একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ সন্ধ্যায় সিলেটের আকাশ ভেঙে শুরু হলো বৃষ্টি। কানায় কানায় পূর্ণ গ্যালারির দর্শকরা ছুটতে শুরু করলেন এদিক ওদিক। আবার কেউ কেউ উপভোগ করলেন জলের ছোঁয়া। তবে এক মুহূর্তও থামেনি ‘মাশরাফি’, ‘মাশরাফি’ ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ চিৎকারের ধ্বনি। সকাল থেকেই এই চিত্র সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগান ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। দুপুর ২টায় খেলা শুরু। কিন্তু ১০টা থেকেই মাশরাফি বিন মুর্তজার নাম ধরে স্লোগান দিয়ে মাঠে আসতে শুরু করেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। সেই ভিড় ঠেকাতে নেয়া হয় বাড়তি নিরাপত্তাও। তবে দেশের সেরা অধিনায়কের প্রতি ভালোবাসার জোয়ার আটকানো বেশ কঠিন হয়। যারা টিকিট পাননি তারা ভিজেই অপেক্ষা করেছেন বাইরে। কারণ তাদের প্রিয় মাশরাফি এই ম্যাচেই ইতি টানছেন অধিনায়কত্ব অধ্যায়ের। এ কারণেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ ও সিলেট অনেকটা জায়গা করে নিবে টাইগারদের ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসেও। অধিনায়ক হিসেবে শেষ টস করলেন তিনি। যদিও তিনি এখনো অবসর নেননি। তবে তাকে আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই ক্ষীণ। রাজনীতিতে আসার পর তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে। তবে তার শেষটা ক্রিকেটপ্রেমীরা আরো একবার রাঙিয়ে দিয়েছেন অকৃত্রিম ভালোবাসায়। সিলেটে বাংলাদেশ ক্রিকেটে তার নেতৃত্ব অধ্যায়ের ইতি হলো ভালোবাসার বৃষ্টিতে সিক্ত হয়েই।
প্রথম দুই ম্যাচেই জয় দিয়ে সিরিজ নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু দর্শকদের এই সিরিজের ফলাফল নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি শুরু থেকেই। শুধু আলোচনায় ছিল মাশরাফির নেতৃত্ব ও অবসর। প্রথম দুই ম্যাচে টাইগাররা দাপুটে জয় পেলেও গ্যালারি ছিল প্রায় দর্শকশূন্য। তবে শেষ ম্যাচের আগেই মাশরাফি নেতৃত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে দিলেন। তাতেই বদলে গেল দৃশ্যপট। শুধু সিলেটই নয় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রিকেটভক্তরা আসতে শুরু করেন। কেউ ম্যাচের আগের রাতে কেউবা সকালে সরাসরি মাঠে চলে আসেন। টিকিট নিয়ে শুরু হয় হাহাকার। সকালে স্টেডিয়ামের প্রধান ফটকে মাশরাফি…মাশরাফি… স্লোগান দিয়ে তার অপেক্ষা করতে থাকেন ভক্তরা। সেই সময় তাদের হাতে ছিল বাংলাদেশের পতাকা ও প্রিয় অধিনায়কের ছবি। দুপুরে ক্রিকেটারদের নিয়ে গাড়ি প্রবেশ করে স্টেডিয়ামে। সেই সময় থেকে বাড়তে থাকে উত্তেজনা। গ্যালারির দিকে তাকে দেখার জন্য ছুটতে শুরু করে ভক্তরা। দুপুর দেড়টায় তিনি মাঠে আসেন টস করতে। হাসি মুখেই আকাশে ছুড়লেন তিনি টস কয়েন। তার স্বভাবসুলভ আচরণে বোঝার উপায় নেই দিনটা তার অন্যরকম এক বিদায়ের। মাঠেই ছবি ও ধারাভাষ্যকারদের আবদারে হাসতে হাসতে সেলফি তুললেন। সেই সময় কথা বলেন নিজের শেষ একাদশ নিয়ে। তবে শেষটায় তার মনের মতো একাদশ পাননি। রাখতে পারেননি দীর্ঘদিনের সতীর্থ মুশফিকুর রহীমকে। সেই বেদনার কথা সরাসরি জানিয়েছেন সংবাদ সম্মেলনেও। তবে বিসিবির নয়া নীতির কাছে তিনি হেরে গেছেন। এর আগে তার হাত ধরেই বাংলাদেশ ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে দুই তরুণের। নাইম শেখ এবং আফিফও চেয়েছিলেন এমনটাই। তারা এই ম্যাচে সুযোগ পাওয়ার পর বলেছিলেন মাশরাফির একাদশে খেলার তাদের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। নিয়ম অনুসারে একাদশে শেষ স্বাক্ষরও করেছেন তিনি। তবে হয়তো সেখানে ছিল লুকানো দীর্ঘশ্বাস।
২০০১-এ বাংলাদেশ ক্রিকেটে পেসার হিসেবে জায়গা করে নেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ২০০৯-এ টেস্ট দলের নেতৃত্ব পান তিনি। কিন্তু ইনজুরিতে শেষ হয়ে যায় তার সেই স্বপ্ন। এক বছর পর ওয়ানডে দলের নেতৃত্বও পেয়েছিলেন। কিন্তু মাত্র ৭ ম্যাচ পর আবারো ইনজুরি। এই পেসারের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষের নামটাই হলো ইনজুরি। তবে ২০১৪-তে ফের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক হয়ে ফিরে আসেন। সে সময়টা বাংলাদেশ ক্রিকেটের হারের ভারে দেয়ালে পিঠ ঠেকার অবস্থা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টাইগারদের যোগ্যতা নিয়ে শুরু হয়েছিল আলোচনা-সমালোচনা। কিন্তু নিজের নেতৃত্বে ফিরে আসার সিরিজে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দলকে জয়ের বন্দরে ফেরান। এরপর টাইগারদের ক্রিকেট ইতিহাস বদলে যায় অনেকটা রূপকথার মতোই। ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয় পায়। ২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে চমকে দেয় সবাইকে। প্রায় প্রতিটি দলই বাংলাদেশকে অন্যভাবে সমীহ করতে শুরু করে। এ সময়ে ৮০ ওয়ানডে ম্যাচে তার নেতৃত্বে আসে ৪৯ জয়। ২৮ টি-টোয়েন্টিতে দলকে ১০ জয় এনে দেন। সবার আগে তিনি বিদায় জানান টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে। ২০১৭ সালের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কাতে কোচ ও বোর্ডের অদৃশ্য চাপে অবসরের ঘোষণা দেন এই ফরম্যাট থেকে। এবারো তার ওয়ানডে অবসর নিয়ে তৈরি হয় ভীষণ চাপ। জানা গিয়েছিল গেল বছর ইংল্যান্ড বিশ্বকাপেই তিনি মাঠের ক্রিকেটকে বিদায় জানাবেন। কিন্তু তা হয়নি। সেখান থেকে তার পারফরম্যান্স, রাজনীতি সব কিছু নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। শোনা যাচ্ছিল দেশের মাটিতেই দিবেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আসরের ঘোষণা। তাও উড়িয়ে দিলে ফের চলতে থাকে সমালোচনা। অবশেষে চাপের মুখেই নেতৃত্ব ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বিদায় ভালোবাসার মহানায়কের বিদায় ওয়ানডে অধিনায়ত্বের।