করোনা মোকাবিলা : পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ চীনের করোনা ভাইরাসে প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। চীনসহ বিশ্বের ২৬টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাস (২০১৯-এনসিওভি)। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত কাউকে পাওয়া না গেলেও প্রতিরোধী বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। চীন থেকে আসা বর্তমানে ৩০০ জনকে হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। একজন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও ১১ জন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা মানসম্পন্ন কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা নয়। যদিও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) নিশ্চিত করছে বাংলাদেশে কেউ আক্রান্ত নয়। তাদের মতে, এ ব্যবস্থাপনায় একসঙ্গে অনেক মানুষ রাখা হয়েছে।
যারা একই টয়লেট ব্যবহার করছেন, একই সঙ্গে খাবার খাচ্ছেন। যা এ ধরনের রোগ নিয়ন্ত্রণে এ ব্যবস্থা মোটেও উপযুক্ত নয়। কেননা কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থাপনায় সর্বোচ্চ ছয়জনকে একসঙ্গে বা জীবাণুমুক্ত এক রুমে রাখা যায় বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এছাড়া এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ না করায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। চীন ফেরত ১৫০ জন যাত্রী ১লা ফেব্রুয়ারি পরীক্ষা ছাড়াই বিমানবন্দর ত্যাগ করেন বলে এক যাত্রী তথ্য প্রকাশ করেছেন। এ তথ্য উল্লেখ করে বৃহস্পতিবার সংসদে এ বিষয়ে মন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করা হয়েছে। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেন, কোয়ারেন্টাইনে সর্বোচ্চ চার থেকে ছয়জনকে একসঙ্গে রাখা যায়। এর বেশি হলে সেটা আর কোয়ারেন্টাইন নয়। আর এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুসারে এপিডেমিওলজিস্ট, ভাইরোলজিস্ট, এনভায়রনমেন্টাল, মেডিসিন স্পেশালিস্টের সমন্বয়ে একটি টিম করে কাজ করা উচিৎ। বিএসএমএমইউ’র অপর একজন ভাইরোলজিস্ট মনে করেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে সঠিক কোয়ারেন্টাইন করা সম্ভব না।
বিএসএমএমইউ’র ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এসএম রাশেদ-উল-ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, কোয়ারেন্টাইন হলো সুস্থ মানুষের জন্য, তাদেরকে আলাদা জায়গায় রাখা। যারা কোন একটি রোগের প্রার্দুভাব এলাকা থেকে এসেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী তাদেরকে ১ মিটার দূরত্বে রাখতে হবে। যেন হাঁচি-কাশির মাধ্যমে রোগটি না ছড়ায়। মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ভালোভাবে ধোয়া। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, এ ধরনের রোগ ভবিষ্যতে লেগে থাকতে পারে। তাই এই ধরনের রোগীর জন্য ভবিষ্যতে বিশেষশায়িত হাসপাতাল থাকতে হবে। এর আগে এক সেমিনারে জাপানে চিকিৎসা বিজ্ঞানী ড. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর বলেছিলেন, চীন থেকে আগত ৩০২ বাংলাদেশিকে যেভাবে হজক্যাম্পে রাখা হয়েছে সেটা কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা নয়। কোয়ারেন্টাইনে প্রত্যেককে পৃথকভাবে রাখাতে হয়। একজন আরেক জনের সংস্পর্শে না এসে যেন প্রত্যেকেই নিরাপদে থাকতে পারে। সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়। তাছাড়া তারা একই টয়লেট ব্যবহার করছেন। একই সঙ্গে খাবার খাচ্ছেন। যা কোয়ারেন্টাইনের স্বাভাবিক পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করে। ঢাকার মতো শহরে এ ধরনের রোগ ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। কিন্তু ভিন্ন মতামত জানানো হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী হয়েছে। দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করেই এ ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়। অর্থাৎ আমেরিকা বা ইউরোপের কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা আর আমাদের ব্যবস্থা এক হবে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মূল্যায়নে ঝুঁকির মাত্রা চীনে অতি উচ্চ, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উচ্চ এবং সারা বিশ্বে উচ্চ। চীনের সব রোগীদের মধ্যে ৯৭ শতাংশ হুবেই প্রদেশের। রোগীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই ৬০ বছরের বেশি বয়সী, ৭৫ শতাংশ রোগী অন্যান্য রোগেও আক্রান্ত, মৃত্যুবরণকারীদের দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষ। মারা গেছে ৫৬৩ জন। বাংলাদেশ পরিস্থিতি-সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কাউকে শনাক্ত করা যায়নি বলে জানিয়েছেন, আইইডিসিআর’র পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। তিনি আরো বলেন, আশকোনা হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রে ৭টি ডরমিটরিতে চীন ফেরত ৩০০ জন অবস্থান করছেন। চিকিৎসাসেবা ও নার্সিং সেবা কার্যক্রমে সেনা কর্তৃপক্ষেও মেডিক্যাল সার্ভিস পুরোটাই সহায়তা দিচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা সব ওষুধ সরবরাহ করছে। জরুরি প্রয়োজনে তাৎক্ষণিকভাবে ওষুধ কেনা হচ্ছে। আইইডিসিআর যাত্রীদের স্বাস্থ্যসেবা ছাড়াও যাত্রীদের রোগতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহ করছেন। সামরিক বাহিনীর মিলিটারি পুলিশ কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন। তাছাড়া এ উদ্দেশ্যে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৩০ শয্যার আইসোলেশন শাখা খোলা হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রণালয় সবার খাবার, শিশু খাদ্য, শিশুদের ডায়াপার ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করছে। ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হজ অফিস কোয়ারেন্টাইন ভবনের সার্বিক ব্যবস্থাপনা করছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মশক নিধনসহ ক্যাম্পের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা বাংলাদেশ পুলিশ কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রের চারপাশে নিরাপত্তা দিচ্ছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চীনে অবস্থিত বাংলাদেশের নাগরিকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন জ্বরে আক্রান্ত এক শিশুকে বাবা-মাসহ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তাদের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআর-এ পাঠানো হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানা যায়, জেলা পর্যায়ে আইসোলেশন ওয়ার্ড প্রস্তুত করা হচ্ছে। সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আইসোলেশন কক্ষ প্রস্তুত হচ্ছে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকার সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীর জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এদিকে, আশকোনা হজ ক্যাম্পের ডরমিটরিতে কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রে অবস্থান করা চীন ফেরত যাত্রীরা মোবাইল ফোন, ইমেইল ও ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে তাদের স্বাস্থ্যগত অসুবিধার কথা স্বাস্থ্য অধিপ্তরের কর্মকর্তাদের জানাতে পারছেন। তবে শুরুর দিকে এসব যাত্রীদের মধ্যে থেকে গ্রুপ লিডার বাছাই করে তার মাধ্যমে অন্যদের বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হতো। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় সঠিক তথ্য পাওয়ার বিষয়ে সমস্যা দেখা দেয়। এ কারণে যাত্রীদের প্রত্যেকেই যেন তাদের নিজেদের সমস্যার বিষয়ে প্রতিদিন জানাতে পারেন সেজন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোন, ইমেইল ও মেসেঞ্জার সেবা চালু করে। ফলে কোয়ারেন্টাইনে থাকা প্রত্যেকেই নিজ নিজ সমস্যা সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের খুব সহজে অবহিত করতে পারছেন। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগের সুযোগ পেয়ে চীন ফেরত যাত্রীরা খুব খুশি। অন্যদিকে, হজ ক্যাম্পে থাকা চীন ফেরতদের বিষয়ে নিয়মিত প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে মহাখালীস্থ সরকারের আইইডিসিআর অফিস। বৃহস্পতিবার থেকে এই কার্যক্রম শুরু হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ১লা ফেব্রুয়ারি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিশেষ ফ্লাইটে চীনের উহান প্রদেশ থেকে ৩১২ জন বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে তাদেরকে আশকোনা হজ ক্যাম্পে ১৪ দিনের জন্য নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। গত ২১শে জানুয়ারি থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত চীন ও বিভিন্ন দেশ হয়ে চীনা নাগরিকসহ সর্বমোট ৭ হাজার ৯১০ জন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। এ পর্যন্ত ৫০ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। কারো করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়নি বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর।