গোল্ডেন মনিরের সহযোগী সুবিধাভোগী ২০ প্রভাবশালী

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ গোল্ডেন মনির। শূন্য থেকে অবিশ্বাস্য উত্থান। মনিরের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল দোকানের সেল্‌সম্যান থেকে। পরে এক কমিশনারের মাধ্যমে ঢাকার শাহ্‌জালাল বিমানবন্দরে লাগেজ টানা শুরু করেন। একপর্যায়ে লাগেজ টানা পার্টির সদস্য থেকে জড়িয়ে পড়েন স্বর্ণ চোরাকারবারিতে। এরপর থেকেই তার নামের সঙ্গে জোড়া লাগে ‘গোল্ডেন মনির’। দোকান কর্মচারী থেকে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া মনির অর্থ-বিত্ত গড়েছেন প্রভাবশালী আমলা, কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের আনুকূল্য নিয়ে। বিনিময়ে তাদের নানাভাবে সুবিধা দিয়েছেন মনির। মনিরের সহযোগী ও সুবিধাভোগী অন্তত ২০ জনের নাম উঠে এসেছে তদন্তে। এসব ব্যক্তি গোল্ডেন মনিরকে সহযোগিতা দিয়ে বিনিময়ে পেয়েছেন বিপুল অর্থ, বিলাসবহুল গাড়ি, বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণ, অভিজাত হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসা সেবাসহ আরো কত কী।
প্রভাবশালীরা হাতে থাকায় মনিরের প্লট দখল, গণপূর্তের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, বিমানবন্দর দিয়ে সোনা চোরাকারবার করা মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল মনিরের জন্য। গত ২১শে নভেম্বর সকালে রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় মনিরের বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব। এ সময় অস্ত্র, স্বর্ণ এবং মদসহ র‌্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় র‌্যাব বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় মাদক, অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩ টি মামলা করে। সূত্র জানায়, পরে পুলিশ তাকে আদালতে হাজির করলে আদালত ৩ টি মামলায় ১৮ দিন পুলিশি হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোল্ডেন মনিরকে গ্রেপ্তারের আওতায় নিয়ে আসা এলিট ফোর্স র‌্যাব’র আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ মানবজমিনকে জানান, ‘তদন্তকারী কর্মকর্তা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’ মামলার তদন্তের মুখ্য সমন্বয়কারী ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের ডিসি মো. মশিউর রহমান জানান, ‘আমরা জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছি। তার তথ্যগুলোর তদন্ত চলছে’। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সিলেটের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি মনিরের সহযোগিতায় রয়েছেন। একটি অফিসে ঢোকার অনুমতি না থাকার কারণে তিনি ওই প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছের এক ব্যক্তিকে নিজের আয়ত্তে আনেন। ওই ব্যক্তির গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুরে। থাকেন উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টর এলাকার একটি বিলাসবহুল ফ্লাটে। তদবির ও চোরাচালানে সহযোগিতা করার জন্য মনির তাকে ফ্ল্যাটটি কিনে দিয়েছেন বলে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছেন। মনিরের সঙ্গে বিমানবন্দরের একাধিক কর্মকর্তা এবং একাধিক এয়ারলাইন্সের ক্রুদের লিয়াজোঁ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সূত্র জানায়, মনিরের সঙ্গে ঢাকার পাশের জেলার আরেকজন সংসদ সদস্যের সম্পর্ক রয়েছে। গণপূর্তে তদবির করার জন্য তিনি তাকে কাজে লাগিয়েছেন। ওই প্রভাবশালী ব্যক্তি নিয়মিত গণপূর্তে যাতায়াত করতেন। জিকে শামীমের তদবিরেও তিনি সহযোগিতা করেছেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, মনিরের চোরাকারবারে আরেক প্রভাবশালী জড়িত। তিনি একটি অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতা। সচিবালয় ও আমলাদের কাছে মনিরের যতো তদবির থাকতো তিনি তা করে দিতেন। অঙ্গ সংগঠনের নেতা হওয়ার পর সচিবালয়ে তার যাতায়াত বেড়ে যায়। রাজউক’র ৪ জন আমলার সঙ্গে মনিরের সম্পর্ক ছিল। তাদের প্রত্যেকেই মনির ১ টি করে গাড়ি কিনে দিয়েছেন। পল্লবী ও রূপনগর এলাকায় দিয়েছেন ফ্ল্যাট। মনির গ্রেপ্তার হওয়ার পর তারা কথাবার্তা কমিয়ে দিয়েছেন। মনিরকে রাজধানীতে একাধিক খাস জমি বাগিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে গণপূর্তের ২ জন আমলা জড়িত। তাদের সম্পর্কের বিষয়টি গণপূর্তের সবাই জানেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, মনিরসহ তার চার স্বর্ণ চোরাকারবারির নিয়মিত যাতায়াত ছিল রাজধানীর অভিজাত এলাকার একটি বাড়িতে। ওই বাড়িতে একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ থাকেন। মনির গণপূর্ত এবং রাজউক-এ গেলে তিনি তার লোক বলে পরিচয় দিতেন। সময়ে- অসময়ে সবাইকে শুনিয়ে মোবাইলে লাউড স্পিকারে কথা বলতেন। এতে তাকে সবাই সমীহ করতেন। ক্যাসিনো কাণ্ডে একাধিক মাফিয়াকে মদত দেয়ায় তার ওই সময় ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। মনিরকে তার অপকর্মে সহযোগিতা দেয়ার কারণে তিনি মাসোয়ারা পেতেন। সূত্র জানায়, রাজউক ও গণপূর্তে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে দক্ষিণাঞ্চলের আরেক প্রভাবশালী নেতার সহযোগিতা পেয়েছেন মনির। ৫ বছর আগে কাজের সূত্রে মনিরের সঙ্গে তার পরিচয়। পরিচয় হওয়ার পর থেকেই তাদের সম্পর্ক গড়ে উঠে। মনিরের তদবিরে সহযোগিতা করার কারণে তাকে দুইটি বিলাসবহূল গাড়ি উপহার দেয়ার তথ্য পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র জানায়, গোল্ডেন মনিরের উত্থানের পেছনে মনিরের কাছে যে ২০ জনের নাম তারা জানতে পেরেছেন তার মধ্যে মনিরের জীবনের প্রথম দিকে তার কর্মে সহযোগিতা করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একজন কাউন্সিলর। তাকে সবাই ‘সোনা’ কাউন্সিলর নামেই চিনেন। সূত্র জানায়, ওই কাউন্সিলর নব্বইয়ের দশকে বিমানবন্দর রেলস্টেশনে আইসক্রিম বিক্রি করতেন। পরে বিমানবন্দরে লাগেজ টানা পার্টির সদস্য হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। ঘটনাক্রমে নিউমার্কেট এলাকায় মনিরের সঙ্গে ওই কাউন্সিলরের পরিচয় হয়। এরপর মনিরও দোকানের কর্মচারী থেকে লাগেজ টানা পার্টির সদস্যের কাজ করা শুরু করেন। ওই কমিশনারের কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল জানতে পারেনি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে সে দলের তিনি সুবিধা গ্রহণ করেছেন। মনির গ্রেপ্তার হওয়ার পর ওই কাউন্সিলর গা-ঢাকা দিয়েছেন। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছেন যে, তিনি তাদের নজরদারিতেই আছেন। তিনি যাতে বিদেশে না পালাতে পারেন এজন্য সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সূত্র জানায়, মনিরের উত্থানের পেছনে আরেকজন কাউন্সিলরের নাম জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তিনি একটি মামলার আসামি। পুলিশ জানিয়েছে, তিনি এশিয়ার একটি দেশে পলাতক আছেন। সূত্র জানায়, মনিরের স্বর্ণ চোরাকারবারে ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন এসি’র সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তাকে সবাই ‘সোনা’ এসি বলে চেনেন। তিনি আগে পুলিশের একটি জোনে কর্মরত ছিলেন। সূত্র জানায়, শুরু থেকেই মনিরের সঙ্গে তার সখ্য ছিল। এর বিনিময়ে মনিরের কাছ থেকে পেয়েছেন অগাধ অর্থ। সূত্র জানায়, মনিরের সহযোগিতায় যমুনা নদীর ওপারের একটি জেলার জনপ্রতিনিধি আছেন। পাঁচ বছর আগে রাজধানীতে যে স্বর্ণ এবং বিদেশি অর্থ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছিল সেগুলোর মালিকানা ছিল ওই জনপ্রতিনিধির। উত্তরায় টাওয়ার নির্মাণে ওই জনপ্রতিনিধির শেয়ার রয়েছে বলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্র্তা জানতে পেরেছেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, মনিরের আরেক নেপথ্যে মদতদাতা হলেন- ঢাকার এক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তার এলাকা ক্রাইম জোন নামে খ্যাত। প্রায় সময় ওই এলাকায় খুনোখুনির ঘটনা ঘটে থাকে। তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন যে, মনিরের এলাকায় প্রভাব বিস্তার এবং ডিশ ব্যবসা, বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ এবং জমি দখলে তার হাত আছে। এতে ওই চেয়ারম্যানের পরে তিনি এলাকায় সর্বসেরা হিসেবে সবার কাছে বিবেচিত হতেন। তার অপরাধ কর্মকাণ্ড যাতে আইনের আওতায় না আসে এজন্য তিনি তাকে রাজনৈতিকভাবে সহযোগিতা দিয়ে থাকেন।