রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার সেবা ও কল্যাণমূলক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিপন্ন মানুষ

0

আকরামুজ্জামান ॥ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার সেবা ও কল্যাণমূলক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিপন্ন মানুষ। বেশির ভাগ হতদরিদ্র অসহায় মানুষের কাছে সরকারের আর্থিক সহায়তা পৌঁছায়না। প্রশাসনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক ও পেশীশক্তির হস্তক্ষেপে এসব সুবিধার অধিকাংশই একশ্রেণির মানুষ এর সুফল ভোগ করছে। এর কারণে প্রকৃত অসহায়-দরিদ্র মানুষরা সরকারি সেবা পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না।

দুর্দশাগ্রস্ত লোকজনের কাছে যাতে এসব সরকারি সহায়তা পৌঁছানো যায় সেজন্য সরকারিভাবে শতভাগ স্বচ্ছতার মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাষ্ট্রীয়ভাবে যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে এর অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে সমাজের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা বিপন মানুষের কল্যাণে আর্থিক সহায়তার নানা কর্মসূচি রয়েছে। প্রতিবছর বিভিন্ন খাতওয়ারি হতদরিদ্রদের পুনর্বাসনে সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে। তবে এর বেশির ভাগ বরাদ্দই ভাগবাটোয়ারা হয় রাজনৈতিক বা জনপ্রতিনিধিদের পছন্দ অনুযায়ী। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণেও প্রকৃত সুবিধাভোগীরা বাদ পড়ে যাচ্ছে।

যশোরের কয়েকটি সরকারি দফতরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, প্রতি অর্থ বছরই সেখান থেকে দারিদ্র্য বিমোচনে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থও বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু সুফল পাচ্ছেন না প্রকৃতরা। এরমধ্যে জেলা সমাজসেবা অধিদফতরে গিয়ে দেখা গেছে, এই দফতরটিতে নানাভাবে আর্থিক সহায়তা করা হয়। সামাজিক নিরাপত্তা-১ ও ২ এর অধীনে বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতা, বেদে জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন, হিজড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে মাথাপিছু মাসিক ৬০০ থেকে ৫৫০ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়।

কিন্তু এসব সুবিধা থেকে প্রকৃতরা বঞ্চিত হয়ে আসছেন। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তালিকা ধরেই এসব সরকারি সহায়তা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যশোর সমাজসেবা অধিদফতর থেকে বিগত ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে সামাজিক নিরাপত্তা-২ এর অধীনে ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিসসহ ৬টি জটিল রোগে আক্রান্ত মোট ৬৬৩ জনকে মাথাপিছু ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর সিংহভাগই পতিত শেখ হাসিনার সরকারের সেই সময়কার এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়ারম্যানদের পছন্দের লোকজনের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। প্রকৃত অনেক অসহায় মানুষ অনলাইনে আবেদন করেও এখনো পর্যন্ত এ সেবার আসতে পারেননি তারা।

এ বিষয়ে যশোর পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা লায়লা পারভীন বলেন, গত বছরে জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের বিধবা ভাতার জন্য আবেদন করেছিলেন। এরপর সেই থেকে তিনি অফিসে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তালিকায় নাম তুলতে পারেননি। এখন অপেক্ষায় আছেন নতুন করে কবে আবার আবেদনের জন্য সার্কুলার দেবে। তিনি বলেন, যারা তদবির করতে পারেন তারাই সহজে তালিকাভুক্ত হতে পারেন। এই বৈষম্য এখন আর চলতে পাওে না। এর পরিবর্তন চাই।

মঙ্গলবার সকালে যশোর সমাজসেবা অধিদফতরের সামনে কথা হয়, রাজিয়া বেগম ও শফিয়ার রহমান নামে দুই ব্যক্তির সাথে। তারা দুজনই জেলার ঝিকরগাছা থেকে এসেছেন চিকিৎসা সহায়তার জন্য। কিন্তু সমাজসেবা অধিদফতর থেকে বলা হয়েছে এখন বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব না।

এ বিষয়ে যশোর সমাজসেবা অধিদফতরের সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, বয়স্ক ও বিধবা ভাতার বিষয়ে রুট লেভেলে কমিটি করে দেওয়া রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা এসব তালিকা যাচাই-বাছাই করে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে দেন। এরপর উপজেলা কমিটি সেটি আমাদের কাছে পাঠালে জেলা কমিটি সেটি চূড়ান্ত করেন।

এর বাইরে দূরারোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য অর্থ বরাদ্দ জেলা কমিটি যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত করেন বলে তিনি জানান। এ ক্ষেত্রে সমাজসেবা অধিদফতরের কোনো স্বজনপ্রীতির সুযোগ নেই বলে তিনি জানান। শুধু সমাজ সেবা অধিদফতর নয়, সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সেবা কার্যক্রমেও দলগত সুবিধাভোগীরা সুবিধাপেলেও প্রকৃত অসহায় দরিদ্ররা এর সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে।

জেলা পরিষদ, উপজেলা প্রশাসন, পৌর প্রশাসনসহ যেসব সরকারি দফতর রয়েছে সেখান থেকে সরকারি আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয় তা সরাসরি বিপন্ন জনগোষ্ঠীর হাতে পৌঁছে না। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক পছন্দ অনুযায়ী দলগতভাবে সেগুলো বিতরণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যশোরে টিসিবি পণ্যের সুবিধাভোগীদের জন্য যে তালিকা করা হয় তার ৯০ শতাংশই দলীয়করণ করা হয়েছে। জেলার ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৩৯ কার্ডধারী রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি সদর উপজেলায় কার্ডধারী ক্রেতা রয়েছেন ৩৪ হাজার ১০২ জন। সবচেয়ে কম চৌগাছায় ১১ হাজার ৫৮১ জন।

এছাড়া বাঘারপাড়ায় ১১ হাজার ৮২০, ঝিকরগাছায় ১৩ হাজার ২৫৫, অভয়নগরে ১২ হাজার ১৭২, শার্শায় ১৮ হাজার ৪৩৮, মনিরামপুরে ২১ হাজার ৬২৬ ও কেশবপুরে ১৪ হাজার ৪৪৫ জন টিসিবির কার্ডের আওতায় রয়েছেন। এসব তালিকা রাজনৈতিকভাবে করার কারণে টিসিবি পণ্য গ্রহণের উপযুক্ত অনেক মানুষ এ সুবিধা থেকেস বঞ্চিত হয়ে আসছে। ভুক্তভোগীদের দাবি সমাজের অনেক মধ্যবিত্তরা সরকারের এই আর্থিক সেবা সহায়তা পেলেও গরিব-অসহায় মানুষ এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন।