ধানেই ধনী যশোরের কৃষক

0

তহীদ মনি ॥ এক বিঘা জমিতে ধান ফলিয়ে ১৭ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ পাচ্ছেন যশোরের কৃষক। এই ধানেই তারা পাচ্ছেন সারা বছরের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। শুধু পেটের ভাত নয়, পাচ্ছেন সামাজিক মান সম্মান আর আত্মবিশ্বাস। যে কৃষকের ঘরে ধান থাকছে সে কৃষক নিজেকে ধনী মনে করছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দৈব্য কোন সমস্যা ছাড়া তারা আর কোন কিছুকেই পরোয়া করেন না। সারা বছর রক্ত পানি করা পরিশ্রম সোনালী ঝিলিকে নিমিষেই উড়ে যায়। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, ধান থাকলেই কৃষকের মান থাকে-ঘরে খাবার থাকে, থাকে আনন্দ।

সদর উপজেলার তালবাড়ীয়ার আইয়ুব হোসেন। এ বছর সাড়ে ৬ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। শিলা বৃষ্টির কারণে বেশ কিছু ধান নষ্ট হয়েছে। তারপরও ১৪৫ মণ ধান পেয়েছেন। তার হিসাব মতে এলাকায় অনেকেই বিঘায় ২৪/২৫ মণ ধান পেয়েছেন। তার জমির সবগুলোর লেভেল একই রকম না তাই কোনো কোনো খণ্ডে কিছুটা ফলন কম আছে। শিলা বৃষ্টিতে ধান নষ্ট হয়েছে। নষ্ট না হলে দেড়শত মণ ধান হয়তো পেতেন তিনি।

তার দেয়া হিসেব অনুযায়ী এক বিঘা ধান চাষে ৪টি লাঙ্গল লাগে। এতে খরচ হয় ১৬ থেকে ১৮শ টাকা। একটি মই দিতে হাজার টাকা পড়ে যায় কখনো কখনো। ধান লাগাতে হয় বিঘায় ২ হাজার টাকা চুক্তিতে। বোরো ধান পানি নির্ভর ধান। ডিজেল মেশিনের পানি ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা আর বিদ্যুৎ চালিত মোটরে পানি দিতে বিঘাপ্রতি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ। কাটা-বাঁধা-মলা-ডলা ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। জমি ভেদে সার ও ওষুধ বাবদ ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা ব্যয় হয়। সব মিলিয়ে বিঘা প্রতি ১৭শ থেকে ২০ হাজার টাকা উৎপাদন খরচ হয় কৃষকের। আর নিজেরা চাষ করতে পারলে খরচ কমতেই থাকে। কারো কারো খরচ ১২/১৩ হাজারে শেষ হয়।

কৃষকরা জানান, ধান ওঠার মুখে ধানের দাম কম থাকে। মহাজনরা বাজার দাম কমিয়ে দেয়। কৃষকরা সার-ওষুধ-পানির দাম, জনের(কিষাণের দাম) মেটাতে দাম কম হলেও ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন। বর্তমানে হাশিমপুর বাজার বা ছাতিয়ানতলা হাটে মোটা ধান প্রায় ১৩শ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। চিকন ধান ১৭শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

হাশিমপুর বাজারের ধানের আড়ৎদার আব্দুল মতিন জানান, মাসখানেক আগেও পুরোনো ধানের দাম ১৭-১৮শ টাকার বেশি ছিল, এখন কমে গেছে। এটা প্রতি বছরই হয়ে থাকে। বাজারের কয়েকজন জানান, উঠতি ধান বিক্রি করতে কৃষকরা যদি বাধ্য না হতো যদি তা হলে শুধু ধান চাষ করেই কৃষক সারা বছরের সংসার খরচ চালাতে পারতেন। কিন্তু সার, বীজ, পনি, জোন, ঝাড়া-বাঁধাতে প্রতি বছর খরচ বাড়ছে। একই সময় মাঠের প্রায় সব ধান পেকে যায়। মাথার উপর কালোমেঘের ঘণঘটা, ঝড়, শিলা বৃষ্টির শঙ্কা তাই কৃষকরা থাকেন তটস্থ। ফলে এ সময় অনেক বেশি দামে জোন কিনতে হয়। তারাও দিনের ৬ ঘণ্টা কাজ করেন ফলে ধান ওঠাতে কৃষকের এই সময় খরচ বেশি হয়।

তবে তালবাড়ীয়ার কৃষক আইয়ূব, আছাদ, আব্দুল ওয়াহাব, সাজ্জাদ হোসেনদের মতে এত কিছুর পর ধানই হচ্ছে কৃষকের মান-কৃষকের মেরুদণ্ড। সারা বছর ঘরে ধান না থাকলে সে কৃষককে সমাজে লজ্জায় মাথা নত করে রাখতে হয়। ঘরে ভাতের ব্যবস্থা থাকেলে তেল-নুনের ব্যবস্থাও হয়।

এক সময় কৃষকের ঘরে ধান থাকতো গোলা ভরে। পুকুরে মাছ। বাড়ি ঘরের জমির পাশে তরি তরকারি লাগিয়ে সুখেই দিন পার করতো। এখন তেমন দিন না হলেও ঘরে ধান না থাকলে কৃষকের পরিচয়টাই মুছে যায়। তাদের মতে, এখন ধানের দাম সব চেয়ে কম। তারপরও বিঘা প্রতি সাড়ে ২৮ হাজার টাকার ধান বিক্রি করা যাচ্ছে। ফলে বিঘায় প্রায় ৯/১০ হাজার টাকা লাভ থাকছে। ধান রেখে বিক্রি করতে পারলে এই লাভ আরো বেশি। তবে চাষিদের আর একটা বড় লাভের জায়গা আছে। এক বিঘা জমিতে অন্তত ২ কাউন বিচালি হয়। এর সর্বনিম্ন মূল্য ১০ হাজার টাকা। গত বছর ২ কাউন বিচালি ১৩ হাজার টাকা পর্যন্ত অনায়াসে বিক্রি হয়। সে হিসেবে প্রায় ২০ হাজার টাকা বিঘা প্রতি লাভ থাকে কৃষকের। সদরের লেবুতলা মাফিজুর ও খায়রুল জানান, চাষিদের হাতে সাধারণত ধান লাগানো ও ঘরে ওঠানোর সময় নগদ টাকা থাকে না।

এ সময় তারা ঋণ করেন, এনজিও থেকে ঋণ নেন বা মহাজনের কাছে ছোটেন। যে কোনো মূল্যে তারা ধান লাগানো ও ঘরে তোলাকে গুরুত্ব দেন। এ কারণে তাদের বেশ ক্ষতি মানতে হয়। এরপর ঘরে ধান উঠলে তাদের সব আপসোস-দুঃখ মুছে যায়। যাদের ঘরে ধান থাকে তারা সারা বছর হাটে ধান বেচেন ঘরের অভাব মেটান। ধান না থাকলে কৃষকের মেরুদণ্ডে জোর থাকে না। আবার ফসল ভালো হলে, ধান ঘরে থাকলে তাদের মুখের লম্বা হাসি ফুরায়না।

যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মোশাররফ হোসেন জানান, জেলায় আবাদযোগ্য জমি ১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৫০ হেক্টর। চলতি বছর বোরো মৌসুমে আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৫৭ হাজার হেক্টর। ভবদহ এলাকায় প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ করা সম্ভব হয়নি। তা হলে আবাদ হতো এক লাখ ৬২ হাজার হেক্টরে। এ বছর আবাদকৃত বোরোর মধ্যে ১ লাখ ৩১ হাজার ১৫০ হেক্টর ্উফশি এবং ২৫ হাজার ৯শ হেক্টরর জমিতে হাইব্রিড ধানের চাষ হয়েছে। এই হিসেবে জেলায় ১০ লাখ ৯২ হাজার ৪৬৫ মেট্রিকটন ধান তথা ৭ লাখ ২৮ হাজার ৩১০ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হতে পারে। হেক্টর প্রতি হাইব্রিড ধানে ৫.৩০ মেট্রিকটন চাল এবং উফশিতে ৪. ৩৫ মেট্রিক টন চাল ্উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। গড় চালের উৎপাদন ধরা হয়েছে হেক্টর প্রতি ৪ দশমিক ৫৩ মেট্রিক টন। বৃষ্টি-শিলায় বেশ ক্ষতি হলেও ৪.৪০ মেট্রিক টন(লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি) চালের উৎপাদন হয়েছে। উৎপাদনে কৃষক ও কৃষি বিভাগ উভয় পক্ষই খুশি।

তিনি আরও জানান, যশোর জেলায় চাল ও গম মিলে খাদ্য চাহিদা প্রায় পৌণে ৬ লাখ মেট্রিক টন এবং উৎপাদন হয় প্রায় সাড়ে ১২ লাখ মেট্রিকটন। সে কারণে এ জেলা খাদ্যে উদ্বৃত্ত জেলা। তাছাড়া শুধু বোরো আবাদেই জেলার খাদ্য চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত ফসল থাকে। তার মতে, কৃষকের আনন্দই ফসল ফলিয়ে। কাঙ্খিত ফসল যখন কৃষক ঘরে তোলে তখন তার ও ই পরিবারের সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। ধান থাকলেই কৃষকের মান থাকে-ঘরে খাবার থাকে-থাকে আনন্দ।