চিরবিদায় ম্যারাডোনা

0

বিশ্ব ফুটবলে ম্যারাডোনার উত্থান এমন এক সময়ে, বিশ শতকের শেষভাগে যখন পুরো পৃথিবী কেবল বিশ্বায়নের এক নবযুগে প্রবেশ করছে। আজকের মতো অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো নয়ই, সেকালে টেলিভিশনও সবার কাছে সহজলভ্য ছিল না। ব্রাজিলের কালো মানিক ফুটবল সম্রাট পেলের খেলা টেলিভিশনে সরাসরি দেখার সৌভাগ্য বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের মানুষদের কজনেরই বা দেখার সুযোগ হয়েছে। ১৯৫৮, ’৬২ ও ’৭০ সালে ব্রাজিলের হয়ে পেলে যে তিনবার বিশ্বকাপ জিতেছেন সেসব খেলার কতটুকুই বা কতজন দেখেছেন। ফুটবল অঙ্গনে ম্যারাডোনার বিশ্ব তারকা হিসেবে আবির্ভাব মূলত ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে। ম্যারাডোনার জাদুকরী ফুটবলের মায়ায় মন্ত্রমুগ্ধ হওয়ার সেই বছরটি বাংলাদেশেও ইতিহাস হয়ে আছে কেননা সেবারই প্রথম বাংলাদেশের মানুষ রঙিন টেলিভিশনে বিশ্বকাপ দেখেছিল। সারা দুনিয়ার দর্শকদের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষও প্রত্য করেছিল একজন ফুটবলার কীভাবে একা কোনো দলকে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসরে জয় এনে দিতে পারেন। সেবার আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ডের কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচ আর আর্জেন্টিনাকে সেই ম্যাচ জেতানো ম্যারাডোনার বহুল বিতর্কিত গোলের কথা ফুটবলের ইতিহাসে অয় হয়ে আছে। ম্যারাডোনা নিজে এই গোলকে বলেছিলেন ‘ঈশ্বরের হাতের গোল’। এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, বাংলাদেশের মানুষের মনে বিশ্ব ফুটবলের প্রতি আগ্রহ আর ফুটবলপ্রেমের বীজটাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন ম্যারাডোনা। ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে গোটা বাংলাদেশেরই কায়মনো প্রার্থনা ছিল আর্জেন্টিনার জয়; তা যতটা না আর্জেন্টিনার জন্য, তার চেয়েও বেশি ম্যারাডোনার জন্য।
বিশ্ব ফুটবলে ম্যারাডোনার আসনটি কোথায় এ নিয়ে তার জীবদ্দশাতে বহু আলোচনা হয়েছে। বরং তার এই অকাল প্রয়াণে সম্ভবত এ নিয়ে বিতর্কের অবসান হলো। দীর্ঘ সময়জুড়ে ব্রাজিলের পেলে না আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা কে সর্বকালের সেরাদের সেরা এ নিয়েই চলেছে আলোচনা। সেই অর্থে বর্ষীয়ান পেলের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর চিরবিদায় ঘটল। দুনিয়ার মাঠে মুখোমুখি লড়াইয়ের সুযোগ হয়নি বলেই কি পেলে তার টুইটে লিখলেন ‘আমরা এক দিন স্বর্গে একসঙ্গে ফুটবল খেলব।’ এ তো গেল অগ্রজদের লড়াই। ম্যারাডোনার সন্তানতুল্য লিওনেল মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সঙ্গেও তার নাম জড়িয়েছে অনেকবার। তবে তা যতটা না নবীনদের সঙ্গে তুলনায় তার চেয়ে বেশি ম্যারাডোনা এই দুজনের কাকে বেশি এগিয়ে রাখেন সেই জিজ্ঞাসায়। হালের এ দুই সেরার হৃদয়ে এখন রক্ত ঝরছে। মেসি বলছেন ‘ম্যারাডোনা চিরন্তন, ম্যারাডোনার মৃত্যু নেই’ আর রোনালদো মনে করেন ‘ম্যারাডোনাকে কখনো ভোলা যাবে না’। ভোলা তো যাবেই না, সে কেবল আর্জেন্টিনা বা জাতীয় দলের খেলার বিবেচনাতেই নয়, বিশ্ব কাব ফুটবলের ইতিহাসেও। সাধারণ মানের এক কাব থেকে তুলে এনে ইতালীয় কাব নাপোলিকে প্রায় একাই লিগ চ্যাম্পিয়ন বানিয়েছিলেন তিনি। এ কারণেই নেপলসে ‘ম্যারাডোনা অনেকের কাছেই ধর্ম’। ম্যারাডোনা অনেক সময়ই ফুটবলকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। সেটা যেমন মাদক ও নারীর প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি আর বিতর্কিত জীবনযাপনে, তেমনি সমাজ-রাজনীতির আলোচনাতেও। তিনি এমন বিশ্ব তারকা যিনি যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলসহ পশ্চিমা বিশ্বশক্তির সরাসরি সমালোচনা করে বলতে পারেন ‘হৃদয় থেকে আমি একজন ফিলিস্তিনি।’ ২০১৮ সালে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে জড়িয়ে ধরে এ কথা বলার ভিডিও নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টেও পোস্ট করেছিলেন ম্যারাডোনা। কিছুদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘চিরোলিটা’ বা ব্যঙ্গাত্মক অর্থে ‘পুতুল’ বলে আখ্যা দিয়ে দেশটির ভিসাবঞ্চিত হন তিনি। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রকাশ্য সমালোচক আর লাতিন আমেরিকার কমিউনিস্ট আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন ম্যারাডোনা। ছিলেন ভেনেজুয়েলার বিপ্লবী নেতা হুগো শ্যাভেজের অনুসারী। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে পিতার মতো মান্য করতেন ম্যারাডোনা। প্রকৃতির কী অদ্ভুত খেয়াল ২৫ নভেম্বর, ফিদেলের চিরপ্রস্থানের দিনটিতেই চিরবিদায় নিলেন ম্যারাডোনা।