ঝুঁকিতে পুরো দেশ, রোগী শনাক্তের কৌশল এখন কী হবে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে এখন পুরো দেশ। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সামাজিক সংক্রমণ শুরু হয়েছে এ তথ্য স্বীকার করে নিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। স্বাস্থ্য অধিদফতর সারাদেশকেই করোনার ঝুঁকির আওতায় এনেছে। ফলে এখন কোন পদ্ধতিতে রোগী শনাক্ত হবে সে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন শুধু কারও লক্ষণ-উপসর্গ দেখে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করলে হবে না, আমাদের কৌশল বদলাতে হবে। বিদ্যমান বাস্তবতায় রোগী শনাক্তের কৌশল নির্ধারণে সরকারকে নতুন করে ভাবার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, করোনা ছড়িয়েছে দেশের ৫২টি জেলায়। এরমধ্যে ২৬টি জেলা পুরোপুরি আর ২১টি জেলা আংশিক অংশ লকডাউন করা হয়েছে, লকডাউন হয়েছে রাজধানী ঢাকারও বিভিন্ন এলাকা। দেশে শুরু থেকে করোনার পরীক্ষা হচ্ছিল জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর)। ধীরে ধীরে সেটি সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে ১৭টি ল্যাবে করোনার নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে, আরও ১১টি প্রতিষ্ঠান এর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এতদিন স্বাস্থ্য অধিদফতর ও আইইডিসিআর কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের কথা ‘সীমিত পর্যায়’ বলে উল্লেখ করলেও গত ১৩ এপ্রিল স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক কোভিড-১৯ নিয়ে আয়োজিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত অনলাইন ব্রিফিংয়ে স্বীকার করেন, ‘আমাদের ইতোমধ্যে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সামাজিক সংক্রমণ হয়ে গেছে।’
সামাজিক সংক্রমণের পর যখন পুরো দেশ ঝুঁকিতে বলে ঘোষণা দিয়েছে সরকার তখন বিদ্যমান বাস্তবতায় কোন পদ্ধতিতে রোগী শনাক্ত হবে তা নিয়ে কথা উঠেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন আর কারও লক্ষণ-উপসর্গ দেখে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করলে হবে না। কারণ, এখন আর ক্লাস্টার নয়, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে গেছে এবং সেটা স্বীকার করেছে সরকার। এ বিতর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘নতুন ভাইরাস কন্ট্রোল সার্ভিল্যান্স, ল্যাবরেটরি ম্যানেজমেন্ট–সবকিছু নিয়ে বৈজ্ঞানিক বিষয়ে বিতর্ক হবেই, তবে কাজ থেমে নেই।’ কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হচ্ছে বলে যদি স্বীকার করে নেওয়া হয়, তাহলে এতদিন ধরে যেভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে সেটি আর দরকার নেই জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাঈফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যে চারটি স্তর রয়েছে তার শেষ ও চতুর্থ ধাপে আমরা চলে গেছি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইনে বলা হয়েছে, যারা কেবল উপসর্গ নিয়ে আসবেন, কেবলমাত্র তাদেরকেই টেস্ট করা হবে।
যখন কেউ পজিটিভ হবেন তার আশেপাশের অর্থাৎ তার কন্টাক্ট ট্রেসিং করে এতদিন যে পরীক্ষা করা হয়েছে, সেটা আর এখন দরকার নাই, আমাদের স্ট্রাটেজি ( কৌশল) বদলাতে হবে। কারণ, কন্টাক্ট ট্রেসিং করা হয় একজন আক্রান্ত মানুষ আর কাকে কাকে সংক্রমিত করেছেন বা তার থেকে কতজন সংক্রমিত হয়েছেন সেটা জানার জন্য। কিন্তু যেহেতু এখন কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে গেছে তাই এখন আর এটা দরকার নেই। সামাজিক সংক্রমণ হয়ে গেছে, এখন কিভাবে রোগী শনাক্ত হবে বা এখনকার কৌশল কী হবে জানতে চাইলে, ‘এটা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে বলেই আইইডিসিআর এবং অন্যদের সঙ্গে সমস্যা হচ্ছে’ বলে মন্তব্য করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ( ইডিসিআর) এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন। ব্যাখ্যা দিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এর আগে ইনফ্লুয়েঞ্জার সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যে ‘পেন্ডেমিক প্রিপ্রার্য়াডনেস প্ল্যান’ তাতে বলা ছিল, যখন রোগ কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়বে তখন আর সব রোগীর পরীক্ষার প্রয়োজন নাই, তখন চিকিৎসা হবে লক্ষণ দেখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবারে এখনও প্রটোকল তৈরি করেনি। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া সংক্রমিত ক্লাস্টারে গণহারে টেস্ট করেছে- কিন্তু এই বিষয়টি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোনও লিখিত ডকুমেন্টে নেই, এটা চীনের উহানেও করা হয়নি, বলেন ডা. মুশতাক হোসেন। অথচ, সংস্থাটি এবারে বলছে টেস্ট, টেস্ট অ্যান্ড টেস্ট। কিন্তু, আক্রান্ত এলাকাতে লক্ষণ দেখে টেস্ট করা- এই স্ট্রাটেজির সঙ্গে তাদের আগের স্ট্রাটেজি ( যে কোনও পেন্ডেমিকের বা মহামারির সময় সবাইকে টেস্ট করার দরকার নেই) এর সঙ্গে একটা ক্ল্যাশ (বিরোধ) হচ্ছে।
করোনার কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টেস্ট করতে বলার বর্তমান প্রটোকল নাকি আগের প্রটোকল অনুসরণ করা হবে-এই নিয়েই এখন বিতর্ক হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, এখন দরকার ‘অ্যাকটিভ কমিউনিটি সার্ভিল্যান্স’ এর মাধ্যমে রোগী শনাক্ত করা, রোগীর কাছে ডাক্তার যাবে, ঘরে ঘরে না গিয়ে যদি টেস্টের বিষয়ে না বলা হয় তাহলে টেস্ট হবে না। তিনি বলেন, পেন্ডেমিক মোকাবিলা করতে হলে রিস্ক কমিউনিকেশন অ্যান্ড কমিউনিটি এনগেজমেন্ট ( আারসিসিই) এর মাধ্যমে অ্যাকটিভ কমিউনিটি সার্ভিল্যান্স করে ঘরে ঘরে গিয়ে সবার স্বাস্থ্য সমস্যার কথা শুনতে হবে। এতে করে স্যাম্পল কালেকশন বাড়বে, কেস ডিটেকশন বাড়বে, আইসোলেশন করে সংক্রমণের উৎস নির্মূল করতে হবে, নয়তো এই লকডাউন দিয়ে কাজ হবে না। লকডাউন তুলে নিয়েও তখন রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে বলে দেখা যাবে। এদিকে, আইসিডিডিআর, বির এপিডেমিক কন্ট্রোল প্রিপার্য়াডনেস প্রোগ্রামের সাবেক ইউনিট প্রধান ও রোগতত্ত্ববিদ ডা. আনোয়ারুল হক মিতু বলেন, আমি টেস্টের পক্ষে, যতটুকু সম্ভব হবে ততটুকু টেস্ট করা উচিত, কারণ টেস্ট না করা হলে বোঝা যাবে না কতখানি ছড়িয়েছে। পেন্ডেমিক ঘোষণা হলে পরীক্ষা করার দরকার রয়েছে কিনা জানতে চাইলে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ( আইইডিসিআর) এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, কিছু কিছু জায়গাতে যেখানে এখনও রোগী নেই কিংবা সংখ্যায় অনেক কম সেখানে পরীক্ষার দরকার আছে। আবার করোনার লক্ষণ নিয়ে মারা যাওয়ার পরেও তাদের স্যম্পল পরীক্ষা হচ্ছে কারণ, তাদের কোভিড-১৯ হয়েছিল কিনা সেটা নিয়ে সবার মধ্যে দ্বিধা থাকছে-এ দ্বিধা দূর করার জন্যও টেস্ট করা হচ্ছে। আর টেস্ট করতে হবে সার্ভিল্যান্সের অংশ হিসেবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, টেস্ট করতে হবে ‘এস্টিমেশন’ এর জন্য, যাদের কোভিড-১৯ বলে ভাবছি তাদের কতো শতাংশ কোভিড-১৯ সেটা বের করার জন্য। পাশাপাশি সার্ভিল্যান্স কার্যক্রমের জন্য বার্ডেন কতখানি, রোগটা কতখানে ছড়াচ্ছে-এগুলো বোঝার জন্য কিছু টেস্টের প্রয়োজন আছে, যেটা নারায়ণগঞ্জের মতো ছড়িয়ে যাওয়া এলাকাতে দরকার নেই, বলেন তিনি।