ধানের দানায় বেঁচে থাকার গল্প

0

আসিফ কাজল, ঝিনাইদহ॥ দুপুরের রোদটা তখন নরম হয়ে এসেছে। কাঁচা সোনালি আলো গড়িয়ে পড়েছে গ্রামের পাকা রাস্তায়। রাস্তার দুই ধারে খেজুরগাছের সারি, পেছনে বিস্তীর্ণ সবুজ ধানক্ষেত। আমগাছের ছায়াতলে বসে দুই নারী, বয়স পেরিয়েছে মধ্য চল্লিশ। পাথরের মতো পেটানো শরীর। সামনে ছেঁড়া বস্তার উপর মুঠোভর্তি ধান, মাথায় পুরনো ওড়না, চোখে শান্ত স্থিরতা। তারা দুইজন ধান ওড়াচ্ছেন।

কৃষকেরা মাঠ থেকে ধান কেটে নিয়ে গেছেন। কিন্তু জমিতে থাকা ইঁদুরের গর্তে কিংবা পরিত্যক্ত বিচুলির স্তূপে পড়ে থাকে ধানেরু দানা কুড়িয়ে নিচ্ছেন বাগদী সম্প্রদায়ের দুই নারী। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তারা মাঠে মাঠে ঘুরে ধানের দানা সংগ্রহ করেন।

তাদের পরিচয় বাগদী। কারো বাড়ি বৈডাঙ্গা বাজার আবার কারো সাধুহাটী ইউনিয়নে। যাযাবর জীবনের উত্তরাধিকারিণী এই সম্প্রদায়ের মানুষ একসময় তাঁবু টাঙিয়ে নদীপাড়ে থাকতেন, আজ থিতু হয়েছেন গ্রামের মাটিতে। তবু তাদেন জীবন নদীর স্রোতের মতোই চলমান অভাব। সংসারের অভাব অনটন মেটাতে নেমেছেন ধান কুড়ানোর জীবনে।

তার পাশে বসে আছেন আরেক নারী সুনিলা দেবী। তিনিও একই সংগ্রামে নিমগ্ন। দুজনের হাতের মুঠোয় এক এক মুঠো ধান। কিন্তু সেই মুঠোয় লুকিয়ে আছে জীবনের প্রতিটি দিন পার করার অদম্য জেদ। রোদে ঝলসানো মুখে তাদের ঘাম ঝরে, কিন্তু ক্লান্তি নেই। ছেঁড়া বস্তার উপর থেকে উড়ে যাচ্ছে খড়ের কণা, তবু তাদের চোখে আলো। এ আলো ধানের নয়, যেন টিকে থাকার।

জীবনা গ্রামের কৃষক আনছার উদ্দীন জানান, “ওরা কারো কাছে কিছু চায় না। মাঠে যা পড়ে থাকে তাই কুড়িয়ে বাঁচে। এই মানুষগুলোর হাতে যশ আছে, পরিশ্রম আছে।” তাদের টিকে থাকার লড়াই বড়ই কঠিন। সারাদিন হয়তো ৬/৭ কেজি করে ধান সংগ্রহ করে। সেটাই তাদের কাছে মহামুল্যবান।

বংকিরা গ্রামের কৃষক বাবুল বিশ্বাস জানান, গ্রামীণ বাংলার নিঃশব্দ প্রান্তে এমন হাজারো নারী প্রতিদিন বাঁচার গল্প আছে। কারও কাছে তা হয়তো খবর নয়, কিন্তু এদের পরিশ্রমই গ্রামীণ সমাজের আসল প্রেরণা। তাদের জীবন সংগ্রমী ও লড়াইয়ের।

বাগদী দুই নারীর নাম সুনিলা দেবী ও লক্ষি রানী। তারা জানালেন মাস খানেক আগে বিল খালে মাছ ধরতেন। এখন নবান্ন শুরু হওয়ায় কৃষকের ক্ষেত থেকে পরিত্যক্ত ধান কুড়াচ্ছেন। বাতাসে উড়ে যাওয়া প্রতিটি বিচুলি বা খড়ের গন্ধে মিশে থাকে তাদের বেঁচে ধাকার ঘ্রাণ, অদম্য অবিরাম সংগ্রামের প্রেরণা।