যশোরে চলতি বছরে ৫১ জন এইচআইভি শনাক্ত

0

বি এম আসাদ ॥ স্বাস্থ্য বিভাগ ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সচেতনতামূলক কর্মসূচি যশোরে এইচআইভি/এইডসের প্রাদুর্ভাব রুখতে পারছে না। আক্রান্তের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। চলতি বছরে ২৬ জন শিক্ষার্থীসহ মোট ৫১ জন আক্রান্ত হয়েছেন। পাঁচ জনের মৃত্যু ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্মীয় অনুশাসন মানা এবং নিয়মিত কাউন্সেলিং ছাড়া এই রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়।

যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের এআরটি সেন্টার থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৫ হাজার ১০০ জনের রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে। এইচআইভি শনাক্ত হয়েছেন ৫১ জন, যেখানে ২০২৪ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫। অর্থাৎ এক বছরে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। চলতি বছরে মারা গেছেন পাঁচ জন। জেলায় নিবন্ধিত এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা বর্তমানে ২৪৮ জন। এদের মধ্যে ২৪১ জন নিয়মিতভাবে ওষুধ সেবন করছেন।

পরিসংখ্যান বলছে, ১২ জন পথশিশু শনাক্ত হয়েছে; যাদের বয়স ১৬-এর নিচে। ১২ জন প্রবাসফেরত ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের ৫ জনের স্ত্রীও পরবর্তীতে সংক্রমিত হয়েছেন।

চিকিৎসকদের মতে, আবাসিক মেস ও ছাত্রাবাসে অনিয়ন্ত্রিত যৌন আচরণ, নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের অভাব, পারিবারিক নজরদারি কমে যাওয়া, ঝুঁকি সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং সামাজিকভাবে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সংকোচ বোধ, তরুণদের মধ্যে সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে।

যশোরের একজন চিকিৎসক বলেন, ‘অনেক শিক্ষার্থী একা থাকে, মেসে বা হোস্টেলে থাকে। বয়স ও আচরণগত ভুলের কারণেই বেশিরভাগ ঝুঁকিতে পড়ছে।’

চিকিৎসকদের মতে, পথশিশুরা নিরাপদ পরিবেশে বেড়ে ওঠে না। ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ, নির্যাতন, সঠিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত থাকা, এসব কারণেই তাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

২৫ বছর বয়সী রাহিম (ছদ্মনাম) স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষার্থী। কয়েকদিন ধরে জ্বর ও দুর্বলতায় ভুগছিলেন। এক বন্ধু পরামর্শ দিলে তিনি হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা করাতে যান। রিপোর্ট পাওয়ার পর যে দৃশ্য দেখা গেল, তা হাসপাতালের কাউন্সেলরদেরও ব্যথিত করেছে।

রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর চেয়ারে বসে রাহিম চুপচাপ ছিলেন। কিছুক্ষণ পর ফিসফিস করে বললেন,
‘আমি অন্যদের কীভাবে বলব? পরিবার জানলে ভেঙে পড়বে। ভুল করেছি, এখন কী করব?’

কাউন্সেলিং রুমে উপস্থিত একজন স্বাস্থ্যকর্মী বলেন, ‘রাহিম একা নন। এমন ভাঙা মন নিয়ে প্রতিদিনই কয়েকজন আসে। তারা ভুল করেছে, কিন্তু তা বুঝে ওঠার আগেই ঝুঁকিতে পড়ে গেছে।’

রাহিম এখন নিয়মিত ওষুধ সেবন করছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, তিনি চাইলে দীর্ঘদিন স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন। তবে মানসিক আঘাত কাটিয়ে ওঠার জন্য তার আরও সহায়তা প্রয়োজন।

১৩ বছরের শিমু (ছদ্মনাম) শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুমায়। তার বাবা-মা নেই। একদিন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেলে জানা যায় সে এইচআইভি পজিটিভ। কীভাবে আক্রান্ত হয়েছে, সে নিজেও বলতে পারে না।
হাসপাতালের এক নার্স বলেন, ‘ওর চোখে ভয় নয়, বরং অজানা এক বিভ্রান্তি। ও বুঝেই না আসলে কী হয়েছে জীবনে।’

সিমুর মতো ১২টি পথশিশু বর্তমানে এআরটি সেন্টারের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। তাদের নিয়মিত কাউন্সেলিং ও সামাজিক পুনর্বাসন অত্যন্ত প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্কুল-কলেজে যৌনস্বাস্থ্য শিক্ষার অভাব, ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজের অভাব, শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরামর্শ বা পরীক্ষা নেই। এসব সমস্যার কারণে সংক্রমণ কমছে না।

একজন এনজিও কর্মকর্তা বলেন, ‘নব্বইয়ের দশকে এনজিওগুলো এইচআইভি নিয়ে প্রচুর কাজ করত। এখন সেই কর্মসূচি অনেকটাই দুর্বল।’

সিভিল সার্জন মো. মাসুদ রানা বলেন, ‘শিক্ষার্থী ও তরুণদের মধ্যে সংক্রমণ উদ্বেগজনক। পরিবার-সমাজ-প্রতিষ্ঠান সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। শুধু স্বাস্থ্য বিভাগ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।’

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হুসাইন শাফায়াত বলেন, ‘রোগীরা নিয়মিত ওষুধ নিলে ভালো থাকে। কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যা কমাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা ও নিয়মিত পরামর্শ জরুরি।’

বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, নিয়মিত কাউন্সেলিং সেশন, স্কুল-কলেজে যৌনস্বাস্থ্য শিক্ষা, শিক্ষার্থীদের পরামর্শ সেবা, পরিবারিক নজরদারি বৃদ্ধি, পথশিশুদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়, প্রবাসফেরতদের বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, এবং সামাজিকভাবে আলোচনার পরিবেশ তৈরি, এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে সংক্রমণ অনেকটাই কমে আসবে।

যশোরে এইচআইভি সংক্রমণের হার যে গতিতে বাড়ছে, তা থামাতে এখনই কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। তরুণদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের প্রবণতা, পারিবারিক অবহেলা, সচেতনতার ঘাটতি এবং নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের অভাব এসব মিলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হচ্ছে। সময়মতো হস্তক্ষেপ করতে পারলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব এটাই বিশেষজ্ঞদের আশা।