মনিরদের আলাদিনের চেরাগ প্রাপ্তির প্রেক্ষাপট ও দায়

0

কখনো জানা যায় কোনো রাজনৈতিক দলের অফিস সহকারী থেকে সংগঠনের নেতা বনে গেছেন আর তারপর ঠিকাদারি-মাদক-সন্ত্রাসের গডফাদার হয়ে গেছেন কেউ! কখনো জানা যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক থেকে দপ্তরটির অন্যতম মতাধর ব্যক্তি হয়ে উঠে শত শত কোটি টাকার সম্পদ ঢাকায় বিপুল সংখ্যক ফ্যাটের মালিক বনে গেছেন কেউ। আবার কখনো সামনে আসে এমন কর্মচারীর কথা যে মাসিক মাত্র ৩০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে ঢাকায় ১৪টি এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও ২৫টি বাড়ি ও প্লটের মালিক হয়েছেন, যার অস্ট্রেলিয়াতেও বাড়ি আছে আর কানাডাতেও ক্যাসিনো ব্যবসা আছে। বিগত বছরগুলোতেই সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় এমন বহুসংখ্যক ব্যক্তি ও ঘটনার কথা ছাপা হয়েছে।
দেশে কিছুদিন পর পরই আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ পাওয়ার মতো প্রায় অলৌকিক কায়দায় বিপুল অর্থ-বিত্ত-সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা অসম্ভব মতাধর মানুষদের কথা শোনা যায়। রাজনীতি, প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংকিং-আর্থিক খাত থেকে শুরু করে চিকিৎসাসেবা, পরিবহনসেবা কিংবা শিাঙ্গন বা বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় নেই রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া এমন আশ্চর্য মতাধর মানুষেরা?
এবার জানা গেল রাজউকে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে রাজধানীতেই শতাধিক প্লট ও বাড়িসহ বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও মতার মালিক বনে যাওয়া ‘গোল্ডেন মনিরের’ কথা। শনিবার র‌্যাবের অভিযানে তার বাড়ি থেকে অস্ত্র, মাদক এবং বিপুল পরিমাণ সোনা ও দেশি-বিদেশি মুদ্রাসহ গ্রেফতার হওয়ার পর মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরের নানা অবৈধ কর্মকান্ডের কথা জনসমে আসে। রবিবার দেশ রূপান্তরে ‘গোল্ডেন মনিরের কবজায় রাজউক-গণপূর্ত!’ শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির সিনেম্যাটিক কায়দায় একদল ব্যক্তিগত নিরাপত্তারী বেষ্টিত হয়ে গাড়িবহর হাঁকিয়ে রাজউকের মতো সরকারি দপ্তরগুলোতে যেতেন এবং সেখানকার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন। প্রভাবশালী এই ব্যক্তি রাজউকের পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে গণপূর্ত অধিদপ্তরও নিজের কবজায় নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন এবং অনেকটা সফলও হন। দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায় রাজউকের বাড্ডা প্রকল্পের পুনর্বাসন জোনের কমপে শতাধিক প্লট রয়েছে গোল্ডন মনিরের কবজায়। রাজউকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকার বাণিজ্যিক কাম আবাসিক এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন এই মনির। আর এসব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সংস্থাটির এনেক্স ভবনের ৫ তলার ৫১৪ নম্বর কটি ভাড়া নিয়ে নিজের অফিস হিসেবে চালাতেন। এমনকি মনিরের ফাইলপত্র দেখাশোনার জন্য রাজউকের কয়েকজন কর্মচারীও রয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে তৎকালীন রাজউক চেয়ারম্যান ড. সুলতান আহমেদের নেতৃত্বে গোল্ডেন মনিরের কথিত অফিসে অভিযানের সময় সেখান থেকে রাজউকের ৭১টি ফাইল জব্দ করা হয় যেগুলো আসলে সংস্থাটির নিজস্ব রেকর্ডরুমে থাকার কথা। কিন্তু মনির ও তার সহযোগীর বিরুদ্ধে পরদিনই মামলা হলেও মামলায় মনিরকে পলাতক দেখানো হয় এবং তার সহযোগী রাজউক কর্মচারী পারভেজকে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকায় রাজউক প্রকল্পটির শতাধিক প্লট দখল করেই ান্ত হননি মনির। নিজে ও নিকটাত্মীয়দের নামে নেওয়া এসব প্লটে ইমারত নির্মাণেও মানা হয়নি বিধিবিধান। আবাসিক প্লটে বাণিজ্যিক ভবন, ফার ও সেট-ব্যাক না মানা, নির্ধারিত তলা থেকে বেশি নির্মাণ করা, পার্কিংয়ের স্থলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ নানা অনিয়মও রয়েছে মনিরের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্লটগুলোতে। বারিধারা, প্রগতি সরণি ও বাড্ডা পুনর্বাসন জোনের অনেকগুলো প্লটেই বহুতল ভবন করেছেন মনির। গুলশান, উত্তরা দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্ব এবং পূর্বাচলেও মনিরের কমপে ২০টি প্লট রয়েছে। এছাড়া উত্তরায় ২০ কাঠা আয়তনের একটি প্লটে ১৪ তলার একটি বিশাল ভবনেরও মালিক মনির, যার বাজারমূল্য অন্তত ২০০ কোটি টাকা। নব্বইয়ের দশকে গাউছিয়া মার্কেটের কাপড়ের দোকানের বিক্রয়কর্মী ছিলেন মনির। এরপর মৌচাক মার্কেটে ক্রোকারিজের দোকানে চাকরি নিয়েছিলেন। সেখানে চাকরিচ্যুতির পর ঢাকার বিমানবন্দরকেন্দ্রিক লাগেজ পার্টি ও সোনার চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ে তিনি ‘গোল্ডেন মনির’ নামে পরিচিতি পান। এখন কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক তিনি। কিছুদিন আগে ক্যাসিনোকা- হিসেবে পরিচিতি লাভ করা বহুল আলোচিত ‘শুদ্ধি অভিযানে’ এমন অনেক মতাধর ব্যক্তির কথা জনসমে আলোচনায় আসে। চলমান করোনা মহামারীর মধ্যেও স্বাস্থ্য খাতসহ বিভিন্ন েেত্র মারাত্মক দুর্নীতি ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের কথা সামনে এসেছে। আর সবেেত্রই দেখা গেছে মতাসীন দল কিংবা প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ সবার সঙ্গেই ওঠাবসা কিংবা যোগসাজশ ছিল অভিযুক্তদের। প্রশ্ন হলো এমন দুর্বৃত্ত আর দুর্নীতিবাজদের ধরা হলেও মনির বা তাদের মতো দুর্বৃত্তদের উত্থানের দায় কে নেবে?