কথা নয় আর, কাজ চাই সবার

0

মীযানুল করীম
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। এখানে সব ধর্মের মানুষ মর্যাদার সাথে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে রক্ত দিয়েছেন সব ধর্মাবলম্বী। পবিত্র কুরআন শরিফের অবমাননাকে কেন্দ্র করে কুমিল্লায় এবার যা ঘটেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমাদের দেশের সরকারের প্রধান হিসেবে তিনি এসব কথা ঠিকই বলেছেন। মানুষ বলছে, তিনি চাইলেও এ ধরনের ঘটনার সুবিচার কতখানি হবে, তা সন্দেহের ব্যাপার। এটা লোকে বলছে ব্যাপক অভিজ্ঞতার নিরিখে। তবে আশার কথা প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়ে বলছেন, কুমিল্লার ঘটনায় যেই হোক না কেন অপরাধী, তার বিচার করা হবে। তিনি এ দেশে প্রচলিত সিস্টেমে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। অতএব অন্তত এখন ‘সাম্প্রদায়িকতার’ পুরো মূলোচ্ছেদ ঘটবে এবং নির্দোষ ব্যক্তিদের ওপর আর হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটবে না বলে প্রত্যাশা করা যেতে পারে।
কুমিল্লার মতো এমন অঘটনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের সুষ্ঠু বিচার আর নামেমাত্র বিচার তথা দায়সারা রীতি রক্ষা করার মধ্যে প্রভেদ রয়েছে। জনগণ চায়, অপরাধী যেই হোক সরকারি কিংবা বিরোধী দলের নেতাকর্মী, সমর্থক তারই যথার্থ বিচার হবে। অন্যথায়, রাষ্ট্র দায়ী থাকবে এবং সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না। গণতন্ত্রের একটা প্রধান দাবি হলো, আইনের শাসন। এ জন্য সব ধর্মের লোকদের ব্যাপারেই ন্যায়বিচার করতে হবে। কেউই প্রচলিত আইনের বাইরে থাকতে পারে না। তা না হলে দেশে বিশৃঙ্খলা বাড়বে এবং সরকারের প্রতি গণআস্থা হ্রাস পাবে। কুমিল্লায় বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে যা ঘটল, তা একেবারেই অবাঞ্ছিত এবং অত্যন্ত আপত্তিকর। শহরের একটি পূজামণ্ডপের মূর্তির কোলে সংখ্যাগুরু মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ আল কুরআনের কপি রেখে পূজার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হনুমানের ‘গদা’ সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এটা কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মুসলিম বা হিন্দুর করার কথা নয়। আশপাশের সিসিটিভির মাধ্যমে পুলিশ জানায়, এ ব্যাপারে ‘নিশ্চিত’ হয়ে একজন ভবঘুরে মাদকসেবী যুবককে ধরা হয়েছে। তবে হিন্দুদের পক্ষে একজন বিশিষ্ট আইনজীবী বলেছেন, মূলত ওই যুবককে দিয়ে যারা এটা করিয়েছে তাদের ধরতে হবে এবং আনতে হবে বিচারের আওতায়। পুলিশ বলছে, আমরা সে যুবকের মাধ্যমে জানতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছি তাকে কেউ ব্যবহার করেছে কি না।
আমাদের বক্তব্য, সে যুবক নিজে এমন গর্হিত কর্ম করুক কিংবা তাকে দিয়ে করানো হোক, আসল ব্যাপার যাই হোক না কেন, রহস্য উদঘাটনের পাশাপাশি উপযুক্ত বিচার হতে হবে প্রকৃত অপরাধীর। এ নিয়ে অহেতুক রাজনৈতিক বিভ্রান্তি কিংবা ভিত্তিহীন প্রচারণা সৃষ্টি করা সম্পূর্ণ অন্যায়। ‘বেøইমগেইম’ নয়, প্রকৃত গেইম খেলা হোক জনগণের স্বার্থে এবং দেশে শান্তি-সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার জন্য। এ দিকে সরকারের অনেক লোক তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই এ বিষয়ে প্রপাগান্ডা চালাচ্ছেন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সবার চুপ থাকাই বাঞ্ছনীয়। অতীতের পুনরাবৃত্তি যেন না হয় এ ক্ষেত্রে। তা হলে বারবার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার পাঁয়তারা চলবে। এ দিক দিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রধান কাণ্ডারি হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দৃশ্যত ও আপাতত সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি কুমিল্লার তদন্তাধীন বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশ করতে রাজি হননি। গত বৃহস্পতিবার তার ভাষায়, কুমিল্লা থেকে রংপুর পর্যন্ত কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। দেশের কোথাও আতঙ্ক নেই। পরিবেশ সম্পূর্ণ শান্ত। কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মূল হোতা নেশাখোর। মূল হোতা চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংযম প্রদর্শন করলে কী হবে, কোনো কোনো মন্ত্রী এ উপলক্ষে সমানে ‘বিএনপি-জামায়াত’, তথা বিরোধী দলকে এক হাত নিয়ে নিচ্ছেন। বিরোধীদলীয় রাজনীতিকরাও ছেড়ে কথা বলার লোক নন। পাল্টাপাল্টি বাহাসের ফাঁকে আসল অপরাধীরা পার পেয়ে যাবার শঙ্কা বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার্থে বৃহৎ প্রতিবেশীর দায়িত্বও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যা এ শাসন আমলে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণত বর্তমান ক্ষমতাসীন মহল ভারতের প্রশংসা ছাড়া বিরূপ কোনো কথা বলেন না। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনও বিবিসিকে একই কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী ভারতকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, সে দেশে এমন কিছু হওয়া উচিত নয় যার প্রভাব এ দেশে পড়ে। সে দেশের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির মন্ত্রগুরু ও হিন্দুত্ববাদী নেতা মোহন ভাগবৎ মুসলমানদের সমালোচনায় সম্প্রতি বলেছেন, এদের সংখ্যা বা প্রজনন বেশি। অর্থাৎ মুসলিম সংখ্যালঘুদের মাঝে জন্মহার বেশি। বিজেপি বা ভারতীয় জনতা পার্টির একজন শীর্ষ নেতা বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের জন্য দিল্লির প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে হিন্দু মন্দিরে হামলা, তাদের বাড়িঘরে লুণ্ঠন এবং তাদের ওপর নির্যাতন চলছে। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি নিদারুণ আঘাত। স্মর্তব্য, ভারতের একজন প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রী নিকট অতীতে বাংলাদেশীদের নিন্দা করে বলেছেন, এরা ইউপোকার মতো ক্ষতিকর। রংপুরের পীরগঞ্জের গাঁয়ে যা ঘটেছে তা মারাত্মক এবং নিন্দনীয়। সেখানে একজন অমুসলিম তরুণের অর্বাচীন আচরণে নিরীহ নির্দোষ লোকজন সর্বস্ব হারাচ্ছেন দুর্বৃত্তদের তাণ্ডবে। জানা গেছে, একজন মুসলিম তরুণ প্রায় ৪০ দিন আগে একটি ইসলামী গজল সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করেছিল। উপরিউক্ত অমুসলিম বালক এর বিরোধিতা করে। গজল লেখক তা থেকে বিরত থাকতে বললেও এটা শোনা হয়নি বলে অভিযোগ। তা বলে কি নিরীহ গরিব হিন্দুদের আক্রমণ করা চলে? কিংবা তাদের বাড়িঘর পোড়ানো যায়? নিশ্চয়ই নয়। যে অপরাধ করেছে সে যে ধর্মের হোক, তাকে আইনের আওতায় আনলেই চলে। এরপর তার সুষ্ঠু বিচার ও যথাযথ শাস্তিই প্রত্যাশিত। পীরগঞ্জের ঘটনা কিন্তু অন্য রকম। রংপুরের পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও বলেছেন পূর্বোক্ত অমুসলিম তরুণের দায়ের কথা। সে ভুলটি করায় লুটেরেরা সুযোগ পেয়েছে অপকর্মের। তাই প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীরই সতর্ক থাকা দরকার যাতে কেউ আইন হাতে তুলে না নেয় কিংবা সীমা লঙ্ঘন না করে। সব সম্প্রদায়ের মাঝেই ভালোমন্দ লোক থাকতে পারে যা অস্বাভাবিক নয়। তাদের সামলে রাখা নিজ নিজ সম্প্রদায়ের দায়িত্ব।
একটি পত্রিকার প্রথম পাতায় দেখা গেল, একজন প্রবীণ বুদ্ধিজীবী বলেছেন, যারা মন্দিরে হামলা কিংবা সংখ্যালঘুদের বাড়িতে লুটপাট চালায়, ওরা ধর্মপ্রাণ নয়, ওরা সাম্প্রদায়িক। এ বুদ্ধিজীবী ঘোরতর বামপন্থী যারা সাধারণত ‘প্রগতিশীল’ হিসেবে সুপরিচিত। তিনি সরকারঘনিষ্ঠ একটি দৈনিকে জরুরি নিবন্ধ লিখেছেন এ বিষয়ে। জরুরি কাজ জরুরি সময়ে করে তিনি মোটেও ভুল করেননি। বরং ভুলে করছেন তারা যারা অহেতুক রাজনৈতিক কাঁদা ছোড়াছুড়ি করে নিজেদের গা নোংরা করছেন এবং সাম্প্রদায়িকতাকে চতুরতার সাথে জিইয়ে রাখছেন। এই নেতারা ক্ষমতায় থাকুন বা না থাকুন, তাতে অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটে না। আর অতীতের সাম্প্রদায়িকতার সুবিচার হলে আজ সবাইকে এতটা উদ্বিগ্ন হতে হতো না। মরহুম কর্নেল (অব:) আকবর হোসেন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আমলে খেতাবপ্রাপ্ত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বারবার জোর দিতেন অসম্প্রদায়িক হওয়ার ওপর। বলতেন, ধর্মনিরপেক্ষতা একটি বিভ্রান্তিকর পরিভাষা। মানুষ অন্তত নিজ ধর্মের বিষয়ে নিরপেক্ষ হতে পারে না। তবে সবারই হওয়া দরকার মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক, যা ধর্মেরও একটা বড় শিক্ষা। তিনি ২০০৬ সালে মন্ত্রী থাকাকালে হঠাৎ মারা যান। সত্যিই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ মনে পুষে রেখে কেউ ধার্মিক হতে পারেন না। বিশেষত ইসলামের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এটা কত বেশি অসাম্প্রদায়িক ধর্ম। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলামের অনুসারী। সে দেশে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান থাকতে পারে না। আর মনে রাখতে হবে, ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা মোটেও এক নয়। ধর্ম, ভাষা, নৃ-তত্ত্ব, সংস্কৃতি- এসব নিয়েই মানুষের সাম্প্রদায়িকতা, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়।