৪ বছরেও অজানা দিয়াবাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের উৎস

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ির একটি খাল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় চার বছরের তদন্তে কারও সম্পৃক্ততার খোঁজ পায়নি পুলিশ। কারা, কী উদ্দেশ্যে এই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র এনেছিল, এসব প্রশ্নে উত্তর মেলাতে পারছেন না তদন্ত কর্মকর্তারা। এমনকি অস্ত্র, গুলি, বিস্ফোরকসহ উদ্ধার হওয়া জিনিসগুলো কোথা থেকে এসেছে সে সম্পর্কেও নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। রাজনৈতিক অবস্থাকে প্রভাবিত করার জন্য এই অস্ত্রগুলো আনা হয়েছিল বলে ধারণা করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। একইসঙ্গে উদ্ধার হওয়ার অস্ত্রের সঙ্গে বিদেশি সংস্থা বা গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত থাকার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ। যে কারণে এসব অস্ত্রের উৎস পাওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি।
২০১৬ সালের ১৮ জুন উত্তরার ১৬ নম্বর সেক্টরের দিয়াবাড়ি খাল থেকে ৭টি কালো ব্যাগের ভেতর থেকে ৯৫টি ৭.৬২ এমএম পিস্তল, ২টি ৯ এমএম পিস্তল, ৪৬২টি ম্যাগাজিন (২৬৩টি এসএমজির), ১০৬০ রাউন্ড গুলি, ১০টি বেয়নেট, ১৮০টি ক্লিনিং রড ও ১০৪টি স্প্রিংযুক্ত বাক্স উদ্ধার করা হয়। ১৯ জুন একই খাল থেকে আরও ৩টি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। ব্যাগে ছিল এসএমজির ৩২টি ম্যাগাজিন ও ৮টি ক্লিনিং রড। ২৫ জুন একই এলাকার অন্য একটি খাল থেকে উদ্ধার করা হয় আরও ৩টি ব্যাগ। যার মধ্যে ৫টি ওয়াকিটকি, দুটি ট্রান্সমিটার, দুটি ফিডার কেবল, ২২টি কৌটা (যার মধ্যে ছিল আইসি, ট্রানজিস্টার, ক্যাপাসিটার ও সার্কিট), সাত প্যাকেট বিস্ফোরক জেল, ৪০টি পলিথিনের ব্যাগে থাকা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম এবং ৩২৫টি রুপালি ও সবুজ রঙের স্প্রিংযুক্ত বাক্স। এছাড়া আরও কিছু ইলেকট্রিক ডিভাইস উদ্ধার করা হয়। পরিত্যক্ত অবস্থায় অস্ত্রগুলো উদ্ধার হওয়ার কারণে কোনও মামলা হয়নি। তুরাগ থানায় তখন তিনটি আলাদা আলাদা সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছিল। এই তিনটি সাধারণ ডায়েরি ধরেই তদন্ত করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ। গত চার বছরের তদন্তে এই অস্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাউকে পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন তদন্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক দায়িত্বশীল। অস্ত্র উদ্ধারের এক সপ্তাহের মধ্যে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা হলেও এসব অস্ত্র জঙ্গিদের নয় বলে নাকচ করে দিয়েছেন কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, জঙ্গিদের কাছে এ পর্যন্ত যত অস্ত্র পাওয়া গেছে, তার বেশিরভাগই পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আনা। যেগুলো সাধারণ লেদ মেশিনে বানানো এবং নিম্নমানের। আর দিয়াবাড়ির অস্ত্রগুলো উন্নতমানের এবং সংখ্যায় বেশি।
এন্টি টেররিজম ইউনিটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় এসব অস্ত্রের ব্যাপারে খোঁজ খবরের জন্য রিপোর্ট চাওয়া হয়েছিল। কিছু পাওয়া গেছে কিছু পাওয়া যায়নি। এই ধরনের অস্ত্র বা অন্যান্য জিনিসগুলো কারা ব্যবহার করে সবগুলো রিপোর্ট আসলে হয়তো চূড়ান্তভাবে বলা যাবে।’ ছানোয়ার হোসেন অ্যান্টিটিররিজম ইউনিটে বদলি হওয়ার আগে ডিএমপির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের উপ-কমিশনার (ডিসি) দায়েত্বে ছিলেন। অস্ত্রের উৎস সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অস্ত্রগুলোর সোর্স ও ইউজার সম্পর্কে জানতে পারলে ওই সূত্র ধরে আগানো যাবে। এখন পর্যন্ত যেসব রিপোর্ট আমরা পেয়েছি এতে পজিটিভ কোনও সাইন আসেনি।’ দিয়াবাড়ি থেকে উদ্ধার অস্ত্রের পেছনে বিদেশিদের সহায়তা রয়েছে বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ ধরনের অবৈধ অস্ত্রের চলাচল বিভিন্ন দেশে হয়ে থাকে। কথা হচ্ছে কেন আনা হয় বা কোথায় থেকে আসে? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা দেখে এসেছি এধরনের অস্ত্র আসার ক্ষেত্রে বিদেশিদের সহায়তা থাকে। এত বেশি অস্ত্র সাধারণত ছোটখাট চোরাকারবারীরা আনতে পারে না। ’
বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততা থাকলে এসব অস্ত্রের উৎস পাওয়া যায় না বলে জানান এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক। তিনি বলেন, ‘দশ ট্রাক অস্ত্রের ক্ষেত্রেও কোন জাহাজ থেকে এগুলো নেমেছে এর ব্যাক কানেকশন বের করা সম্ভব হয়নি। ওই তদন্তেও এই একটা ঘাটতি ছিল। বৈদেশিক সংস্থা বা গোয়েন্দা সংস্থা যদি জড়িত থাকে তখন উৎসের তথ্য পাওয়াটা মুশকিল হয়ে পড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না।’ উদ্ধার হওয়ার অস্ত্রের বিশ্লেষণ করে সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুর রশীদ বলেন, ‘এগুলো ছোট অস্ত্র ছিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থাকে প্রভাবিত করার জন্য এই অস্ত্রগুলো আনা হয়েছিল বলে অনুমান করা যায়। আর যদি ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হতো তাহলে এটা প্যাকেজিং অন্যরকম থাকতো।’ পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট ছোট অস্ত্রের অবৈধ কারখানা রয়েছে। লেদ মেশিন দিয়ে তারা অস্ত্র করে থাকে। এসব ছোট কারখানায় বড় চালানের যোগান দেয়ার মতো সক্ষমতা থাকে না। সাধারণত বড় চালানের ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয় সেগুলো বৈধ অস্ত্র কারখানা থেকে তৈরি করা হয়। দিয়াবাড়িতে উদ্ধার অস্ত্রগুলোও বৈধ কারখানায় তৈরির পর চোরাচালান করা হয়েছে বলে মনে করেন এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক। তিনি বলেন, ‘বৈধ কারখানার তৈরি হওয়া অস্ত্র কিভাবে চোরাচালান হয়? এটা তখনই হয় যখন জিও পলিটিক্স যুক্ত থাকে। দিয়াবাড়ির অস্ত্রের ক্ষেত্রেও তাই হতে পারে।’