তারা রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ পাবেন কি?

0
তৈমূর আলম খন্দকার
নির্বাচন কমিশনের স্বীকৃত মতেই, এবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২২ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি ছিল, যা প্রকৃতপক্ষে আরো অনেক কম। সংসদ উপ-নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি আরো কম ছিল। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। দিন দিন ভোটার উপস্থিতি কমে যাওয়ায় সরকার বা নির্বাচন কমিশনের কিছুই যেন আসে যায় না। কারণ লোকে বলে যে, বর্তমান যেন নির্বাচন কমিশন একটি গৃহপালিত স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান (!)। কারণ প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেই দিয়েছেন, ‘বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার আনার দায়িত্ব আমাদের নয়।’ অন্য দিকে ঢাকা-১০ আসনের নির্বাচনে কমিশনের সিনিয়র সচিব কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি খুব কম হওয়ায় বলেছেন, ‘একজন মাত্র ভোটার ভোট দিলেও নির্বাচন বৈধ হবে।’ এ ধরনের অসাংবিধানিক কথা বললেও কমিশনের কর্মকর্তাদের জবাবদিহি করতে হয় না। কারণ বাংলাদেশে একজন রাজি বা খুশি থাকলে কারো কাছে নাকি জবাবদিহি করতে হয় না। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন মেরুদণ্ডহীন ও দুর্নীতিবাজ বলে এতদিন রাজনৈতিক দলগুলো বলে আসছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, দেশের খ্যাতনামা ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক যাদের নিজ নিজ অঙ্গনে জাতির প্রতি যথেষ্ট অবদান রয়েছে, তারাও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে তদন্ত করার নিমিত্তে জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন জানিয়েছেন প্রায় দুই মাস আগে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে তদন্ত করা তো দূরের কথা, রাষ্ট্রপতি এ মর্মে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কি না তা-ও জানা যায়নি। রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে নির্বাচন কমিশনের আরো দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎকার প্রার্থনা করছেন বিশিষ্ট নাগরিকরা (সূত্র : ৩১ জানুয়ারি ২০২১ জাতীয় পত্র-পত্রিকা)। দেখার বিষয়, রাষ্ট্রপতি বিশিষ্ট নাগরিকদের সাক্ষাৎকার দেবেন কি না। বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৮(২) অনুচ্ছেদ মোতাবেক ‘রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করিবেন এবং এই সংবিধান ও অন্য কোনো আইনের দ্বারা তাহাকে প্রদত্ত ও তাহার ওপর অর্পিত সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন করিবেন।’
সংবিধান মোতাবেক ‘রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের শেষ আশ্রয়স্থল’। রাষ্ট্রপতি কোনো সাক্ষাৎকার প্রার্থীর যদি সাক্ষাৎকার গ্রহণে নীরবতা পালন করেন তবে অবুঝ লোকেরা বুঝে নেবে অন্য কিছু। রাষ্ট্রপতি যদি স্বেচ্ছায় কারো সাক্ষাৎকার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান তাহলে ভিন্ন কথা। তবে তিনি (রাষ্ট্রপতি) যদি অন্য কোনো কারণে বিশেষত সরকারের প্রতিবন্ধকতার কারণে ৪২ জন নাগরিককে সাক্ষাৎকার না দেন তবে জাতির কাছে এটি একটি খারাপ নজির বা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ৪২ জন নাগরিকের দাবি জাতির কাছে স্পষ্ট। বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ‘সার্কাসে’ পরিণত করছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন। ওই সার্কাসের মূল নায়ক সরকার স্বয়ং, অন্যদিকে খলনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে প্রশাসন এবং সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অথচ এই সার্কাস দেখাতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে জনগণের। তাই এখন দাবি উঠেছে, জনগণের অর্জিত অর্থ সার্কাস দেখানো বা তামাশা করার জন্য ব্যয় করে জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি করার চেয়ে ‘অটো নির্বাচিত’ ঘোষণা করলে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ বেঁচে যায় এবং এ টাকায় আরেকটি পদ্মা সেতু হতে পারে। অটোসিস্টেমের সাথে সরকার জাতিকে পরিচয় করিয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষায় অটোপাসের মতো অটো নির্বাচিত ঘোষণা করা হলে জনদুর্ভোগ ও জনঅর্থ উভয়ই বেঁচে যায়। অন্য দিকে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরকারদলীয় প্রার্থীকে পাস করানোর জন্য যে ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করে তাদের সুনাম ও ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করছে, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে।
অধিকন্তু ২ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের ১০০ জন সিনিয়র আইনজীবী সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতির তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি নিজেও একজন আইনজীবী। দীর্ঘদিন আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন বিধায় তিনি নিজেও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের আবেদনের প্রতি সাড়া দেয়ায় যৌক্তিকতা অবশ্যই বুঝতে পারছেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের আবেদনে বলা হয়েছে- ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারের বিরুদ্ধে উপস্থাপিত বিভিন্ন অনিয়ম ও অর্থ-সংশ্লিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে আইনজীবীরা চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের অধীন ইলেক্টোরাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ভয়াবহ দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ বিভিন্ন গণমাধ্যমে তথ্য-উপাত্তসহ প্রকাশ পেয়েছে। উপস্থাপিত অভিযোগগুলো নিম্নরূপ-‘প্রশিক্ষণের বাজেটের টাকা হাতিয়ে নেয়া; কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম; নিয়মবহির্ভূতভাবে কমিশনারদের গাড়ি ব্যবহার; ইভিএম ক্রয় ও ব্যবহারে গুরুতর অনিয়ম; বিভিন্ন নির্বাচনে সংঘটিত অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে নির্লিপ্ততা; সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে অযোগ্যতা ও বিশেষ বক্তা দেখিয়ে আর্থিক সুবিধা নেয়া।’ (জাতীয় দৈনিক ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১)
এই নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনায় সংবিধান লঙ্ঘনের কথা দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার হওয়া ছাড়াও আওয়ামী লীগের বিবেকবান মানুষগুলোই এখন নির্বাচনে হরিলুটের কাহিনী বলে বেড়াচ্ছেন। আওয়ামী লীগের মুখপাত্র ও সাধারণ সম্পাদকের ছোট ভাই এবং নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়রকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘কেন মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করলেন?’ তিনি চট্টগ্রামের মেয়রকে উদ্দেশ করে আরো বলেন, ‘৬৪ বছর রাজনীতি করেন। এই ত্যাগী লোকটা কেন ভোটডাকাতি করতে গেলেন? কেন মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করলেন?’ (সূত্র : জাতীয় পত্রিকা ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১) পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ওই প্রশ্নগুলো শুধু কাদের মির্জার নয়, বরং সমগ্র জাতির। সরকার সমগ্র জাতিকে উপহাসের পাত্রে পরিণত করেছে। বাংলাদেশে যা কিছুই ঘটুক না কেন তা মূলত সরকারপ্রধানের অ্যাকাউন্টে জমা হয়। পদ্মাসেতু নির্মাণ করে তার অ্যাকাউন্টে যে কৃতিত্ব জমা হয়েছে, তার চেয়ে কি বেশি বদনাম জমা হয়নি ভোটের অধিকার হরণ করে? নির্বাচন কমিশন আস্থাহীনতার সঙ্কটে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এ কারণগুলো খতিয়ে দেখা উচিত। ইতিহাসের পাতায় যখন একদিন জনগণের রায় প্রকাশ পাবে তখন ইতিহাস কি সাক্ষ্য দেবে? ‘রাজা যা বলেন পরিষদ বলেন এর বহুগুণ’ এ প্রবাদটি দীর্ঘদিন যাবৎ সমাজে/দেশে পরিচিত এবং বাস্তবতা এটাই। ভোটের অধিকার হরণের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সব অর্জন জাতির কাছে ম্লান হয়ে যাচ্ছে যা তার মোসাহেবরা তাকে বলেন না। এর পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের বিশিষ্টজনরা নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন জানিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে এটি একটি অনাস্থা বটে, তবে এটা কি নামান্তরে সরকারের বিরুদ্ধে নয়? বাংলাদেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ পাবেন কি? এ নিয়ে জনমনে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকুক এটা কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকের কাম্য নয়। রাষ্ট্রপতি নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন যে, তিনি একজন ব্যক্তি মাত্র নন বা তিনি কোনো দলের নন। যেদিন তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন, সেদিন থেকেই তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যে প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের জনগণ, সার্বভৌমিকতা ও সংবিধানকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে একটি ন্যায্য দাবি নিয়ে কেউ ফেরত আসবেন, তা মোটেও জাতির কাম্য নয়। জাতি এখন চেয়ে আছে রাষ্ট্রপতির দিকে। জনগণের অর্থে লালিত-পালিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনের মতোই জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে কেন? তাদের যেন একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে ক্ষমতাসীনের সুনজরে থাকা। কী করলে শীর্ষ ব্যক্তি রাজি খুশি থাকবেন সেটাই যেন আমলাদের কামনা ও বাসনা। ফলে জনগণের অধিকারকে অক্ষুণ্ন রাখা বা বাস্তবায়ন করা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বলে কার্যত মনে হচ্ছে না। যদি তাই না হয় তবে নির্বাচনে শাসক দল এভাবে হরিলুট করে কিভাবে? সরকারি দলের মার্কাকে পাস করানোই যেন পুলিশ ও প্রশাসনের দায়িত্ব। এতে জনগণের ভোটের অধিকার গোল্লায় যাক, তাতে তাদের বুঝি কিছু আসে যায় না?
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)