‘শাস্তি দেখে না’ অধিকাংশ মানবপাচারের মামলা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ বেশ কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে ইউরোপে অভিবাসন প্রত্যাশীদের নৌযান ডুবিতে উদ্ধার লাশের সারিতে বাংলাদেশিদের নাম থাকছে, কারাবন্দি অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে থাকছেন এদেশের মানুষ। এরপরেও যারা এভাবে পাচার করে মানুষকে জীবন সংকটে ফেলছে তাদের অধিকাংশের শাস্তি হচ্ছে না। সম্প্রতি লিবিয়ায় মানবপাচারকারীদের হাতে ২৬ বাংলাদেশি নিহতের ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোচিত হওয়ার পর বাংলাদেশে পাচারে জড়িতদের ধরতে পুলিশের তৎপরতা জোরদার হয়েছে। দুই ডজন মামলায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কিন্তু পুরনো বহু মামলা বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকায় অধিকাংশ আসামিকে শেষ পর্যন্ত সাজার মুখোমুখি করা যায়নি।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে মানব পাচারের ঘটনায় দায়ের হওয়া ৬ হাজার ১৩৪টি মামলার মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশের নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে ২৯ শতাংশ মামলায় আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হয়েছে। আসামিদের মধ্যে শাস্তি হয়েছে মাত্র ১৯ শতাংশের। এর কারণ হিসেবে মামলা তদন্ত ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতা এবং ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে পাচারকারীদের আপস রফার কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। এ নিয়ে হতাশ মানব পাচারের মামলায় বাদী ও ভিকটিমের আইনজীবী হিসাবে নিয়মিত কাজ করা ফাহমিদা আক্তার। তিনি বলেন, “আপস শুধু বাদীর আগ্রহে হয় না। বিচারে দীর্ঘসূত্রতায় হতাশা এবং প্রভাবশালী বিত্তশালীদের দেওয়া চাপ ও হুমকি আপসের বড় কারণ হিসাবে কাজ করে। যে কারণে এসব মামলার আসামিরা খালাস পেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে পরবর্তী পাচারের জাল বিস্তারে নেমে পড়ে।” তার মতে, সময় মত বিচার শেষ করা গেলে, মামলা আমলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনে নির্ধারিত সময় অথাৎ ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার করা গেলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। এ বিষয়ে ফৌজদারি মামলার বিচারে বিশেষজ্ঞ আইনজীবী মো. বোরহান উদ্দিন বলেন, কোনো পাচার মামলার বিচার আইনসম্মত ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ হওয়ার নজির ঢাকার কোনো আদালতে নেই। “আইনে ১৮০ দিনের বিধান ম্যানডেটোরি নয়, বরং ডাইরেকটরি। আর এই সুযোগ নিচ্ছেন আমাদের রাষ্ট্রপরে আইনজীবী, প্রসিকিউশন পুলিশ ও বিচারকগণ।” এ আইনে বেঁধে দেওয়া ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার বিষয়টিও অধিকাংশ েেত্র মানা হয় না বলে জানিয়েছেন আরেক বিশেষজ্ঞ আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো। কয়েক মাস আগে মানব পাচার প্রতিরোধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এসব মামলার বিচার হচ্ছিল। আদালত সংশ্লিষ্টরা জানান, বেশিরভাগ েেত্রই আসামিদের বিরুদ্ধে পুলিশি তদন্তে অনিয়ম-অমনোযোগিতার সঙ্গে সঙ্গে স্যা দিতে আদালতে আসায় অনীহা, আদালত কমর্চারীদের সাীর নোটিস সঠিক স্থানে ঠিকানায় পাঠানোতে ব্যথর্তা, রাষ্ট্রপরে আইনজীবীর পেশাগত সমতার
দীর্ঘসূত্রতায় পার পেয়ে যায় আসামি
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপ মহা পরিদর্শক (স্পেশাল ক্রাইম) রেজাউল করিম জানান, ২০০৪ সালের ১৫ জুন থেকে থেকে ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে ১১ হাজার ৪৬০ জনকে পাচারের ঘটনায় ৬ হাজার ১৩৪টি মানব পাচার মামলা হয়। এসব মামলায় আসামি ছিল মোট ২৪ হাজার ৫০৪ জন। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মোট ১০ হাজার ৯২৮ জন গ্রেফতার হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। এসব মামলার মধ্যে এ পর্যন্ত ৮০৪টির নিষ্পত্তি হয়েছে। তার মধ্যে ২৩৩টি মামলার বিচার কার্যক্রম শেষে মোট ৪০৯ জন আসামি দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। বাকি ৫৭১টি মামলায় ১ হাজার ৬৯৯ আসামি খালাস পেয়ে গেছেন ওই ২৩৩টি মামলায় মোট ৮ জনের মৃত্যুদণ্ড, ২৯৯ জনের যাবজ্জীবন এবং ১০২ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে বলে জানান রেজাউল করিম। এদিকে বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময়ের ফেরে অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়ার বহু নজির রয়েছে। ঢাকার ৫ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে খালাসের রায় হওয়া একটি মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ২০০৬ সালের ১৭ নভেম্বর বিকাল ৩টায় গালফ এয়ারলাইন্সের একটি ফাইটে করে চাকরি করার জন্য দালাল ও ট্রাভেল এজেন্সির ভুয়া ও জাল ম্যানপাওয়ার ছাড়পত্র নিয়ে ৩১ জন নারীকে লেবাননে পাঠানোর সময় বিষয়টি ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার মীর মোদাছ্ছির হোসেন ধরে ফেলেন। পরে ওই ৩১ নারীর মৌখিক অভিযোগোর ভিত্তিতে ইমিগ্রেশন পুলিশের পরিদর্শক কাজী মো. বজলে মাওলা বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় ৩৮ জনকে আসামি করে ফকিরাপুলের ১১৬/১১৭ ডিআইটি এক্সটেনশন রোডের উইন ইন্টারন্যাশনালের মালিক আবদুল হাই মিলন, রিক্রুটিং এজেন্সি গাজীপুর এয়ার ইন্টারন্যাশনালের মালিক ফেরদৌস আহমেদ বাদলসহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও নারী পাচারের অভিযোগে মামলা করেন। রাষ্ট্রপ ও আসামিপরে আইনজীবীরা জানান, এ মামলায় প্রথমে এজাহারে উল্লেখিত ও অনুল্লেখিত (এজাহার দায়েরের পরে গ্রেপ্তার) ৩৭ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। পরে বর্ধিত তদন্তে আরও পাঁচজনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। আট বছরেরও বেশি সময় ঝুলে থাকার পর স্যা প্রমাণের অভাবে এ মামলার রায়ে প্রায় সব আসামি খোলাস পেয়ে যান।
আইনে শাস্তি
মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনটি ২০১২ সালের। এই আইনের অধীন অপরাধসমূহ আমলযোগ্য, অ-জামিনযোগ্য এবং অ-আপসযোগ্য। মামলার বিচার একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে বলা হলেও বছরের পর বছর কেটে গেলেও বহু মামলার বিচার শেষ হয় না। আইনের ২৪ (১) ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন সংঘটিত কোনো অপরাধের অভিযোগ গঠনের ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল বিচারকাজ সম্পন্ন করবে। ২৪ (২) ধারায় বলা হয়েছে, উপধারা (১)-এর বিধান সত্ত্বেও ওই সময়সীমার মধ্যে বিচারকাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থতা বিচারকাজকে বাতিল করবে না, কিন্তু ট্রাইব্যুনাল ওই সময়ের মধ্যে বিচারকাজ সম্পন্ন করতে সমর্থ না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ১০ (দশ) কার্যদিবসের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে প্রতিবেদন পাঠাবে। এ আইনে সংঘবদ্ধভাবে মানব পাচারের জন্য মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও সর্বনিম্ন সাত বছরের কারাদণ্ড এবং অন্যূন পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান আছে। এ আইনের বিভিন্ন ধারায় রুদ্ধ কে বিচার (ক্যামেরা ট্রায়াল), দোভাষী নিয়োগ, বিচারে বিদেশি দলিল, লিখিত তথ্য প্রমাণাদি বা উপাদানের গ্রহণযোগ্যতা, ইলেকট্রনিক তথ্য প্রমাণের গ্রহণযোগ্যতা, আসামিদের সম্পত্তি জব্দ, অবরুদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করা এবং অতিরাষ্ট্রিক নিষেধাজ্ঞার বিধান রয়েছে। এসব বিষয় স্বাভাবিকভাবে অন্য আইনে নেই। এই আইন করার আট বছর পর আলোর মুখ দেখেছে ট্রাইব্যুনাল। দেশের সবগুলো বিভাগীয় শহরে একটি করে ট্রাইব্যুনাল গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার ফলে গত ১২ মার্চ মাত্র ১৫০টি মামলা নিয়ে ঢাকার মানবপাচার প্রতিরোধ ট্রাইব্যুনালের কাজ শুরু হয়। এ ট্রাইবুনালের ভারপ্রাপ্ত বিচারক কাজী আবদুল হান্নান । এ ট্রাইব্যুনালের পেশকার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এর আগে প্রতিটি জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মানব পাচার সংক্রান্ত মামলার বিচার পরিচালিত হত। এসব ট্রাইব্যুনালে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার চাপ বেশি থাকায় দীর্ঘায়িত হত মানব পাচার মামলার বিচার। জাহাঙ্গীর জানান, এই ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপে এখনো কোনো পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া হয়নি। মামলার বিচার শুরু হওয়ার প্রাক্কালে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবে কারণে আদালত ছুটি হয়ে যাওয়ায় এখন শুধু ভার্চুয়াল আদালতে জরুরি শুনানি অর্থাৎ জামিন শুনানি হচ্ছে। বিচারক তার বাসায় বসে ভিডিও কনফারেন্সে এই শুনানি নিচ্ছেন। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনাসহ আরও কয়েকটি বিভাগে এ রকম ট্রাইব্যুনালের কাজ শুরু হয়েছে। তবে বিভাগীয় অপর বড় শহর রাজশাহীতে এখনও ট্রাইব্যুনালের কাজ শুরু হয়নি।
আপস
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলার রাষ্ট্রপরে বিভিন্ন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশে মোটা অংকের বেতনের লোভ দেখিয়ে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের যারা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাচার করে দেন রিক্রুটিং এজেন্সির সেসব লোক ‘খুবই শক্তিশালী’। সামাজিক, রাজনৈতিকভাবেও তারা বেশ প্রভাবশালী। অনেক সময় তারা বিচার ‘কিনে নেওয়ার চেষ্ট করেন’। রাষ্ট্রপ থেকে খুব সতর্ক থেকেও তাদের সঙ্গে পেরে ওঠা যায় না। এসব আসামিরা বেশিরভাগই ভিকটিম বা তিগ্রস্তদের সঙ্গে টাকা দিয়ে আপস করে ফেলেন। আবার এসব মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে ‘উপরের মহলের চাপে’ বা অন্য কিছুতে রাষ্ট্রপরে অনেক আইনজীবী নৈতিকতা ধরে রাখতে পারেন না। সে সব কারণে অধিকাংশ মামলায়ই আসামিরা খালাস পেয়ে যান। ঢাকার ৫ নম্বর নারী ও শিশু নিযাতন দমন ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপরে আইনজীবী আলী আসগর স্বপন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এসব মামলা প্রমাণ করা কঠিন। কেননা বাদীপরে সঙ্গে আপস হয়ে যায়। আসামিপ বিদেশে পাচারে যে টাকা নিয়েছিল সে টাকার বেশি পরিমান বাদীকে দিয়ে আদালতের চৌকাঠ পার হয়ে যান। যদিও এ প্রকৃতির মামলা আপসযোগ্য নয়, কিন্তু বাদী ও তার আত্মীয়-স্বজন আসামির পে আদালতে স্যা দেন। এই সব সাীদের বৈরী ঘোষণা করেও তেমন লাভ হয় না। ফলে আসামিরা খালাস পেয়ে যান।” বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট ঢাকা জেলা ইউনিটের সমন্বয়ক আইনজীবী মশিউর রহমান বলেন, “আমি আমার পেশাগত জীবনে দেখেছি যে, বেশিরভাগ পাচারের মামলাতেই বাদী আসামিদের কাছে বিক্রি হয়ে যান। আপসযোগ্য মামলা না হওয়া সত্ত্বেও বাদী ও আসামিরা পরোভাবে আপসে চলে যান।” উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ইরাকে ২৭-২৮ জন শ্রমিক পাচারের অভিযোগের একটি মামলায় চার বছর আগে বাদী স্যা দিতে এসে নিজেদের পরে আইনজীবীদের কথা না মেনে আসামিদের প নিয়ে কথা বলেন। মামলাটির বিচার এখনও চলছে। সাী আসছে না। বাদী ওই রকম স্যা দেওয়ার পর তিনি মামলাটি বাদীপে পরিচালনা করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ইউএসএইডের অর্থায়নে ‘উইনরিক’ নামের একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহযোগী বাংলাদেশের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প থেকে মামলাটি পরিচালনা করছিলেন মশিউর রহমান। “অথচ বাদী এবং তার সঙ্গে আরও লোকজনকে মরুভূমিতে অভুক্ত রেখে নানাভাবে মানবেতর অবস্থার মুখোমুখি করেছিল আসামিরা,” হতাশার সঙ্গে বলেন তিনি। এ বিষয়ে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি আবদুল্লাহ আবু বলেন, “আপসের সংস্কৃতি ভাঙতে বাদীর প্রতি কঠোর পদপে নিতে হবে। আপসই যদি করে তবে সে মামলা করে কিসের জন্য? বাদীর শাস্তির জন্য বিচারকের কাছে আবেদন করতে হবে। দ্রুত বিচার শেষ করতে হবে। আপসের সুযোগ দেওয়া যাবে না। তাহলে আসামিরা খালাস পেয়ে আবারও পাচারের কাজে জড়িয়ে পড়বে। তদন্তও নির্ভুলভাবে তাড়াতড়ি শেষ করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে আমি সজাগ থাকব।”