নিখোঁজ দুই প্রকৌশলীর লাশ উদ্ধার, তদন্তে নেমেছে পিবিআই

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় নিখোঁজ হওয়া বাংলা ক্যাট কোম্পানির দুই প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান জিসানের লাশ উদ্ধারের একদিন পর লিখন সরকারের লাশও উদ্ধার করা হয়েছে। শনিবার (১১ জানুয়ারি) দুপুর দেড়টায় মুন্সীগঞ্জ জেলার সদর থানা এলাকায় ধলেশ্বরী নদী থেকে লাশটি উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে শুক্রবার একই জেলার ধলেশ্বরী নদী থেকে নিখোঁজের চারদির পর উদ্ধার হয় প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান জিসানের লাশ। দুই প্রকৌশলীর লাশ উদ্ধারের ঘটনার তদন্তে নেমেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) নারায়ণগঞ্জ। নিহত জিসানের স্বজনদের কাছ থেকে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর পরিদর্শক নাসির উদ্দিনের নের্তৃত্বে একটি টিম শনিবার মুন্সীগঞ্জে গিয়ে লাশের সুরতহালসহ পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। পাশাপাশি বাংলা ক্যাট কোম্পানির প্রশাসনিক কর্মকর্তা (হেড অব সিকিউরিটি অ্যান্ড সেফটি) আশিক মাহমুদ ও বুড়িগঙ্গা এন্টাপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সজীব ও তার কর্মচারী পায়েলের সঙ্গে মোবোইল ফোনে যোগাযোগ করেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তদন্তের বিষয়টি স্বীকার করে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘বিভিন্ন গণমাধ্যমে জানতে পেরে আমরা থানা পুলিশের পাশাপাশি স্বপ্রণোদিত হয়েই তদন্ত শুরু করেছি। যেহেতু বিষয়টি স্পর্শকাতর, দুই জন প্রকৌশলী পাঁচ ছয় দিন নিখোঁজ থাকার পর তাদের লাশ উদ্ধার হয়েছে, তাই অমি নিজেই ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ দেখেছি। পারিপার্শ্বিক অবস্থা খতিয়ে দেখেছি।’ পিবিআইয়ের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জে গিয়ে আমি নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের অভিযোগগুলো গুরুত্ব সহকারে নিয়ে আমরা সব বিষয় খতিয়ে দেখছি। কোনও আলামত যেন নষ্ট না হয়ে যায়, সেই বিষয়টিও আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। পাশাপাশি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বুড়িগঙ্গা এন্টারপ্রাইজের মালিক সজীব, তার কর্মচারী পায়েল ও বাংলা ক্যাটের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আশিক মাহমুদের সঙ্গেও আমি কথা বলেছি। ভিকটিম পরিবার যদি মামলা করে আর যদি আমাদেরকে তদন্তভার দেওয়া হয়, তাহলে আমরা সরাসরি তদন্ত করবো। তার আগে থেকেই আমরা সেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিষয়টি হত্যাকাণ্ড কিনা, সেটা দুই জনের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। এর আগ পর্যন্ত আমরা নিহত দুই জনের মোবাইল ফোনের কললিস্ট পর্যবেক্ষণ করবো। ঘটনার কয়েক দিন আগে থেকে কাদের সঙ্গে তাদের বেশি কথা হয়েছে সেই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবো। কারও সঙ্গে শত্রুতা আছে কিনা, সেটিও আমাদের তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে।’
মুন্সীগঞ্জ সদর থানা পুলিশের ওসি মো. আনিচুর রহমান জানান, শনিবার দুপুরে ক্রাউন সিমেন্ট কারখানার কাছাকাছি ধলেশ্বরী নদীর তীরে লিখন সরকারের লাশটি ভেসে উঠলে স্থানীয়রা পুলিশকে জানায়। পরে মুন্সীগঞ্জ সদর থানা পুলিশ ও নৌথানা পুলিশ যৌথভাবে লাশটি উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। খবর পেয়ে নিহত লিখন সরকারের স্বজনেরা গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন। সুরতহালে নিহতের শরীরে আঘাতের তেমন কোনও চিহ্ন এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে দীর্ঘ ছয়দিন নদীতে থাকার কারণে লাশে পচন ধরেছে। স্বজনদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মুন্সীগঞ্জ সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে এটি হত্যাকাণ্ড নাকি দুর্ঘটনা। ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হলে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এর আগে শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) সকাল ১১টায় নিখোঁজের পাঁচদিন পর লিখন সরকারের সহকর্মী বাংলা ক্যাট কোম্পানির প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান জিসানের পেট কাটা লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। শুক্রবার সকাল ১১টায় মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান এলাকায় ধলেশ্বরী নদী থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। পরে মুন্সীগঞ্জ সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে জিসানের লাশ শনিবার বিকাল সাড়ে চারটায় তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। স্বজনেরা জানান, লাশ গ্রামের বাড়ি রাজশাহী জেলার বোয়ালিয়া থানার সুলতানাবাদ এলাকায় নিয়ে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।
লাশ বুঝে নেওয়ার পর জিসানের বড় ভাই মো. শোয়েব আহমেদ জানান, জিসানের লাশ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়নি। তার দাবি, মরদেহের মুখমন্ডলে কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন এবং পেট কাটা ছিল। মুখ এবং পেট দিয়ে রক্তক্ষরণের আলামত দেখা গেছে। তাই এটি হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করে জিসানের বড় ভাই শোয়েব আহমেদ প্রশাসনের কাছে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চেয়েছেন। শোয়েব আহমেদ আরও বলেন, ‘আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রয়োজনে আমরা মামলা করবো। যারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে, তাদের দ্রুত গ্রেফতার চাই।’ জিসানের মামা শওকত আল হোসাইন দাবি করেন, নদীতে ডুবে তার মৃত্যু হয়নি। জিসানকে হত্যা করা হয়েছে। যেহেতু তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের ক্ষত চিহ্ন পাওয়া গেছে, তাই এটি স্পষ্টভাবে হত্যাকাণ্ড বলে মনে হচ্ছে। আমার ভাগিনার লাশ আমরা অক্ষত পাইনি। জিসানের মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়েছে, পেট কাটা রয়েছে ও সেখান দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। আমার ভাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করছি।
উল্লেখ্য, ৫ জানুয়ারি দিনগত রাতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার রাজাপুর এলাকায় বুড়িগঙ্গা এন্টারপ্রাইজের ভেকু মেরামতের কাজ শেষ করে ফেরার পথে নিখোঁজ হন বাংলা ক্যাট কোম্পানির দুই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুর রহমান জিসান ও লিখন সরকার। এ ঘটনায় জিসানের স্ত্রী রাকিয়া সুলতানা ঢাকার আশুলিয়া থানায় বাদী হয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। তবে জিসানের পরিবার শুরু থেকেই দাবি করে আসছে, এ ঘটনার সঙ্গে ফতুল্লার রাজাপুর এলাকার বুড়িগঙ্গা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সজীব ও তার কর্মচারী পায়েল দায়ী। তাদের দাবি, সজীব ও পায়েল ঘটনার বিষয়ে সবকিছু জানেন। কেননা জিসান ও লিখন নিখোঁজের বিষয়টি সজীব একদিন গোপন রেখেছেন এবং তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে বিভিন্ন সময়ে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন। এছাড়া সজীবের বড় ভাই ওই এলাকার ইউপি মেম্বার। সেই প্রভাবে সজীব বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাদের দুই জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ঘটনার রহস্য বের হয়ে আসবে বলে মনে করছেন নিহত জিসানের স্বজনেরা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফতুল্লা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আসলাম হোসেন জানান, জিসানের মরদেহের মুখমন্ডলে হালকা ক্ষত চিহ্ন পাওয়া গেছে। নদীর তলদেশে দীর্ঘসময় থাকার কারণে রক্তক্ষরণ হতে পারে। পরিবারের দাবির বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর নিশ্চিত করে বলা যাবে হত্যাকাণ্ড কিনা। তারপরও আমরা সব দিক থেকে তদন্ত করে যাচ্ছি। জিসানের স্বজনদের উপস্থিতিতেই বুড়িগঙ্গা এন্টারপ্রাইজের মালিক সজীব ও তার কর্মচারী ট্রলার চালক পায়েলকে থানায় ডেকে এনে আমি জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তাদের ব্যাপারে আমরা খতিয়ে দেখছি। যদি এ ঘটনায় কেউ জড়িত থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাহফুজুর রহমান জিসান ও লিখন সরকার দুজনই পরিবার নিয়ে রাজধানীর আশুলিয়া থানার ভেন্ডাবর এলাকায় একই মালিকের বাড়িতে ভাড়া বাসায় থাকতেন। জিসানের তিন বছর ও তিন মাস বয়সী দুইটি ছেলে রয়েছে।