কৃষিকাজে পরিযায়ী শ্রমিকদের সংগ্রামী জীবন

0

সাইফুর রহমান সাইফ॥ অনেকটা পরিযায়ী পাখির মতো তারা। কাজের জন্যে মাইলের পর মাইল পাড়ি দেন। আবার কাজ শেষ হলে ফিরে যান নিজ ভূমে। এ পরিযায়ী মানুষগুলো সব কৃষি শ্রমিক। ফি বছর ধান রোপণ বা কাটার মৌসুমে তারা যশোরসহ আশপাশের এলাকায় আসেন। আবার ধান কাটা হলে ফিরে যান নিজ গ্রামে। এদের একটা বড় অংশের বাড়ি দেশের উত্তরাঞ্চলে।

কৃষক ও কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এখন বোরো মৌসুম চলছে। শুরু হয়েছে ধান কাটা। তাই খোঁজ পড়েছে কৃষি শ্রমিকের। যশোর অঞ্চলে কল-কারখানায় কাজ করাসহ নানা কারণে কৃষি শ্রমিকের স্বল্পতা রয়েছে। তাই ঘাটতি যোগান দিতে ধান রোপণ ও কাটার মৌসুমে উত্তরাঞ্চল থেকে শ্রমিক আসে দলে দলে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের যশোরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা আবু তালহা দৈনিক লোকসমাজকে জানান, চলতি বোরো মৌসুমে ধান কাটা শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১০ থেকে ১২ ভাগ ধান কাটা হয়েছে। বাকি ধান এখনো জমিতে রয়েছে। সেই ধান কাটতে শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ছে। তিনি জানান, প্রতি বিঘা জমির ধান কাটতে ৭ থেকে ৮জন শ্রমিক প্রয়োজন হয়।

কৃষক মীর অলিয়ার রহমান জানান, প্রতি বছর ধান রোপণ ও কাটার মৌসুমে উত্তরাঞ্চল থেকে প্রচুর শ্রমিক আসেন। কাজ শেষ হলে তারা আবার ফিরে যান। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি।

গতকাল নওয়াপাড়া শিল্পশহরের রেলস্টেশনে দেখা যায়, অগণিত কৃষি শ্রমিক উত্তরবঙ্গগামী ও উত্তরবঙ্গ ফেরত ট্রেন থেকে ওঠানামা করছেন। একটু দূরে এগিয়ে রেলওয়ের লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে লাইনে ওপর দাঁড়িতে থাকতে দেখা যায় এদের একটি অংশকে। এখানে শ্রম বিক্রির হাট বসে। যারা কাজ করতে চান ও যারা কাজের জন্যে লোক নিতে চান তারা উভয়ে এখানে আসেন প্রতি শনি ও মঙ্গলবার। দরদাম ঠিক হলে কাজে যান শ্রমিকরা।

শ্রমবজার ও নওয়াপাড়া রেলওয়ে স্টেশনে কথা হয় একাধিক কৃষি শ্রমিকের সাথে। তাদের কেউ কেউ বলেন, কাজ শেষ। তাই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। কেউ বলেন, একস্থানে কাজ হয়েছে। অন্যকাজের সন্ধানে রয়েছেন।

আজম আলী নামে এক শ্রমিকের সাথে দেখা হয় নওয়াপাড়া রেলওয়ে স্টেশনে। ত্রিশ বছরের মতো বয়সের এ শ্রমিকের বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী এলাকায়। দু ছেলে এ এক মেয়ের জনক আজম বলেন, গত বৃহস্পতিবার তিনি স্টেশনে নামেন। এরপর খুলনার ফুলতলার এক ব্যক্তির জমিতে ধান কাটেন তিনদিন। কিন্তু বৃষ্টির পানি জমে যাওয়ায় আর কাজ করতে পারেননি। তাই চলে যাচ্ছেন।

তিনি জানান, দিনে ৬০০ টাকা মজুরিতে তিনি কাজ করেছেন। কাজের সময় জমির মালিক খাবার দিয়েছেন। কিন্তু বাকি আরও কয়েকদিন তাকে এখানে থাকতে হয়েছে। এ সময়ে খাওয়ার জন্যে খরচ হয়েছে ২০০ টাকা। তাই সামান্য টাকা তিনি বাড়িতে নিয়ে যেতে পারছেন।

চাপাইনবাবগঞ্জ সদরের দেবীনগরের মো. জাহাঙ্গীরও রাজশাহীগামী মহানন্দা এক্সপ্রেস ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। সাথে তরিকুল ইসলাম, মহিউদ্দিন, আব্দুল হাকিম, মো. বাবু, মো. শামীম ও আব্দুর রহমান নামে একই এলাকার আরও কয়েকজন শ্রমিক।

তারা জানান, ১ বৈশাখ তারা নওয়াপাড়া নামেন। প্রতিদিন ৭০০ টাকা মজুরিতে তারা একেকজন ২ হাজার ১০০ টাকা করে আয় করেছেন। আড়াই দিন কাজ হয়েছে। বাকি সময় ঘুরে ঘুরে একেকজনের ৭০০ টাকার মতো খাওয়ার জন্যে খরচ হয়েছে। এছাড়া আছে ট্রেন ভাড়া। লোকাল ট্রেনে একেকজন ১৩০ টাকা ভাড়া। তারা জানান, কাজ না থাকলে তারা রেলওয়ে স্টেশনে রাত কাটান।

শ্রমবাজারে কথা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চাঁইপাড়ার মো. ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, ১১ দিন কাজ হয়েছে। এতে আয় হয়েছে ৫ হাজার টাকা। বিকাশের মাধ্যমে সে টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ফের কাজের সন্ধানে বাজারে এসেছেন।

তিনি জানান, কাজ না থাকলে রাতে তিনি নওয়াপাড়া পীর সাহেবের বাড়ির মাদ্রাসায় থাকেন। পরিবেশ ভালো। শতাধিক শ্রমিক প্রতিরাতে সেখানে বিশ্রাম নেন।

বাড়িতে যাওয়া-আসা ও রাত যাপনে অনেক কষ্ট হয় উত্তরবঙ্গের এসব পরিযায়ী কৃষি শ্রমিকদের। অনেক সময় ট্রেনে সিট পাওয়া যায় না। তখন দীর্ঘ পথ দাঁড়িয়ে যেতে হয়। আবার স্টেশনে রাত যাপনেও হয় নানা সমস্যা। কারণ সবাই তো আর মাদ্রাসায় থাকার সুযোগ পান না -জানালেন শ্রমিকরা।

কৃষি কর্মকর্তা আবু তালহা জানান, যশোরে এবার বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬০ হাজার ৭৫০ হেক্টর। কিন্তু অর্জিত হয়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০ হেক্টর। এখন এ ধান কেটে ঘরে তুলতে শুরু করেছেন কৃষক।