স্বর্ণের দরপতন বেশি দিন স্থায়ী নাও হতে পারে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ করোনা মহামারীর কারণে স্বর্ণের বাজারে টানা চাঙ্গা ভাব বজায় ছিল। সম্প্রতি মূল্যবান ধাতুটির দামে বড় পতন দেখেছে বিশ্ববাসী। সোমবার আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম কমে চার মাসের সর্বনিম্নে নেমেছে। মূলত নভেল করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিয়ে ওষুধ কোম্পানিগুলোর আশাবাদী খবরে মূল্যবান ধাতুটির এ দরপতন। তবে স্বর্ণের বাজারে বিদ্যমান দরপতন বেশি দিন স্থায়ী নাও হতে পারে। ফরাসি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান সোসিয়েতে জেনারেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বর্ণের বর্তমান দরপতন সাময়িক। ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) নাগাদ মূল্যবান ধাতুটির দাম বর্তমানের তুলনায় বেড়ে ইতিহাসের সর্বোচ্চ অবস্থানে উন্নীত হতে পারে।
সোমবার হঠাৎ করেই স্বর্ণের বাজারে বড় পতন দেখা দেয়। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের (ডব্লিউজিসি) ইনডেক্স অনুযায়ী, ওইদিন যুক্তরাষ্ট্রের স্পটমার্কেটে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ১ হাজার ৮৩৯ ডলার ৫৭ সেন্টে নেমে যায়, যা আগের দিনের তুলনায় ১ দশমিক ৬ শতাংশ কম। দিনের শুরুতে মূল্যবান ধাতুটির দাম ২ শতাংশ কমে গিয়েছিল। একই সময়ে ভবিষ্যতে সরবরাহ চুক্তিতে প্রতি আউন্স স্বর্ণ বিক্রি হয় ১ হাজার ৮৩৬ ডলার ২০ সেন্টে, যা আগের দিনের তুলনায় ১ দশমিক ৯ শতাংশ কম। চার মাসের মধ্যে এটাই মূল্যবান ধাতুটির সর্বনিম্ন দাম।
পরদিন মূল্যবান ধাতুটির দাম আরো কমে আউন্সপ্রতি ১ হাজার ৮০০ ডলারের কাছাকাছি নেমে এসেছে। ডব্লিউজিসির ইনডেক্স অনুযায়ী, এদিন যুক্তরাষ্ট্রের স্পটমার্কেটে প্রতি আউন্স স্বর্ণ ১ হাজার ৮০১ ডলার ১৫ সেন্টে বিক্রি হয়েছে। তবে গতকাল মূল্যবান ধাতুটির স্পটমূল্য ছিল আউন্সপ্রতি ১ হাজার ৮০৭ ডলার।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নভেল করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিতে উল্লেখযোগ্য অর্জন স্বর্ণের দাম কমিয়ে দিয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে মডার্না, ফাইজারসহ কয়েকটি ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে সুখবর শুনিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ভ্যাকসিনের জরুরি ট্রায়ালের অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে ঘোষণা দিয়েছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিও। বিশ্বজুড়ে যখন করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত লেগেছে, তখন ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিয়ে আশার আলো স্বর্ণের দামে ঋণাত্মক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। এক ধাক্কায় মূল্যবান ধাতুটির দাম আউন্সপ্রতি ১ হাজার ৮০০ ডলারের কাছাকাছি নেমে এসেছে।
স্বর্ণের দামে বড় পতনের পর পরই সোসিয়েতে জেনারেলের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এ পতন সাময়িক। দীর্ঘমেয়াদে স্বর্ণের দাম কমতির দিকে নাও থাকতে পারে। বরং আগামী দিনগুলোয় মূল্যবান ধাতুটির বাজারে উল্টো চিত্র দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
প্রতিষ্ঠানটির পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ২ হাজার ৩৪০ ডলারে উন্নীত হতে পারে। ২০২০ সালে মূল্যবান ধাতুটির গড় দাম দাঁড়াতে পারে ২ হাজার ৫০ ডলারে। এমনটা সত্যি হলে সেটা হবে ইতিহাসে স্বর্ণের সর্বোচ্চ দাম। চলতি বছরই স্বর্ণের সর্বোচ্চ দাম প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী। করোনা মহামারীর মধ্যে বিনিয়োগকারীদের কাছে চাহিদা বেড়ে যাওয়ার জের ধরে গত আগস্টে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ২ হাজার ৭২ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এখন পর্যন্ত এটাই স্বর্ণের সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড।
সোসিয়েতে জেনারেল বলছে, স্বর্ণের দামে রেকর্ড ভাঙার বছর হতে পারে ২০২১ সাল। করোনা মহামারী, এর জের ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে সৃষ্টি হওয়া অনিশ্চয়তা, মন্দার আশঙ্কা, মার্কিন রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, চীন-ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা স্বর্ণের বাজার পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বমুখী করে তুলছে, যা আগামী বছর নাগাদ নতুন নতুন রেকর্ডের জন্ম দিতে পারে। তবে ২০২২ সালে গিয়ে মূল্যবান ধাতুটির দাম ফের আউন্সপ্রতি ১ হাজার ৮০০ ডলারের আশপাশে নেমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
অনেকটা একই কথা বলছে মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস। প্রতিষ্ঠানটির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল ঘোষণা হলেও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। ফলে বিনিয়োগকারীদের মনেও স্বস্তি ফেরেনি। এদিকে করোনা মহামারী পরিস্থিতির দিন দিন আরো অবনতি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ইউরোপ-এশিয়ার দেশগুলোয় সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা লেগেছে। প্রতিদিনই রেকর্ড পরিমাণ রোগী বাড়ছে। বাড়তির দিকে রয়েছে মৃত্যু। ফলে করোনা মহামারী বিশ্ব অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদি মন্দার ঝুঁকিতে ফেলেছে।
এ ঝুঁকি আগামী দিনগুলোতেও বিনিয়োগকারীদের স্বর্ণের প্রতি আগ্রহ ধরে রাখবে বলে মনে করছে গোল্ডম্যান স্যাকস। ফলে সহসাই স্বর্ণের দাম কমে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বরং মূল্যবান ধাতুটির দাম আরো বাড়তে পারে। ২০২১ সাল নাগাদ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের সম্ভাব্য দাম ২ হাজার ৩০০ ডলারে উঠতে পারে বলে পূর্বাভাস প্রতিষ্ঠানটির, যা বর্তমানের তুলনায় প্রায় ২২ শতাংশ বেশি। এর মধ্য দিয়ে ইতিহাসে স্বর্ণের সর্বোচ্চ দামে নতুন রেকর্ড হতে পারে।
গোল্ডম্যান স্যাকসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক মন্দার সময় দীর্ঘমেয়াদে স্বর্ণের বাজার চাঙ্গা থাকে। এর আগে ২০০৮ সালের মন্দার সময়ও একই চিত্র দেখা গেছে। এবার করোনার কারণে ২০২০ সালের শুরু থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে স্বর্ণের দাম বেড়েছে। এখন মূল্যবৃদ্ধির হার শ্লথ হয়ে এলেও তা দীর্ঘমেয়াদে বাড়তির পথেই থাকবে। এ কারণে ২০২১ সালে মূল্যবান ধাতুটির সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড ভাঙার প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
কিটকো নিউজ, রয়টার্স ও মাইনিংডটকম অবলম্বনে