করোনা জয়ে মঙ্গোলয়িার সাফল্য

0
আমিরুল আলম খান
প্রথমেই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই মঙ্গোলিয়া এশিয়া মহাদেশে অবস্থিত। এ অঞ্চলকে সাধারণভাবে মধ্য এশিয়া বলা হয়। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে মধ্যযুগের পরাক্রান্ত স¤্রাট চেঙ্গিস খান (১১৬২-১২২৭) মঙ্গোলিয়া সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। চেঙ্গিস খান মঙ্গোলিয়ার রাজধানী স্থাপন করেছিলেন উলানবাটারে। এখনও উলানবাটারই মঙ্গোলিয়ার রাজধানী। ১২৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উত্তর-পশ্চিমে মস্কো, পশ্চিমে আরব, দক্ষিণে হিমালয় পর্বতমালা, পারস্য এবং পূর্বে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া মঙ্গোলিয়া সা¤্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়।
১৯২৪ বখত রাজবংশের উচ্ছেদ এবং কমিউনিস্ট সরকারের মাধ্যমে গড়ে ওঠে আধুনিক মঙ্গোালিয়ার যাত্রা শুরু। বিশাল আয়তনের এই দেশের আয়তন ১৫ লক্ষ ৬৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ৩২ লাখ ৩৮ হাজার। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনঘনত্ব মাত্র ২ জন। বিশে^র মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.০৪% এদেশে বাস করে। তাদেও ৬৭.২% শহরবাসী। প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৬৯.৫ বছর। শিক্ষিতের হার ৯৮.৪০%। মাথাপিছু জিডিপি ৪,১২১ মার্কিন ডলার।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ জনগণ ও সৈনিকদের দ্বারা রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে গণতান্ত্রিক মঙ্গোলিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। ঠিক বছরই চীন এবং ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। সোভিয়েত লাল ফৌজের সহায়তায় মঙ্গোলিয়ান পিপলস পার্টির নেতৃত্বে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে গণসাধারণতান্ত্রিক মঙ্গোলিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজতান্ত্রিক এই বিপ্লব প্রাচীন মঙ্গোলীয় অচলায়তন ভেঙে এক নতুন সমাজ গড়ে তোলে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত মঙ্গোলিয়ায় ছিল পশুচারণভিত্তিক এক যাযাবর সমাজ। একটি যাযাবর সমাজ থেকে সরাসরি সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার মত কঠিন কাজটি সোভিয়েত সমর্থনে সম্ভব হয়ে হয়ে ওঠে। অতি দ্রুত মঙ্গোলিয়া আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থাসহ সমাজতান্ত্রিক সম্পদ বণ্টনের মধ্যেমে এক আধুনিক রাষ্ট্রে উন্নীত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সাদ্রাজ্যবাদী চক্রান্তের ফলে ১৯৯২ সালে মঙ্গোলিয়ায় কমিউনিস্ট শাসনের সাময়িক অবসান ঘটলেও এখন সেখানে কমিউনিস্টরা খুবই শক্তিশালী এবং তাদের সাথে ফ্রন্ট গঠন ছাড়া সরকার গঠনের সামর্থ্য এখনও কোন দলের নেই।
চীনে করোনা প্রাদুর্ভাবের পরপরই মঙ্গোলিয়া চীন, রাশিয়ার সাথে সকল সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। বিমানবন্দরে কড়া নজরদারী, স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্যকর্মীদের সার্বক্ষণিক প্রস্তুতিতে রাখে। চীন ও রাশিয়া থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণ করে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা কঠোরভাওে অনুসরণ করে। এভাবে মঙ্গোলিয়ার মত বিশাল দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
দেশ মঙ্গোলিয়া। এখন বিশাল এই দেশ। উত্তরে পরাক্রান্ত রাশিয়া এবং দক্ষিণে নতুন পরাশক্তি চীন। তিনটি দেশেই এক সময় সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মঙ্গোলিয়াতেও তার ঢেউ লাগে। তবে পুরোপুরি পুঁজিবাদী দেশে অধঃপতিত হয় নি মঙ্গোলিয়া। করোনার (কোভিড-১৯) প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে। চীনের প্রতিবেশী হিসেবে তাই মঙ্গোলিয়াকে প্রথম থেকেই সতর্কতা নিতে হয়। সম্প্রতি রাশিয়াতেও কোভিড-১৯ ব্যাপকভাবে ছড়াচ্ছে। আনন্দের কথা আজ (২৪ এপ্রিল) পর্যন্ত মঙ্গোলিয়ায় একজনও প্রাণ হারায় নি। এ পর্যন্ত মাত্র ৩৫ জন আক্রান্ত হয়েছে, তার মধ্যে ৮ জনই সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেছেন, বাকি ২৭ জনের কেউই গুরুতর অসুস্থ নন। মঙ্গোলিয়ায় প্রথম একজন করোনা রোগী শনাক্ত হয় ১০ মার্চ। এরপর ১৭ মাচে ৩ জন, ২২ মার্চ ৪ জন, ১৫ এপ্রিলে সর্বোচ্চ ১৩ জন করোনায় আক্রান্ত হন। এছাড়া বাকি ১৪ জন বিভিন্ন তারিখে আক্রান্ত হন।
আমরা জানি সংশোধিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী চীনে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত মারা গেছে ৪,৬৩২ জন। আক্রান্ত ৮২,৭৯৮ জনের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৭৭,২০৭ জন। চিকিৎসাধীন ৯৫৯ জনের মধ্যে শংকাজনক ৬৩, এবং শংকামুক্ত ৮৯৬ জন। এদিকে রাশিয়ায় করোনার ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের পর চীন রাশিয়া ও মঙ্গোলিয়ার সাথে সকল সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে
প্রথম দিকে খুবই সাফল্য দেখালেও রাশিয়ায় কোভিড-১৯ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। রাশিয়ার অবস্থান এখন খুব খারাপ। সেখানে গতকাল ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত মারা গেছে ৫৫৫ জনের মধ্যে গতকালই মারা গেছেন ৪২ জন। মোট আক্রান্ত ৬২,৭৭৩ জনের মধ্যে গতকালই আক্রান্ত হয়েছেন ৪,৭৭৪ জন। সুস্থ হয়েছেন ৪,৮৯১ জন। চিকিৎসাধীন ৫৭,৩২৭ জনের মধ্যে শংকাজনক ২,৩০০ এবং শংকামুক্ত ৫৫,০২৪ জন। রাশিয়া প্রতি ১০ লাখে ৪৩০ জনকে পরীক্ষা করেছে।
সমাজতান্ত্রিক সমাজের কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনে পুঁজিবাদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সীমিত বিকাশের কারণে মঙ্গোলিয়া করোনা মোকাবেলায় দারুণ সফল হয়। সেখানে ‘মানুষ মানুষের জন্য নীতি’ জয়ী হয়েছে। আরও লক্ষণীয়, এখনও পর্যন্ত ইউরোপ বা আমেরিকার তুলনায় এশীয় দেশগুলি অনেক বেশি সাফল্য দেখাতে পেরেছে।
আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।