চাল আমদানির আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত

0

ধানের উৎপাদন খরচের সাথে সঙ্গতি রেখে মিলারদের কাছ থেকে যথযথ মূল্য পাচ্ছে না কৃষক। দীর্ঘদিন ধরেই দেশের কৃষকরা এহেন বাস্তবতার মুখোমুখী। ধানের বাম্পার ফলন হলেও কৃষকের মুখে হাসি ফোটে না। ক্রমাগত লোকসান দিতে দিতে অনেক কৃষক ধানচাষের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এটা অনেক বড় হুমকি। কৃষি জমি হ্রাসের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জয়ী হয়েছেন এদেশের কৃষকরা। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণ। কৃষিবান্ধব নীতিমালার আলোকে এ নিয়ে সরকারের কৃতিত্ব জাহিরের সুযোগ হয়তো আছে, তবে ধানের ভরা মওসুমে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মনপ্রতি ৭০০ টাকা খরচ করে ধান উৎপাদন করে ৬০০ টাকায় ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা। যেখানে শিল্পখাতের বিভিন্ন সেক্টরে রফতানি খাতে সরকার শত শত কোটি টাকা প্রণোদনা দিচ্ছে, সেখানে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার অগ্রসৈনিক কৃষকরা লোকসান দিতে দিতে নি:স্ব হয়ে গেলেও ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায় না। উপরন্তু মধ্যস্বত্বভোগীদের সুবিধা করে দিতে ভরা মওসুমে চাল আমদানির সুযোগ অবারিত রেখে ধানের মূল্যে ধস নামিয়ে কৃষকদের ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
অনুকূল আবহাওয়ায় ধান উৎপাদনের ফলে দেশে আপতত কোনো খাদ্য সংকটের আশংকা না থাকলেও সরকার কয়েক লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। গত কয়েক মাস ধরে এই বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা হলেও এখন তা বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই ডিসেম্বরেই যখন বিদেশ থেকে চাল আমদানি শুরু হচ্ছে, তখন দেশের বিভিন্ন স্থানে আমন ধান উঠতে শুরু করবে। চাল আমদানির এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কারণে দেশের কৃষকরা নিশ্চিতভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ বিষয়ে দেশের অর্থনীতিবিদ ও কৃষক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের মতে, এ সময়ে সরকারের চাল আমদানির সিদ্ধান্তের সাথে বাস্তবতা বা কৃষকের স্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। এর ফলে শুধুমাত্র মধ্যস্বত্বভোগীরাই লাভবান হবে। লোকসান দিয়ে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হবেন কৃষকরা। সরকার সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ধান কেনার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেও এর সুফল পাচ্ছে মূলত মিলাররা। সাধারণ কৃষকরা মিলারদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এমনকি সরকারের ধানচাল সংগ্রহ প্রকল্পও মিলারদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। দেশে খাদ্য চাহিদা এবং উৎপাদনের মধ্যে যে ভারসাম্য রয়েছে, তাতে সরকার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবী করতেই পারে। এ ক্ষেত্রে উৎপাদন অব্যাহত রাখার বাস্তবসম্মত উদ্যোগ ও নীতিমালার বাস্তবায়নই হচ্ছে সরকারের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে কৃষকের স্বার্থ ও খাদ্য নিরাপত্তার স্থায়ী ও নীতিগত সমাধানের বদলে মধ্যস্বত্বভোগী, আমদানিকারক ও মিলারদের স্বার্থ সংরক্ষণের তৎপরতা থেকে অবশ্যই সরে আসতে হবে। এ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্যের মূল্য নির্ধারণে সরকারের সংশ্লিষ্টদের নিয়ন্ত্রণ নেই। লোকসান দিয়ে কৃষকদের ধান বিক্রি করতে বাধ্য করা হলেও সারাবছর যথেচ্ছভাবে চালের মূল্যবৃদ্ধির কারসাজি চলতে থাকে। চলতি আমন মওসুমে সরকার ৩৭ টাকা কেজি দরে ৬-৭ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও মিলারদের কাছ থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ৭২ হাজার টনের প্রতিশ্রæতি পাওয়া গেছে বলে জানা যায়। সরকারি ধান-চাল কেনায় অহেতুক সময় ক্ষেপণ একটি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে মিলাররাও কৃষকদের কাছ থেকে নির্ধারিত মূল্যে ধান কেনার ক্ষেত্রে সময় ক্ষেপণের মধ্য দিয়ে মূলত তারা কৃষকদেরকে লোকসান দিয়ে ধান বিক্রি করতে বাধ্য করে থাকে। অধিকাংশ কৃষক অতি দরিদ্র হওয়ায় ঋণ বা কর্জ করে তাদের ধানের উৎপাদন খরচ যোগাড় করতে হয়। এদের অধিকাংশেরই বাড়িতে ধান সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তারা লোকসান দিয়ে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়। দেশে যখন ধান-চালের যথেষ্ট উৎপাদন হচ্ছে এবং মজুদ পর্যাপ্ত থাকছে, তখন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটা কৃষককে বঞ্চিত ও হতাশার দিকে ঠেলে দেয়ার পদক্ষেপ ছাড়া কিছু নয়। এ বিষয়টি সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। আমদানিকারক, মিলার ও মধ্যস্বত্ব ভোগীদের স্বার্থে নয়, দেশের কৃষক ও ভোক্তাদের স্বার্থেই সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকারি ধান-চাল ক্রয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। মিলারদের কাছ থেকে নয়, ধান কিনতে হবে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে।