লাভ কম, বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন মালিকরা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ঢাকার জনপ্রিয় বাস রুটগুলোর একটি মতিঝিল-আব্দুল্লাহপুর। কম-বেশি ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ পথ পাড়ি দিতে লেগে যায় প্রায় আড়াই ঘণ্টা। আপ-ডাউন ট্রিপে অন্তত ৬ ঘণ্টা সময় লাগে। এমন বাস্তবতায় দিনে তিনটির বেশি আপ-ডাউন ট্রিপ দেয়া কঠিন। অথচ জ্বালানি তেল, চালক-হেলপারের বেতন, গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়সহ তুলে মালিককে ‘কাঙ্ক্ষিত লাভ’ গুনতে হলে অন্তত পাঁচটি আপ-ডাউন ট্রিপের দরকার হয়, যা ঢাকার তীব্র যানজটের কারণে বেশির ভাগ দিনই সম্ভব হয়ে ওঠে না। মতিঝিল-আব্দুল্লাহপুরের মতো ঢাকার সব রাস্তা ও বাসের রুটে যানজট প্রতিদিনকার চিত্র।
লাভ কম হওয়ায় ঢাকার রাস্তায় নতুন বাস নামাতে আগ্রহী হন না মালিকরা। এর বদলে চালানো হয় পুরনো বাস, যেগুলোতে বিনিয়োগ করা অর্থ এরই মধ্যে উঠে এসেছে। বর্তমানে ঠিক কী পরিমাণ পাবলিক বাস ঢাকায় চলাচল করে, তার সঠিক হিসাব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে নেই। সংস্থাটির হিসাবে, ঢাকায় নিবন্ধিত মিনিবাসের সংখ্যা সাড়ে নয় হাজারের বেশি। তবে পরিবহন মালিকরা বলছেন, ঢাকায় বর্তমানে প্রতিদিন সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজারের মতো বাস চলাচল করে। রাজধানীর রাস্তায় চলাচল করা সিংহভাগ বাসেরই আয়ুষ্কাল শেষ বা শেষের দিকে। সরকারি কোম্পানি বিআরটিসি বাদে ঢাকার রাস্তায় নতুন বাস চলছে, এমন দৃশ্য বিরল।
সারা দেশে বাস ব্যবসা যখন ‘বেশ লাভজনক’, তখন রাজধানী ঢাকায় বাস চালিয়ে লোকসান হওয়ার কথা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন মালিকরা। ঢাকার অভ্যন্তরীণ রুটে বাস ব্যবসা যে লাভজনক নয়, তা উঠে এসে একাধিক গবেষণায়ও। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) গবেষণা বলছে, বর্তমানে ৩০ শতাংশ লোকসানে চলছে ঢাকার বাস ব্যবসা। এর একমাত্র কারণ যানজট। যানজটের কারণে একদিকে যেমন প্রয়োজনীয়সংখ্যক ট্রিপ পরিচালনা করতে পারেন না চালকরা, তেমনি ব্যবহার হয় অতিরিক্ত জ্বালানি।
অলাভজনক হওয়ায় ঢাকায় বাসে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নন বাস মালিকরা। দেশের বিভিন্ন দূরপাল্লা ও আন্তঃজেলা রুটে যেখানে নতুন মডেল আর আধুনিক সুযোগ-সুবিধার একের পর এক বাস নামছে, সেখানে ঢাকার রাস্তায় চলছে সব ‘লক্কড়-ঝক্কড়’, ‘মুড়ির টিন’ মার্কা বাস। অলাভজনক হওয়ায় ঢাকার পাবলিক বাস ব্যবসার খাতটিতে নতুন বিনিয়োগ তো আসছেই না, উল্টো ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন অনেক মালিক। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকা মেট্রো এলাকায় মাত্র ১১০টি বাস নিবন্ধন দিয়েছে বিআরটিএ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিবন্ধন নেয়া এসব মিনিবাসের সিংহভাগই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের পরিবহনের জন্য কিনেছে। বিপরীতে একই সময়ে আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার রুটে চলাচল করা ১ হাজার ৬৭৯টি বাস নিবন্ধন দিয়েছে বিআরটিএ।
পরিবহন মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক দশকে রংধনু, পূবালী, মাইলাইন, তাশিকো, শক্তি, ব্লু-বার্ড, কপোতাক্ষ, ওয়ান লাইন, এরভিন, মধুমতি, কর্ণফুলী, গ্রেটওয়াল, পিংক সিটি, রাহবার, পাঞ্জেরীর মতো অনেক বাস কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। টিকে থাকা কোম্পানিগুলোও বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ। ঢাকায় বাস পরিচালনা করে লাভের বদলে লোকসান হয়। লোকসান হলে বর্তমান কোম্পানিগুলো তাহলে কীভাবে চলছে, জানতে চাইলে খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, লোকসানের কারণে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। অনেক কোম্পানি বন্ধও হয়ে গেছে। এখন যেসব কোম্পানি রয়েছে, সেগুলো অনেকটা বাধ্য হয়ে টিকে থাকার প্রয়োজনে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
তবে লোকসান গুনেও কীভাবে ঢাকায় বাস পরিচালনা স্বাভাবিক রয়েছে, তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেনটি এ পরিবহন মালিক নেতা। অন্যদিকে বুয়েটের ‘বিজনেস মডেল ফর বাস অপারেশন ইন ঢাকা সিটি আন্ডার প্রপোজড বিআরটি সিস্টেম সিনারিও’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার রাস্তায় এমন বাস নামানো হয়, যেগুলোর বিনিয়োগ খরচ এরই মধ্যে উঠে এসেছে। পুরনো হয়ে যাওয়ায় এসব বাসের রক্ষণাবেক্ষণও মালিকরা ঠিকমতো করেন না। চালক ও শ্রমিকদের মজুরির ঝামেলায় না গিয়ে তাদের কাছে চুক্তিতে বাস চালাতে দেন। অলাভজনক হওয়া সত্ত্বেও ঢাকার বাস ব্যবস্থাটি টিকে থাকার পেছনে এসব কারণকেই তুলে ধরা হয়েছে এ গবেষণায়। এতে আরো বলা হয়েছে, সেক্টরটি সম্পর্কে ভালোমতো না জেনে অনেকেই নতুন বাস কিনে বিনিয়োগ করেন, যাদের বেশির ভাগই লোকসানে পড়ে যান।
ঢাকায় বাস পরিচালনার ব্যয়গুলো মোটা দাগে তিন ধরনের। প্রথমটি রানিং কস্ট। জ্বালানি তেল, চালক, চালকের সহকারীর বেতন এ রানিং কস্টের মধ্যে পড়ে। দ্বিতীয়টি হলো মেইনটেন্যান্স কস্ট, যার মাধ্যমে নির্বাহ করা হয় বাসের যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়। তৃতীয়টিকে বলা হয় ফিক্সড কস্ট। গ্যারেজ বা ডিপোর ভাড়া, বাসের ইন্স্যুরেন্স, ফিটনেস হালনাগাদকরণ, রুট পারমিটের মতো খরচগুলো মাসিক বা বার্ষিক হারে প্রদান করতে হয়। আবার বাস কিনতে এককালীন মোটা অংকের বিনিয়োগ করেন মালিক। লোকসানের কারণে ঢাকার রাস্তায় নতুন বাস সচরাচর নামান না মালিকরা।
ঢাকায় সচরাচর বাস পরিচালিত হয় কোম্পানির মাধ্যমে। বিআরটিএর আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি (আরটিসি) ঢাকায় ৬০টি কোম্পানিকে কার্যক্রম চালানোর অনুমোদন দিয়েছে। তবে বাস্তবে ঢাকায় বাস কোম্পানির সংখ্যা এর কয়েক গুণ বেশি। কোম্পানিভিত্তিক বাস পরিচালনার ক্ষেত্রে চারটি পদ্ধতির কথা জানিয়েছেন মালিকরা। এর প্রথমটি হলো কোম্পানির সব বাসের মালিক কোম্পানি নিজেই। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে কোম্পানি কিছু বাসের মালিক; কিছু বাস ভাড়ায় নেয়া, যা কোম্পানির ব্যানারে চলে। তৃতীয়টিতে ছোট ছোট মালিকরা কোনো কোম্পানির নামে বাস পরিচালনা করেন, নাম ব্যবহারের জন্য কোম্পানি প্রয়োজনীয় সার্ভিস চার্জ পায়। চতুর্থ পদ্ধতিতে একক মালিকরা কোনো কোম্পানির কাছ থেকে বাস পরিচালনার শিডিউল কিনে নেন।
তবে পদ্ধতি যা-ই হোক, লোকসান এড়াতে মালিক কিংবা কোম্পানি কেউই বাস পরিচালনার ভার সরাসরি নিজের হাতে রাখে না বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ঢাকার পাবলিক বাসগুলো মূলত পরিচালনা করেন চালক ও সুপারভাইজার। এজন্য একেকটি বাসের জন্য তাদের দিতে হয় প্রতিদিন কম-বেশি ৩ হাজার টাকা। মালিককে ৩ হাজার টাকা দিয়ে, জ্বালানি তেল, স্টাফদের বেতন, পুলিশ, প্রভাবশালীদের চাঁদা দেয়ার পর প্রতিদিন যা অতিরিক্ত থাকে, তাই ইজারা নেয়া চালক বা সুপারভাইজারের দিনের আয়।
ঢাকার অলাভজনক বাস ব্যবস্থাকে লাভজনক করে তুলতে বাস ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করছেন বিশেষজ্ঞরা। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সালেহউদ্দিনের মতে, এর সবচেয়ে ভালো সমাধান হতে পারে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি। সরকার এরই মধ্যে এর উদ্যোগও নিয়েছে। কোম্পানিভিত্তিক বাস প্রবর্তন হলে মালিকরা যেমন লাভবান হবেন, তেমন যাত্রীরাও পাবেন উন্নত পরিবহন সেবা।