চিনিকল বন্ধের সিদ্ধান্তে মহাচিন্তায় শ্রমিক-কর্মচারী

0

এ বছর ১৫টি সরকারি চিনিকলের মধ্যে ছয়টিতে কোনো আখমাড়াই হবে না। এগুলো হলো রংপুর, শ্যামপুর, সেতাবগঞ্জ, পঞ্চগড়, পাবনা ও কুষ্টিয়া চিনিকল। কারখানাগুলোতে চিনি উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এসব মিলের আখ নিকটবর্তী চিনিকলগুলোতে মাড়াই করা হবে। রংপুর ও শ্যামপুর চিনিকলের আখমাড়াই হবে জয়পুরহাট চিনিকলে। সেতাবগঞ্জ ও পঞ্চগড় চিনিকলের আখমাড়াই হবে ঠাকুরগাঁও চিনিকলে। পাবনা চিনিকলের আখমাড়াই হবে নর্থ বেঙ্গল চিনিকলে এবং কুষ্টিয়া চিনিকলের আখমাড়াই করা হবে ফরিদপুর, মোবারকগঞ্জ ও কেরু অ্যান্ড কোম্পানিতে। বন্ধ হওয়া ছয়টি চিনিকলে ২ হাজার ৮৮৪ জন শ্রমিক কর্মচারী কর্মরত। তাদের কেউ চাকরি হারাবেন না। তাদের বদলি করা হবে চালু চিনিকলগুলোতে। এভাবে আগামী বছর ফরিদপুর ও রাজশাহী চিনিকল দুটিও বন্ধ করা হবে। আগামী ১১ ডিসেম্বর নর্থ বেঙ্গল, নাটোর ও রাজশাহী চিনিকলে এবং ১৮ ডিসেম্বর বাকি ছয়টি চিনিকলে এ বছর আখমাড়াই ও চিনি উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হবে।
সরকারের সব কটি চিনিকলে বর্তমান বাজারদরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে চিনি উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে গত ৫ বছরে ৩ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে চিনিশিল্প করপোরেশনকে। বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই লোকসানের পরিমাণ ছিল ৯৭০ কোটি টাকা। তা ছাড়া ৭ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা ঋণের বোঝাও রয়েছে চিনিশিল্প করপোরেশনের ওপর। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, গ্র্যাচুইটি, ভবিষ্যৎ তহবিল, আখের মূল্য ও ঠিকাদারদের বিল বাবদ বকেয়া পড়েছে প্রায় ৫৫২ কোটি টাকা। এসব সবই সত্য। কিন্তু পরিস্থিতি কেন এই পর্যায়ে গেল তা নিয়ে যৌক্তিক বিশ্লেষণ এবং সেসব নিরসনের পদপে না নিয়ে চিনিকলগুলো বন্ধের সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি চিনিকল বন্ধের কারণে উত্তরাঞ্চলে আখের আবাদ একেবারে উঠে যাবে, যার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া পড়বে ওই অঞ্চলের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপরও। আখ একটি প্রচণ্ড আঘাতসহিষ্ণু উদ্ভিদ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব মোকাবিলায় এর সমতা অন্য ফসলের চেয়ে অনেক বেশি। খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসেও ফসলটি কৃষককে একেবারে বঞ্চিত করে না। ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় যখন উত্তরাঞ্চলে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও ফসলের মাঠ তলিয়ে গিয়েছিল, কৃষকের বাঁচার কোনো উপায় ছিল না তখন বন্যার ঘোলাজলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল আখ। বন্যার পর এই আখ বিক্রি করেই উত্তরাঞ্চলের কৃষক তাদের বাড়িঘর মেরামত করেন, সার, বীজ ও কীটনাশক ক্রয় করে পরবর্তী রবি ফসলের চাষের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ান এসব কথা ভুলে গেলে চলবে না। আখ একটি পরিবেশবান্ধব উদ্ভিদ। বায়ুমণ্ডল থেকে অধিক পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে বাতাসের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে এ ফসলটির রয়েছে বিরাট ভূমিকা। আখের মোথা ও ছোবড়া গ্রামাঞ্চলে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আখ চাষ উঠে গেলে উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি কাঠের জন্য প্রচুর পরিমাণে বৃ নিধন হবে, যা অঞ্চলটির মরুময়তাকেই ত্বরান্বিত করবে।
স্বাধীনতার ৪৯ বছরে একটি চিনিকলকেও আধুনিকায়ন করা হয়নি। পণ্য বহুমুখীকরণের কোনো কার্যকর পদপে নেওয়া হয়নি। সুগারবিট থেকে চিনি উৎপাদন, কো-জেনারেশনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং র-সুগার থেকে রিফাইন চিনি উৎপাদনের মতো প্রকল্পগুলো এখনো আলোর মুখ দেখেনি। বাংলাদেশে সুগারবিট থেকে চিনি উৎপাদন কোনোকালেই সফল হবে না। তারপরও ঠাকুরগাঁও সুগার মিলে সুগারবিটভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণের কোনো অর্থ হয় না। ভারতে দৈনিক ১৫০০ টন মাড়াই মতাসম্পন্ন চিনিকল যেখানে চালানো হয় ৩০০ থেকে ৪০০ লোকবল দিয়ে, বাংলাদেশে একই মাড়াই মতাসম্পন্ন মিল চালানো হয় হাজার-বারশো কর্মচারী দিয়ে। তাহলে কীভাবে লাভজনক হবে চিনিশিল্প?
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে গরিব কৃষক ও মেহনতি শ্রমিকদের ভূমিকাই ছিল প্রধান। স্বাধীনতাযুদ্ধ ছাড়াও ১৯৫৪ সালের যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচন, ৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচনে দেশের মিল-কারখানার শ্রমিকরাই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তারাই মিছিল-সেøাগানের মাধ্যমে প্রকম্পিত করে রাখে রাজপথ। ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে শরিক হয়ে এই শ্রমিক-মজদুররাই জেলের তালা ভেঙে বাঙালির আশা-ভরসার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু কৃষক ও শ্রমিকদের ভীষণ ভালোবাসতেন। তাদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করেই তিনি ১৯৭২ সালে দেশের সব চিনিকলকে জাতীয়করণ করেন। দুঃখের বিষয়, সেই মহান নেতার জন্মশতবার্ষিকীতেই চিনিকলগুলো বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হলো। কৃষক ও শ্রমিকের স্বার্থ বিঘিœত হলো। তাদের জীবনে দেখা দিল চরম অনিশ্চয়তা।