করোনাকালেও বেড়েছে অপরাধ

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ মহামারি করোনাকালেও বেড়েছে অপরাধ প্রবণতা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এলাকায় গত বছরের প্রথম আট মাসের চেয়ে চলতি বছরের প্রথম আট মাসে খুন, ধর্ষণ, নিপীড়ন ও অস্ত্র আইনে মামলা বেড়েছে। দেশে করোনার তাণ্ডব শুরু হওয়ার পর ২৬শে মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি বা লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। টানা ৬৬ দিন রাজধানী তথা সারা দেশের মানুষ ঘরেই অবস্থান করেছিল। এছাড়া মার্চ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মানুষ করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করেই দিন পার করছে। অথচ এই সময়গুলো অপরাধ প্রবণতা কমেনি। শুধু ডিএমপি নয়, সারা দেশের অপরাধ চিত্র একই। উদ্বেগজনকভাবে দেশজুড়ে নারী নিপীড়নের ঘটনা বেড়েছে। গত ৯ মাসে সারা দেশে শুধু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৭৫টি। নারী ধর্ষণ ও নিপীড়নের এসব ঘটনায় মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০১৯ সালের প্রথম আট মাসে ডিএমপিতে হত্যাকাণ্ড হয়েছে ১৪১টি। আর চলতি বছরে হয়েছে ১৪৬টি। অন্যদিকে গত বছরের প্রথম আট মাসে ডিএমপিতে ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩৫৩টি। চলতি বছরের একই সময়ে ধর্ষণ মামলা হয়েছে ৩১৪টি। গত বছরের প্রথম আট মাসে অস্ত্র আইনে মামলা হয়েছে ৭২টি। আর চলতি বছরের একই সময়ে মামলা হয়েছে ৮৫টি। গত বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৫৮টি। চলতি বছরে হয়েছে ২৫৯টি।
মাসওয়ারী পর্যলোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে খুনের ঘটনা ঘটেছে ১৯টি। ফেব্রুয়ারিতে ১৬টি, মার্চে ১২টি, এপ্রিলে ১২টি, মে মাসে ১৬টি, জুনে ১৯টি, জুলাইতে ৩৩টি ও আগস্টে ১৪টি। আর চলতি বছরের জানুয়ারিত খুন হয়েছে ২১টি, ফেব্রুয়ারিতেও ২১টি, মার্চে ১৭টি, এপ্রিলে ৮টি, মে মাসে ১৩টি, জুনে ১৯টি, জুলাইতে ২৭টি ও আগস্টে ২০টি। একইভাবে ২০১৯ সালে ডিএমপিতে ধর্ষণ মামলা হয়েছে ২৯টি, ফেব্রুয়ারিতে ৪১টি, মার্চে ৩৪টি, এপ্রিলে ৫২টি, মে মাসে ৫৪টি, জুনে ৫০টি, জুলাইতে ৪৩টি এবং আগস্টে ৫০টি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৪২টি, ফেব্রুয়ারিতে ৪৫টি, মার্চে ৪৬টি, এপ্রিলে ১২টি, মে মাসে ১৫টি, জুনে ৪৯টি, জুলাইতে ৫২টি ও আগস্টে ৫৩টি। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে ২৭টি, ফেব্রুয়ারিতে ২১টি, মার্চে ৩১টি, এপ্রিলে ৩১টি, মে মাসে ৩১টি, জুনে ৩৮টি, জুলাইতে ৪০টি ও আগস্টে ৩৯টি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে মামলা হয়েছে ৪৪টি, ফেব্রুয়ারিতে ২৯টি, মার্চে ৩৫টি, এপ্রিলে ১২টি, মে মাসে ২১টি, জুনে ৪৭টি, জুলাইতে ৩২টি ও আগস্টে ৩৯টি। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে অস্ত্র আইনে মামলা হয়েছে ৬টি, ফেব্রুয়ারিতে ১০টি, মার্চে ১৫টি, এপ্রিলে ১২টি, মে মাসে ১১টি, জুনে ৮টি, জুলাইতে ১৪টি ও আগস্টে ৬টি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে মামলা হয়েছে ১৩টি, ফেব্রুয়ারিতে ১২টি, মার্চে ১৫টি, এপ্রিলে ২টি, মে মাসে ৮টি, জুনে ১১টি, জুলাইতে ১৬টি ও আগস্টে ৮টি।
২০১৯ সালের প্রথম আট মাসে ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, নারী আহত ছাড়া অন্যান্য নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৮৮৯টি। চলতি বছরের একই সময়ে মামলা হয়েছে ৭০৯টি। এরমধ্যে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে মামলা হয়েছে ৫৯টি, ফেব্রুয়ারিতে ৮৪টি, মার্চে ১০৫টি, এপ্রিলে ১৩১টি, মে মাসে ১২৬টি, জুনে ১৪৬টি, জুলাইয়ে ১২২টি ও আগস্টে ১১৬টি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে হয়েছে ৮৬টি, ফেব্রুয়ারিতে ১১৭টি, মার্চে ১০৩টি, এপ্রিলে ২৩টি, মে সাসে ৩১টি, জুন মাসে ৮৮টি, জুলাইতে ১৩১টি ও আগস্টে ১৩০টি। এদিকে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র সারা দেশের অপরাধপ্রবণতা একটি চিত্র তুলে ধরেছে। সেখানে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৭৫ জন নারী। এরমধ্যে একক ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৬২ জন এবং গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০৮ নারী। এছাড়া ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৩ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ১২ নারী। সংগঠনটি আরো জানায়, গত ৯ মাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৬১ নারী। এর মধ্যে যৌন হয়রানীর কারণে ১২ নারী আত্মহত্যা করেছেন। আর যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ নারী এবং ৯ পুরুষ নিহত হয়েছেন। আসক জানায়, এ সময়কালে দেশে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যা, পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপসহ নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। তবে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনার সংখ্যা ও এর ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সংগঠনটি আরো জানায়, গত ৯ মাসে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৩২ নারী। এর মধ্যে হত্যার শিকার হন ২৭৯ নারী এবং পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৭৪ নারী। যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ১৬৮ নারী। এর মধ্যে যৌতুকের কারণে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৭৩ জন। যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৬৬ জনকে এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১৭ জন নারী। এছাড়া স্বামীর গৃহ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন ১২ নারী। এ সময়ের মধ্যে ১১ জন গৃহকর্মী হত্যার শিকার হন এবং ৩২ জন গৃহকর্মী বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এছাড়া ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ২ জন। এছাড়া এ সময়কালে এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ২১ নারী। শিশু নির্যাতন ও হত্যার গত ৯ মাসের পরিসংখ্যানও অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ সময়কালে ১০৭৮ শিশু শারীরিক নির্যাতনসহ নানা সহিংসতার শিকারসহ হত্যার শিকার হয়েছে ৪৪৫ শিশু। এছাড়া ৬২৭ শিশু ধর্ষণ ও ২০টি বলাৎকারের ঘটনা ঘটেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ও তথাকথিত ‘ক্রসফায়ারে’ মোট ২১৬ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে ‘ক্রসফায়ার’/বন্দুকযুদ্ধ/গুলিবিনিময়/এনকাউন্টারে নিহত হন ১৮৫ জন। এ সময়কালে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা যান ২৭ জন। এই ৯ মাসে দেশের কারাগারগুলোতে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা যান ৫৮ জন। এর মধ্যে কয়েদি ২৪ জন এবং হাজতি ৩৪ জন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুমের শিকার হন ৪ জন। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৩ জনকে গেপ্তার দেখানো হয়েছে। এখনও পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন ১ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত হিন্দু সমপ্রদায়ের ৪৭টি প্রতিমা ভাঙচুর, মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ৪২ জন। এছাড়া আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ১টি বসতঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ সময়কালে পেশাগত কাজ করতে গিয়ে ২০৯ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। একই সময়ে ভারত সীমান্তে নিহত হয়েছেন ৩৯ জন। এর মধ্যে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ-এর গুলিতে ৩২ জন এবং শারীরিক নির্যাতনে ৬ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ১৮ জন এবং অপহরণের শিকার হয়েছেন ২০ জন। এ সময়কালে গণপিটুনির ঘটনায় মারা গেছেন মোট ৩০ জন।
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, ধারণা করা হয়েছিল করোনাকালে মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি বা সমাজ ব্যবস্থা যেভাবে হুমকির মুখে পড়ছে এতেকরে হয়তো অপরাধীদের আচরণে একটা পরিবর্তন আসবে। কিন্তু ধীরে ধীরে করোনার সঙ্গে অপরাধীদের সহনশীলতা, সামঞ্জস্যতা যখন হয়ে যায় তখন সে পূর্বের আচরণে ফিরে এসেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়েও গিয়েছে। করোনাকালে মানুষের অলস সময়, আর্থিক সংকটের কারণে দীর্ঘ মেয়াদি চাপ তৈরি হয়। আর যেকোনো সংকটের সময় নির্ভরশীল জনগণের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। পুরুষতন্ত্রের কারণে নারীদের ওপর নির্যাতন নিপীড়ন বাড়ছে। তিনি বলেন, অপরাধ শুধু বাংলাদেশে নয়, দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও বেড়েছে। জীবনকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেয় এমন পরিস্থিতিতে মানুষ অনেক সময় জীবনের ভয়ে তার খারাপ আচরণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। আবার ভয় কেটে গেলে সেগুলো কোনো ভূমিকা রাখে না। মানুষ যে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বড় হয় সেই অভিজ্ঞতাগুলোই তাকে অপরাধ করতে প্রলুব্ধ করে। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অভাববোধ। যদি তার অথনৈতিক অভাব থাকে তবে তার সবগুলো অপরাধই হবে অর্থকেন্দ্রিক। যার যৌন নিপীড়নের আগ্রহ রয়েছে সে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতনসহ এই ধরনের অপরাধগুলোই বেশি করবে। অপরাধ বিজ্ঞানের মতে মানুষের মধ্যে যদি অভাব বা তাড়না থাকে তবেই সে অপরাধ করে। অভাববোধটা একেক জনের কাছে একেক রকম। তিনি বলেন, আমাদের দেশে দীর্ঘদিনের পরিকল্পিত অপরাধের চেয়ে আকর্ষিক অপরাধের সংখ্যা বেশিই। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সরকার যদি একটি বছরের অপরাধের পরিসংখ্যানের সঙ্গে আরেকটি বছরের অপরাধের বিশ্লেষণ করে যদি কখনও স্বস্তি অথবা কখনও উদ্বেগ দেখায় তবে আমি মনে করি এটা পুরোটাই ভুল হবে। কারণ আমি মনে করি, আমরাতো এখনও দেশের মানুষকে তৈরিই করতে পারি নাই। যেখানে তৈরিই করতে পারি নাই সেখানেতো অপরাধ প্রবণতা থাকবে।