জ্বালানি তেলের রেকর্ড উত্তোলন হ্রাসের পথে ওপেক প্লাস

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজার চাঙ্গা করতে রূপরেখা তৈরির পরিকল্পনায় বসেছে অর্গানাইজেশন অব পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ (ওপেক) ও জোটের মিত্র দেশগুলো। বৃহস্পতিবার এক ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে আলোচনায় বসে পণ্যটির শীর্ষ উত্তোলনকারী দেশগুলোর জ্বালানিমন্ত্রীরা। এদিন ওপেকভুক্ত দেশ, রাশিয়া এবং অন্য সহযোগী দেশগুলো জ্বালানি পণ্যটির উত্তোলন সক্ষমতার এক-পঞ্চমাংশের বেশি কমানোর বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ জোটের বাইরের অন্য দেশগুলোও এ প্রচেষ্টায় যুক্ত হবে। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হবে কিনা, তা নির্ভর করছে মেক্সিকোর সম্মতির ওপর। গতকাল শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ওপেক প্লাস জোটের আলোচনা অব্যাহত ছিল। খবর রয়টার্স ও এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্লাটস।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ওপেক প্লাসের দেশগুলো আগামী দুই মাসে (মে ও জুন) দৈনিক গড়ে ১ কোটি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলন কমিয়ে আনার ব্যাপারে একমত হয়েছে, যা জ্বালানি পণ্যটির মোট বৈশ্বিক সরবরাহের ১০ শতাংশ। জোটটি প্রত্যাশা করছে, দশকের গভীরতম জ্বালানি তেল সংকট মোকাবেলায় অন্য শীর্ষ উত্তোলনকারী দেশগুলো পণ্যটির সম্মিলিত উত্তোলন দৈনিক আরো ৫০ লাখ ব্যারেল কমিয়ে এনে তাদের সাহায্য করবে।
২০১৭ সাল থেকে জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার টানা দরপতনের মুখে রয়েছে, যা সাম্প্রতিক সময়ে এসে চরম আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে চলতি দশকের সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে জ্বালানি পণ্যটির বাজার, যার পেছনে মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে বিশ্বজুড়ে নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপ। এছাড়া মার্চের শুরুর দিকে ওপেক প্লাসের ব্যর্থ বৈঠক এক্ষেত্রে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত ওই বৈঠক রাশিয়ার আপত্তিতে চুক্তি ছাড়া ভেস্তে যায়। এর পর পরই সৌদি আরব ও রাশিয়ার মধ্যে শুরু হয় মূল্যযুদ্ধ, যার প্রভাব পড়ে জ্বালানি পণ্যটির দামে।
নভেল করোনাভাইরাস বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশে হানা দিয়েছে। কোনো প্রতিষেধক না থাকায় ভাইরাসটির সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা। ফলে ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে দেশে দেশে চলছে লকডাউন। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ ঘরে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে ভেঙে পড়েছে আকাশ, স্থল ও নৌপথসহ বৈশ্বিক পরিবহন ব্যবস্থা। স্থবির হয়ে পড়েছে বিভিন্ন শিল্প খাত। দেশে দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতির সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে জ্বালানি তেলের বাজারে। চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এরই মধ্যে জ্বালানি পণ্যটির বৈশ্বিক চাহিদা দৈনিক গড়ে ৩ কোটি ব্যারেল কমে গেছে, যা পণ্যটির মোট বৈশ্বিক সরবরাহের ৩০ শতাংশ।
এদিকে বৈশ্বিক চাহিদা কমায় চাপ বেড়েছে পণ্যটির দামে। গত মাসে আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের দাম কমে ১৮ বছরের সর্বনিম্নে নেমে গিয়েছিল। সর্বশেষ কার্যদিবসে পণ্যটির প্রতি ব্যারেলে দাম দাঁড়িয়েছে ৩২ ডলার, যা ২০১৯ সালের শেষের দিকের তুলনায় অর্ধেক। একই পরিস্থিতি বিদ্যমান যুক্তরাষ্ট্রের বাজার আদর্শ ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) বাজারেও।
বৃহস্পতিবার বৈঠক শেষে সৌদি আরবের বাদশাহ প্রিন্স আব্দুল্লাহ বিন সালমান, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আলাদা ফোন কলে জ্বালানি তেলের বাজার চাঙ্গা করতে উত্তোলনকারী দেশগুলোর সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্কের গুরুত্বের বিষয়ে আলোচনা করেছেন বলে জানা গেছে। রাশিয়ার সরকারি দপ্তর ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ও পণ্যটির দাম কমার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
তবে ওপেক প্লাসের পক্ষ থেকে এ কথাও জানানো হয়েছে, চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়া মেক্সিকোর সম্মতির ওপর নির্ভর করছে। দেশটি চুক্তি অনুযায়ী জ্বালানি তেলের উত্তোলন হ্রাসে আপত্তি জানিয়েছে।
এ বিষয়ে সৌদি আরবের জ্বালানিমন্ত্রী প্রিন্স আব্দুলআজিজ বিন সালমান আল সৌদ বলেন, তিনি আশা করেন শুধু নিজেদের কথা না ভেবে মেক্সিকো সারা বিশ্বের কথা ভাববে। পুরো চুক্তিটি দেশটির সম্মতির ওপর ঝুলছে।
অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের উত্তোলন হ্রাসসংক্রান্ত চুক্তির আলাপকালে, মেক্সিকো পরবর্তী দুই মাসে জ্বালানি পণ্যটির উত্তোলন দৈনিক গড়ে এক লাখ ব্যারেল কমিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছে। দেশটির জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চে মেক্সিকো দৈনিক গড়ে ১৭ লাখ ৮১ হাজার ব্যারেল জ্বালানি তেল উত্তোলন করেছিল। এর তুলনায় এক লাখ ব্যারেল কমিয়ে আগামী দুই মাসে দৈনিক গড়ে ১৬ লাখ ৮১ হাজার ব্যারেল উত্তোলনের পরিকল্পনা করেছে দেশটি। ওপেক জোটের চুক্তি চূড়ান্ত হলে দেশটিকে দৈনিক গড়ে চার লাখ ব্যারেল করে জ্বালানি তেল উত্তোলন কমিয়ে আনতে হবে।
ওপেক প্লাসের নথি অনুযায়ী, জোটটি আগামী মে ও জুনে দৈনিক গড়ে এক কোটি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলন কমিয়ে আনতে পারে। জোটের সব সদস্য মোট সক্ষমতার ২৩ শতাংশ করে উত্তোলন কর্তন করবে। এর মধ্যে সৌদি আরব ও রাশিয়া প্রত্যেকেই আলাদাভাবে পণ্যটির উত্তোলন কমাবে দৈনিক গড়ে ২৫ লাখ ব্যারেল এবং ইরাক একা কমাবে দৈনিক গড়ে ১০ লাখ ব্যারেল।
এছাড়া পরিকল্পনার আওতায় ওপেক প্লাস আগামী জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দৈনিক গড়ে ৮০ লাখ ব্যারেল করে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলন কমিয়ে আনতে পারে। এছাড়া ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত জোটটি পণ্যটির উত্তোলন দৈনিক গড়ে ৬০ লাখ ব্যারেল কমিয়ে আনতে পারে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তেল উত্তোলন সৌদি আরব ও রাশিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে। ওপেক প্লাসের আলোচনায় দেশটিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তবে দেশটি এতে অংশগ্রহণ করেছিল কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এর বাইরে ব্রাজিল, কানাডা ও নরওয়েও আমন্ত্রিত ছিল।
তবে যুক্তরাষ্ট্র এ মুহূর্তে জ্বালানি তেলের উত্তোলন হ্রাস করার বিষয়ে কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হয়নি। দেশটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্বাভাবিকভাবেই আগামী দুই বছর দেশটিতে জ্বালানি পণ্যটির উত্তোলনে মন্দা ভাব বজায় থাকতে পারে। সৌদি আরবের জ্বালানিমন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রাজিলের মতো দেশগুলো নিজস্ব নীতি অনুযায়ী অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের উত্তোলন হ্রাসে ভূমিকা রাখবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস জানিয়েছে, নভেল করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর জের ধরে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদা ব্যাপক হারে কমে গেছে। এছাড়া জ্বালানি পণ্যটির সরবরাহ চক্র ভেঙে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে শীর্ষ উত্তোলনকারীদের দ্বারা দৈনিক গড়ে এক কোটি ব্যারেল উত্তোলন হ্রাস জ্বালানি পণ্যটির বাজার চাঙ্গা করতে যথেষ্ট নয়। সংস্থাটির একটি সাম্প্রতিক নোটে বলা হয়, মহামারীর জেরে জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদা এতটাই কমেছে যে শীর্ষ উত্তোলক ও রফতানিকারক দেশগুলোর সমন্বিত সরবরাহ হ্রাসের তুলনায় এর পরিমাণ অনেক বেশি।