ধারণ, প্রয়োজনে আমদানির ব্যবস্থা বাজারজাতকরণ ইত্যাদি খাদ্যমন্ত্রণালয়ের কাজ। উৎপাদন সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান তৈরির দায়িত্ব তার নয়। তবে দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কাজের ক্ষেত্রে সমন্বয় ও পারস্পারিক সহযোগিতা থাকার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। সরকারিভাবে লাগাতারই বলা হচ্ছে, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছি। অথচ বাস্তবে প্রতি বছরই কিছু না কিছু খাদ্যশস্য আমদানি করতে হচ্ছে। যদি আমরা খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণই হয়ে যায় তবে এই আমদানি কেন? এবার চালের দাম দিনকে দিন বেড়ে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় আমদানি শুল্ক কমিয়ে হাজার হাজার টন চাল আমদানি করতে হয়েছে। এখনো প্রতিদিন আমদানির চাল দেশে আসছে। তারপরও চালের দাম কমেছে না, বরং বাড়ছেই। প্রাকৃতিক ও অন্যান্য কারণে বিগত দু’ মওসুমে ধানের উৎপাদন এবং ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। কিন্তুু আগের মজুদ যথেষ্ট থাকায় চালের সংকট ও মূল্য এখন এতটা বাড়ার কথা নয়। তা সত্ত্বেও বাড়ছে এবং আমদানি করেও পরিস্থিতি সামলানো যাচ্ছে না। এদিকে মার্কিন কৃষি বিভাগের গ্লোবাল এগ্রিকালচারাল ইনফরমেশন নেটওয়ার্কের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ আগামীতে বড় রকমের খাদ্যঘাটতিতে পড়তে যাচ্ছে। প্রতিবেদনের প্রক্ষেপণে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে (২০২০-২০২১) চালের উৎাদন হবে ৩ কোটি ৪৮ লাখ টন, যা আগের তুলনায় প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টন কম। আর এ সময়ে চালের চাহিদা থাকবে প্রায় ৩ কোটি ৫৯ লাখ টন। সে হিসাবে ঘাটতি গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ১১ লাখ টন। একই সময় দেশে গমের চাহিদা থাকবে প্রায় ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টন। উৎপাদন হবে মাত্র ১২ লাখ ২০ হাজার টন। অর্থাৎ সাকুল্য খাদ্যঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় ৭৪ লাখ ৩০ হাজার টন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, খাদ্যঘাটতি মেটাতে প্রায় ৭৭ লাখ টন চাল ও গম আমদানি করতে হবে এবং সেটা হবে স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমদানি।
বিপুল খাদ্যঘাটতির আশংকা খাদ্যসংস্থান ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য মস্তবড় অশনি সংকেত। বিশ্বজুড়ে খাদ্য উৎপাদন আগামীতে কমবে বলে পূর্বভাস রয়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার বিশ্ব খাদ্য সংকট প্রতিবেদন ২০২০ মতে, বিশ্বে সাড়ে ১৩ কোটি মানুষ চরম খাদ্যসংকট ও পুষ্টিহীনতায় রয়েছে। করোনা এ পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটিয়েছে। খাদ্যের সংকট ও পুষ্টিহীনতা আরো বাড়তে পারে, যা বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতি হুমকিতে ফেলাতে পারে। উন্নত দেশগুলোতে অবশ্য খাদ্যের সংকট নেই; উল্টো বড় মজুদ রয়েছে। খাদ্যের সুষম বণ্টন হলে বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা অভঙ্গুর থাকতে পারে। অথচ খাদ্যের সুষম বণ্টনের ব্যবস্থাই নেই। যা হোক, আমাদের অভিজ্ঞতায় এটা আছে যে, অর্থ থাকার পরও খাদ্য আমদানি করা সম্ভব হয় না। খাদ্য সংকটই তার কারণ। কাজেই, আগামীর খাদ্যঘাটতি পূরণে উৎপাদনের ওপরই যেমন জোর দিতে হবে, তেমনি প্রয়োজনে আমদানিও করতে হবে। টেকসই খাদ্যনিরাপত্তা অর্জন করতে হবে। এজন্য সর্বাগ্রে সঠিক ও মানসম্পন্ন পরিসংখ্যান তৈরি করতে হবে। না হলে খাদ্যের প্রকৃত চাহিদা নির্ধারণ ও যোগান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। সরকার সময় থাকতে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা নেবে বলে আমরা আশা করি।