নতুন বছরে মূল্য নির্ধারণে প্রভাবক হবে যে তিন বিষয়

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥বড়দিনের ছুটির আগে-পরে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বাড়তির দিকে রয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সর্বশেষ কার্যদিবসে ভবিষ্যতে সরবরাহ চুক্তিতে প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৫২ ডলার ৪০ সেন্টে উঠেছে। ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) বিক্রি হয়েছে ব্যারেলপ্রতি ৪৯ ডলার ২০ সেন্টে। করোনা মহামারীর হাত ধরে সৃষ্ট বিপর্যয়ের আগে গত ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক বাজারে এমন দামে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বিক্রি হয়েছিল।
এর পরের ঘটনা মোটামুটি সবার জানা। মহামারীকালে বৈশ্বিক চাহিদায় রেকর্ড পতনের জের ধরে ইতিহাসের সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমেছিল জ্বালানি তেলের দাম। দরপতনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে রুশ-সৌদি মূল্যযুদ্ধ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে চলতি ডিসেম্বরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে জ্বালানি তেলের বাজার। এখন প্রশ্ন হলো বিদ্যমান চাঙ্গা ভাব কতদিন স্থায়ী হবে? নাকি নতুন বছর শুরুর মধ্য দিয়ে নতুন করে সংকটে পড়বে জ্বালানি তেলের বাজার? সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মোটাদাগে তিনটি বিষয়কে চিহ্নিত করেন বাজার বিশ্লেষকরা। মূলত এ তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে নতুন বছরে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য পরিস্থিতি কেমন হবে তা—
কভিড-১৯ ভ্যাকসিন: বর্তমানে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় নভেল করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন। ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্র, লাতিন আমেরিকা থেকে এশিয়া—করোনা ভ্যাকসিন মহামারীর অন্ধকারের মধ্যে একমাত্র আশার আলো হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা প্রয়োগ শুরু হয়েছে। মডার্নার টিকাও বাজারে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের টিকা প্রয়োগ কার্যক্রম অপারেশন ওয়ার্প স্পিডের প্রধান ডা. মনসেফ স্লাউই জানান, এক-তৃতীয়াংশের বেশি আমেরিকানকে টিকা দেয়া তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য।
এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোয় কভিড-১৯-এর টিকা প্রয়োগ শুরু হয়েছে। কিছুদিন আগে করোনাভাইরাসের টিকা তৈরি করা আরেক সংস্থা মডার্না ইনকরপোরেশন ঘোষণা করেছিল, ইউরোপীয় কমিশন তাদের টিকার আরো আট কোটি ডোজ ক্রয়াদেশ বাড়িয়েছে। এর মাধ্যমে মডার্না থেকে ইইউর মোট ক্রয়াদেশের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ডোজে। আর এ টিকা প্রয়োগ কর্মসূচির প্রথম সাফল্য দেখা দিয়েছে জ্বালানি তেলের বাজারে। টিকার প্রয়োগ জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, যত বেশি দেশে টিকার প্রয়োগ শুরু হবে জ্বালানি তেলের দাম তত বাড়বে।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি: করোনা মহামারীর ধাক্কা সামলে সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিগুলো প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুতগতিতে আগের অবস্থানে ফিরতে শুরু করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কভিড-১৯ সংক্রমণকে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে ঘোষণার অল্প সময়ের মধ্যেই বিভিন্ন দেশে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা অর্থনীতিকে ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করে। বিশ্বজুড়ে ১৫ লাখ কোটি ডলারের বেশি প্রণোদনা অর্থনীতিগুলোয় যুক্ত হয়েছে।
মার্কিন ফেডারেল সরকার আর্থিক বাজার, অঙ্গরাজ্য, স্থানীয় সরকার, প্রতিষ্ঠান ও পরিবারের সহায়তার জন্য প্রায় ৯০ হাজার কোটি ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজে সই করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে বিপুল পরিমাণ এ প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে সতর্ক করেছেন কিছু বিশ্লেষক। তাদের ভাষ্য, বিপুল প্রণোদনার মাধ্যমে দাম বেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, যা অর্থনৈতিক পতনের কারণ হবে।
তবু সরকারি প্রণোদনা স্বল্পমেয়াদে হলেও একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে, যা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের আশা জোরদার করে আগামী দিনগুলোয় জ্বালানি তেলের চাহিদা ও দাম বাড়াতে পারে।
ওপেক প্লাস চুক্তির ভবিষ্যৎ: দুই সপ্তাহ আগে জ্বালানি তেল রফতানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক ও এর মিত্র দেশগুলোর জোট (ওপেক প্লাস নামে পরিচিত) এ বছরের উত্তোলন হ্রাসের পরিমাণ ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে বৈঠক করেছে। এ সময় বিশ্লেষকরা আশা প্রকাশ করেন, ওপেক প্লাসের চুক্তির শর্ত আরো তিন মাসের জন্য বর্ধিত হবে এবং জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক উত্তোলন দৈনিক ৭৭ লাখ ব্যারেল কমানো হবে। তবে চুক্তিভুক্ত দেশগুলো জানুয়ারির শুরুতে প্রতিদিন পাঁচ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেল উত্তোলন বাড়িয়ে দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক উত্তোলন আগের তুলনায় বাড়ানোর ঘোষণার পরও দাম চাঙ্গা রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, জানুয়ারি থেকে উত্তোলন বৃদ্ধির মানে হলো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। যদিও এটি কয়েক সপ্তাহ আগেও প্রত্যাশিত ছিল না। এজন্য সরবরাহ বৃদ্ধির খবরেও তেলের দাম বাড়ছে। তবে ওপেক প্লাসের এ চুক্তির ভবিষ্যৎ কী হবে, তার ওপর নির্ভর করবে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দামে সম্ভাব্য পরিবর্তন।