সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী পরিচয়ে দুষ্টচক্রের দৌরাত্ম্য

0

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ যশোরে একশ্রেণির অসাধু চক্র সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী পরিচয়ে চাঁদাবাজি, অবৈধ বিচার-সালিশ ও জরিমানা আদায় করছে। এই চক্রগুলো কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এনজিও, ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানে হানা দেয়। তারা নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে এবং মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দিলে খবর প্রকাশের হুমকি দেয়।

এসব ভুয়া মানবাধিকার কর্মী ও নামধারী সাংবাদিকের দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এদের অপতৎপরতা প্রকৃত ও পেশাদার সাংবাদিকদের সুনামকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করছে।

দলবদ্ধ এসব চক্র ক্যামেরা-ট্রাইপড নিয়ে হঠাৎ করেই প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে। তাদের গলায় থাকে সুসজ্জিত আইডি কার্ড, এমনকি কেউ কেউ সরকারি মনোগ্রামও ব্যবহার করে। এতে স্বল্পশিক্ষিত থেকে শুরু করে অর্ধশিক্ষিতরাও ভয় পেয়ে যায়। এরপর তারা বিভিন্ন পাশ থেকে প্রতিষ্ঠানের ছবি ও ফুটেজ নেয় এবং ‘এখানে এই অন্যায় হচ্ছে, ওই সমস্যা লুকানো হচ্ছে’ বলে হম্বিতম্বি করে। ঝামেলা এড়াতে ও সুনাম ধরে রাখতে অনেকেই আপস-মীমাংসায় যায়। আবার অনেকে প্রতিবাদ করে বিপদগ্রস্ত হয়।

সম্প্রতি যশোরের বাহাদুরপুর ও মধুগ্রামে একটি কারখানায় ৪ জন সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী পরিচয়ে দুটি পৃথক দল দুই দিনে হাজির হয়। তারা দ্রুত কিছু ছবি ও ফুটেজ ধারণ করে এবং বিএসটিআই সনদ, ট্রেড লাইসেন্স, আয়কর সনদ, টিন, পরিবেশের অনুমতি, অগ্নি দপ্তরের অনুমতিসহ নানা কাগজপত্র দেখতে চায়। এমনকি মেঝের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। জানা গেছে, ৫০/৫৫ বছর বয়সী এই দলের একজন ঢাকার একটি পত্রিকার (যশোরে যার কোনো গ্রাহক নেই) স্টাফ রিপোর্টার।

অভিযোগ রয়েছে, তিনি মাঝে মাঝে এলাকায় এসে একটি দল নিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি করেন। এদিন মালিকের অনুপস্থিতিতে মিল কর্মচারীদের কাছে বড় অঙ্কের টাকা দাবি করেন। পরে মালিক যশোরের কয়েকজন সাংবাদিকের শরণাপন্ন হয়ে তাদের সরাতে সক্ষম হন।

মধুগ্রামের টাপুর হোসেন, হৃদয়, বাচ্চুসহ কয়েকজন জানান, এই ঘটনার ৭/৮ দিন পর ওই প্রতিষ্ঠানে আবারও ৪ জন সাংবাদিক নামধারী ব্যক্তি যায়। এদের মধ্যে আগের দলের ২ জন ছিল। সন্ধ্যার পর তারা হুমকি-ধামকি দেয় ও ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। মিল কর্মচারীদের সহায়তায় এলাকাবাসী তাদের আটক করে। হুড়োহুড়ির মধ্যে ২ জন পালিয়ে গেলেও বাকি ২ জনকে এলাকাবাসী জিজ্ঞাসাবাদ করে। তারা সরকারি মনোগ্রাম সম্বলিত আইডি কার্ড দেখিয়ে আস্ফালন করতে থাকে।

একপর্যায়ে উত্তেজিত জনতা তাদের মারধর করতে চাইলে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহায়তায় তারা মুচলেকা দিয়ে মধ্যরাতে ছাড়া পায়। এলাকাবাসীর পক্ষে টাপুর হোসেন জানান, তারা নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিলেও সম্পাদকের নাম, যশোর প্রেসক্লাবের সভাপতি-সম্পাদকের নাম জানাতে পারেনি। পরে প্রেসক্লাব সভাপতি-সম্পাদক ও একজন স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদকের কাছে জানতে চাওয়া হলে কেউই তাদের সাংবাদিক হিসেবে চেনেন না বলে জানান।

এর কিছুদিন আগে বিরামপুর এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল বলে একজন প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এসব বিষয়ে বেশ কয়েকটি পোস্ট দেখা গেছে, যেখানে গণমাধ্যমকর্মীরা মন্তব্য করেছেন।

এদিকে চলতি মাসের জেলা সমন্বয় সভায় ঝিকরগাছা উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সাংবাদিক নামধারী ও দায়িত্বহীন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও তথ্যবিহীন খবর প্রকাশের অভিযোগ করেছেন। ইউএনও ভুপালী সরকার বলেন, নামে বেনামে নিউজ পোর্টাল ইচ্ছা খুশি মত সংবাদ পরিবেশন করছে।

তাদের অধিকাংশ নিউজ ভুয়া উলে¬খ করে তিনি বলেন, ঝিকরগাছায় একটা রাস্তার কাজ নিয়ে ভুয়া সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে। পরবর্তীতে তিনি খবর নিয়ে দেখেছেন সত্যিকার অর্থে কোনো অনিয়ম হয়নি। তিনি আরও জানিয়েছিলেন যে, ওই সাংবাদিক কোনো প্রচলিত পত্রিকার নন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, যশোর সদর উপজেলাসহ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে এমন একাধিক চক্র সক্রিয় রয়েছে। এরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নানা অজুহাতে জিম্মি করে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। এরপর নিজেদের খেয়ালখুশি মতো বিচার-সালিশ বসিয়ে অলিখিত ফরমান জারি করে এবং মোটা অঙ্কের জরিমানা আদায় করে। টাকা না দিলে বা তাদের সিদ্ধান্তে অস্বীকৃতি জানালে বিভিন্নভাবে হয়রানি করার হুমকি দেয়। অনেক ক্ষেত্রে, এদের বিরুদ্ধে মুখ খুললে মিথ্যা মামলা করার ভয় দেখানো হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘ভুঁইফোঁড় মানবাধিকার সংগঠন’ বা “নামসর্বস্ব সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিক পরিচয়পত্র” ব্যবহার করে যারা অপকর্ম করছে, তারা প্রকৃত ও প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার সংস্থাগুলোর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এরা সাধারণত কোনো স্বীকৃত বা বৈধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত হয় না এবং তাদের উদ্দেশ্য থাকে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি করা, মানবাধিকার সুরক্ষা নয়। কারন সরকারিভাবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পরিচালিত হয়। হাটেমাঠে ঘাটে এ সংস্থার কোন প্রতিনিধি যায় না।

বেসরকারিভাবে পরিচালিত মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মধ্যে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থাছাড়া আর কোন সংস্থার নামে ‘মানবাধিকার’ শব্দ যুক্ত নেই। বেসরকারিভাবে সক্রিয় মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, অধিকার, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ব্লাস্ট, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রভৃতি। কাজেই মানবাধিকার সংগঠনের পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে হম্বিতম্বি করা কেউই প্রকৃত মানবাধিকা কর্মী নন।

সূত্রমতে, জেলার শার্শা ও বাঘারপাড়ায় এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে, যেখানে ভুয়া সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের এসব কর্মকাণ্ড স্থানীয় প্রশাসন ও প্রকৃত মানবাধিকার সংগঠনগুলোর জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই ভুয়া পরিচয়ধারীদের দৌরাত্ম্য একদিকে যেমন সাধারণ মানুষ আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি প্রকৃত সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের পেশাগত দায়িত্ব পালন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের অপকর্মের কারণে সাধারণ মানুষ প্রকৃত সংবাদকর্মী ও মানবাধিকার কর্মীদের বিশ্বাস করতে চাইছেন না। এতে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ও মানবাধিকার সুরক্ষার কাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে যশোর সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এইচ আর তুহিন বলেন, ‘যারা সাংবাদিকতার ‘স’ও জানে না, তারা কিছু ভুঁইফোঁড় অনলাইন আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার কার্ড এনে সাংবাদিক সেজে গেছে। তারা লিখতে পারে না বরং এদের দাপটে ও সাংবাদিক দৌরাত্ম্যের কারণে প্রকৃত সাংবাদিকরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেন। কার্ড বিক্রিকারী গণমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া উচিত।’ তিনি আরও জানান, ‘এই সব ভুয়াদের কারণে সাংবাদিক পেশার প্রতি মানুষের যে আস্থা ও শ্রদ্ধা ছিল তা উঠে যাচ্ছে দিন দিন। যারা এদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন তারাও সমানভাবে অপরাধী।’

সাংবাদিক ইউনিয়ন যশোরের সভাপতি আকরামুজ্জামান বলেন, “ভুয়া সাংবাদিকের দৌরাত্ম্য বিগত কয়েক বছর আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেসক্লাব এদের প্রতিকার বা বিস্তার রোধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে না।’ তিনি অভিযোগের সুরে জানান, ‘এদের প্রতিকার না করে কেউ কেউ তাদের পৃষ্ঠপোষকতাও করে থাকেন। এজন্যে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।’