যেমন ছিল বিদায়ী বছরে বৈশ্বিক পণ্যবাজার

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥নভেল করোনাভাইরাসের মহামারী ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। নিকট ইতিহাসে এমন ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়েনি বিশ্ব। রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, বাণিজ্য থেকে সমাজ সবকিছুতেই প্রভাব পড়েছে করোনা সংকটের। মহামারী ও এর জের ধরে দেশে দেশে চলা লকডাউনে বৈশ্বিক পণ্যবাজারে রীতিমতো টালমাটাল অবস্থা তৈরি হয়েছে। আমদানি-রফতানি কার্যক্রম শ্লথ হয়েছে। পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হয়েছে। কিছু পণ্যের চাহিদায় দেখা দিয়েছে পতন। আবার কিছু পণ্যের দাম রীতিমতো আকাশ ছুঁয়েছে।
তবে করোনা মহামারীর পাশাপাশি ২০২০ সালজুড়ে আরো কিছু বিষয় বৈশ্বিক পণ্যবাজারে প্রভাব ফেলেছে। এর মধ্যে অন্যতম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার আলোচনা প্রক্রিয়া, চীন-ভারত যুদ্ধের দামামা, মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, অস্ট্রেলিয়া ও চীনের রাজনৈতিক-বাণিজ্যিক বিরোধ, প্রভৃতি। করোনা ও এসব কারণে ২০২০ সালে বৈশ্বিক পণ্যবাজারে বিভিন্ন পণ্যের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে এ আয়োজন—
বাড়তি দামে খাবার কেনার বছর
২০২০ সাল বাড়তি দামে খাবার কেনার মধ্য দিয়ে শুরু করেছিল বিশ্ববাসী। মাঝে কিছুটা কমে এলেও করোনা মহামারীর প্রকোপ যত বেড়েছে, খাবারের দাম ততই চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশনের (এফএও) গ্লোবাল ফুড প্রাইস ইনডেক্স অনুযায়ী, বিদায়ী বছরের প্রথম মাসে বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের গড় মূল্যসূচক ছিল ১০২ দশমিক ৫ পয়েন্ট। মে মাস নাগাদ খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক ৯১ পয়েন্টে নেমে আসে, যা ১৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
তবে টানা পতন কাটিয়ে জুনে ঘুরে দাঁড়ায় খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক। ওই মাসে খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক ছিল ৯৩ দশমিক ১ পয়েন্ট। এর পর থেকে সূচকমানে আর মন্দা ভাব দেখা যায়নি। বাড়তে বাড়তে গত নভেম্বরে খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক দাঁড়ায় ১০৫ পয়েন্টে। করোনা মহামারীর মধ্যে এটাই খাদ্যপণ্যের সর্বোচ্চ বৈশ্বিক মূল্যসূচক। একই সঙ্গে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের পর এটাই এ সূচকে সর্বোচ্চ রেকর্ড।
এফএও জানিয়েছে, করোনা মহামারীর কারণে একদিকে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটেছে। অন্যদিকে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দেশ ও মানুষের মধ্যে মজুদপ্রবণতা বাড়ায় খাবারের চাহিদা ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এ পরিস্থিতি বিশ্বজুড়ে খাবারের দাম বাড়িয়েছে।
ইতিহাসে সর্বোচ্চ দাম স্বর্ণের
বছরের শুরু থেকেই করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির সাথে সাথে স্বর্ণের বাজার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। তবে মজার বিষয় হলো, স্বর্ণের দাম বাড়লেও এর চাহিদা কিন্তু খুব একটা বাড়েনি। বরং করোনার ধাক্কায় আয় কমায় চীন ও ভারতসহ শীর্ষ ভোক্তা দেশগুলোয় ব্যক্তি পর্যায়ে স্বর্ণের চাহিদা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
অর্থনীতির সাধারণ সূত্র অনুযায়ী, চাহিদা কমলে পণ্যের দামও কমে যায়। তবে ২০২০ সালে স্বর্ণের বাজারে উল্টো চিত্র দেখা গেছে। আগস্টে ইতিহাস গড়ে স্বর্ণের দাম। আউন্সপ্রতি ২ হাজার ৭২ ডলার ৫০ সেন্টে বিক্রি হয় মূল্যবান ধাতুটি। এর আগে কখনই এত বেশি দামে স্বর্ণ বিক্রি হয়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, করোনা মহামারীর কারণে শেয়ার ও মুদ্রাবাজারে টালমাটাল অবস্থা দেখা গেছে। এ পরিস্থিতিতে ‘সেফ হ্যাভেন’ বা নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে স্বর্ণের প্রতি ভরসা করেছেন বিনিয়োগকারীরা। এ ভরসাই সব নিয়ম ভেঙে স্বর্ণের দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করেছে। তবে বছরের একেবারে শেষভাগে এসে দাম কিছুটা কমেছে স্বর্ণের।
চাঙ্গা চালের রফতানি বাজার
করোনাকালে বিভিন্ন দেশ জনগণের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চালের মজুদ বাড়িয়েছে। ত্রাণ হিসেবে চাল দেয়ায় বিভিন্ন দেশে খাদ্যপণ্যটির চাহিদাও ছিল বাড়তি। এসব কারণে ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ শীর্ষ রফতানিকারক দেশগুলোয় চালের দাম বেড়েছে। বর্তমানে ভারতে রফতানিযোগ্য চাল টনপ্রতি ৩৮০-৩৮৫ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে খাদ্যপণ্যটির টন ৫০০ ডলার ছাড়িয়েছে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরের পর ভিয়েতনামে চালের দাম সর্বোচ্চে উঠেছে। নভেম্বরে বিশ্ববাজারে চালের গড় দাম বেড়ে টনপ্রতি ৪৮৯ ডলারে উন্নীত হয়েছে।
টালমাটাল জ্বালানি তেলের বাজার
করোনা মহামারীর কারণে বৈশ্বিক চাহিদায় ধস নামার পাশাপাশি ওপেক প্লাসের আওতায় উত্তোলন হ্রাস চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা ও রুশ-সৌদি মূল্যযুদ্ধ বিদায়ী বছরে জ্বালানি তেলের বাজারে টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
গত মার্চে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শূন্য ডলারের নিচে নেমে যায়। অর্থাৎ ওই সময় জ্বালানি তেল কিনলে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো মূল্য নেয়ার পরিবর্তে উল্টো ক্রেতাদের পরিবহন ব্যয় গছিয়ে দিয়েছিল। জ্বালানি তেলের বাজারে এমন নজিরবিহীন ঘটনা আগে দেখা যায়নি।
তবে সময়ের ব্যবধানে সেই সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে জ্বালানি তেলের বাজার। বর্তমানে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ৫০ ডলারের আশপাশে অবস্থান করছে। যদিও জ্বালানি পণ্যটির বৈশ্বিক চাহিদা কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে বাড়েনি। তবে ইতিহাস গড়া বছরটিকে মনে রাখবেন জ্বালানি খাতের সঙ্গে সম্পৃক্তরা।
বৈশ্বিক ইস্পাত উৎপাদনে ধস
করোনা মহামারী বৈশ্বিক ইস্পাত উৎপাদনে ধস নামিয়েছে। গত এপ্রিলে বিশ্বজুড়ে শিল্প ধাতুটির সম্মিলিত উৎপাদন ১৩ কোটি ৬৯ লাখ টনে নেমে আসে। যদিও এর পর থেকে একটু একটু করে বেড়েছে ইস্পাতের বৈশ্বিক উৎপাদন। তবে সংকটকালীন মূল্যবৃদ্ধির পুরোপুরি লাগাম টানা এখনো সম্ভব হয়নি। যদিও মহামারীর সময় বেশির ভাগ দেশে ইস্পাত উৎপাদন ও রফতানি কমেছে। তবে ব্যতিক্রম চীন। সংকটকালেও দেশটির ইস্পাত শিল্প শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছে।
শীতেও বাড়তি পাম অয়েলের দাম
শীত মৌসুমে পাম অয়েল জমে যায়। ফলে এ সময় পণ্যটির চাহিদা ও দাম দুটোই কমতির দিকে থাকে। তবে করোনা মহামারী এবার চিত্রপট পাল্টে দিয়েছে। শীত শুরু হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে পাম অয়েলের দাম কমেনি, উল্টো বেড়েছে। এ ধারাবাহিকতায় গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন পাম অয়েলের গড় দাম বেড়ে ৯১৭ ডলার ছাড়িয়েছে। বিদায়ী বছরের শুরুর দিকে রফতানি বাড়াতে পাম অয়েলের বিদ্যমান শুল্কহার শূন্যে নামিয়ে এনছিল কিংবা সীমিত করেছিল মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। নতুন বছরে সেই শুল্কহার ফের বাড়ানো হয়েছে।
কয়লার বৈশ্বিক চাহিদায় পতন
করোনা মহামারীর জের ধরে চলতি বছর কয়লার বৈশ্বিক চাহিদা ৭২৪ কোটি ৩০ লাখ টনে দাঁড়াতে পারে বলে জানিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ), যা আগের বছরের তুলনায় ৫ শতাংশ কম। মহামারীর পাশাপাশি দেশে দেশে জলবায়ু সচেতনতা বৃদ্ধি ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারে সচেতন হয়ে ওঠায় কয়লার চাহিদা কমে এসেছে।