বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ধ্বংসলীলা চলল পশ্চিমবঙ্গে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ঘড়ি ধরে বুধবার বিকেলে রাজ্যের উপর আছড়ে পড়ল বিধ্বংসী মারণ সাইক্লোন আম্ফান। ঝড়ের তাণ্ডবে কয়েক ঘণ্টা ধরে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চলল দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায়। এরফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুন্দরবন। লণ্ডভণ্ড হয়েছে বসিরহাট মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা। হাওড়ার শিবপুরে টালির চাল মাথায় পড়ে প্রাণ হারাল লক্ষ্মীকুমারী সাউ নামে ১৩ বছরের কিশোরী। উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখায় নুরজাহান বেওয়া (৫৬) এবং মাটিয়া থানা এলাকায় মহন্ত দাস (২০) আচমকা গাছ চাপা পড়ে মারা গিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী রাতে নবান্নে জানান, সব মিলিয়ে রাজ্যে অন্ততঃ ১২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। দূরদূরান্ত থেকে এদিন রাত পর্যন্ত সব খবর এসে পৌঁছয়নি। সব খবর এলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে। উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে, এমন আগে দেখিনি।
আম্ফানের তাণ্ডবে এদিন জেলায় জেলায় ধসে পড়েছে হাজার হাজার মাটির বাড়ি। গাছ উপড়ে বন্ধ হয়েছে বহু রাস্তা। প্রবল বৃষ্টিতে জলমগ্ন বহু এলাকা। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় নাকাল হন লক্ষ লক্ষ মানুষ। গভীর রাত পর্যন্ত ঘরের দরজা এঁটে আতঙ্কের প্রহর গুণেছেন দক্ষিণবঙ্গবাসী। গোঁ গোঁ শব্দে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় দানবের মতো থাবা বসায় চার দেওয়ালে, জানালায়, দরজায়।
বুধবার সকাল থেকে নবান্নের কন্ট্রোল রুমে বসে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি এলাকার লাগাতার খোঁজ নেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আবহাওয়া দপ্তর জানাল, তাদের হিসেব মতোই ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৮৫ কিলোমিটার বেগে রাজ্যের একাধিক এলাকায় দাপিয়েছে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। শহর কলকাতাতেও ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার। কালো মেঘ আর বৃষ্টির হাত ধরে এদিন সকাল থেকেই দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে দুর্যোগ শুরু হয়েছিল। বেলা বাড়তেই ঝড়-বৃষ্টির তীব্রতা বাড়তে থাকে। এর কবলে পড়ে বিধ্বস্ত হয় পূর্ব মেদিনীপুর থেকে শুরু করে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা। প্রভাব পড়ে উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট মহকুমাতেও।
আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস মতোই দুপুর আড়াইটে নাগাদ যখন সাগরের মাটি ছুঁল আম্ফান, তখন গত বছরের বুলবুলের স্মৃতিকে তুচ্ছ করে দিল ঝড়ের গতি। সেই সময় বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের প্রধান সচিব তাঁকে জানান, বুলবুলের থেকে কমপক্ষে ৫০ কিলোমিটার বেশি গতিবেগে ঝোড়ো হাওয়া বইছে।
আম্ফানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা। কাঁচা বাড়ির একটিও আর অবশিষ্ট নেই সাগরদ্বীপ এলাকায়। প্রচুর পাকা বাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত। বহু ঝড়ের সাক্ষী থাকা এলাকার মানুষ কখনও এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হননি বলেই জানিয়েছেন। কিছুক্ষণ থমথমে পরিস্থিতির পর নতুন করে ফিরে আসে প্রলয়। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় বকখালি, নামখানা, ফ্রেজারগঞ্জ, পাথরপ্রতিমা, কুলতলি, ঝড়খালি, গোসাবা। গাছ ভেঙে, বিদ্যুতের খুঁটি উল্টে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি সহ বিস্তীর্ণ এলাকা। আবহাওয়া দপ্তর জানায়, বিকেল সাড়ে ছ’টা নাগাদ সাইক্লোনের মূল অংশ প্রবেশ করেছে সুন্দরবনে। তখন ঝড়ের গতিবেগ ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার। কলকাতায় তখন প্রায় ১২০ কিলোমিটার বেগে ঝড় বইছে। এরপর থেকে ধাপে ধাপে এগিয়ে আসতে থাকে উম-পুন। ঝড়ের দাপট আরও বাড়তে থাকে মহানগরে। কলকাতায় এদিন সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার বেগে ঝড় বয়ে গিয়েছে। আবহাওয়া অফিস রাতে জানায়, শহরে সাইক্লোনের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৩৩ কিমি। কয়েকশো গাছ উপড়ে বন্ধ হয়ে যায় রাস্তা। প্রশাসনের নির্দেশে বন্ধ করে দেওয়া হয় শহরের ফ্লাইওভারগুলি। ভেঙে পড়েছে বেশ কিছু বাড়ি। সরকারি নির্দেশে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল কলকাতা সহ বিভিন্ন জায়গায়। লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া শহর অন্ধকারে ও বৃষ্টির জলে ডুবে কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। কলকাতা ছেড়ে সাইক্লোন যখন হাওড়া ও হুগলি হয়ে এগতে থাকে, তখনও তার গতি ছিল ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটারের আশপাশে। জোয়ারের কারণে গঙ্গার জল ঢুকে ভেসে যায় ওই দুই জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে ভয়াল তাণ্ডব চালায় উম-পুন। আচমকাই সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ দমকা হাওয়ায় নবান্নের বেশ কয়েকটি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। প্রাক্তন এক মন্ত্রীর ঘর ভেঙে লণ্ডভণ্ড হতেই ছোটাছুটি শুরু হয়। দুই ২৪ পরগনার পাশাপাশি এবারের ঘূর্ণিঝড়ের অন্যতম টার্গেট ছিল পূর্ব মেদিনীপুরের পাশাপাশি পশ্চিম মেদিনীপুরও। সাইক্লোনের ভালো প্রভাব পড়ে বর্ধমানে। রাত বাড়লে, ধীরে ধীরে সামান্য শক্তি খুইয়ে বাংলাদেশের দিকে চলে যায় উম-পুন। দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া সুপার সাইক্লোনেব হাত ধরে এক চরম ধ্বংসলীলার সাক্ষী হয়ে থাকল পশ্চিমবঙ্গ।