নতুন নেতৃত্বের পথে যশোর জেলা বিএনপি, দৃষ্টান্ত নার্গিস বেগমের

0

শিকদার খালিদ ও মাসুদ রানা বাবু॥ সাত বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যশোর জেলা বিএনপির সম্মেলন। অধীর আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে যশোরের রাজনৈতিক মহলে। পাঁচ বছর ধরে দলের কাণ্ডারি আহ্বায়ক কমিটি। সম্মেলন হলে কমিটি হবে এটাই স্বাভাবিক। আর কমিটি নিয়েই আগ্রহ মূলত দল ও দলের বাইরে।

এ ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। অনেকের অনেক ধারণা ও আলোচনার মধ্যেও যশোর জেলা বিএনপির আগামীর কমিটিতে সভাপতি পদ নিয়ে আলোচনা ছিল না। সকলে নিশ্চিত ছিলেন পদটিতে আসছেন অধ্যাপক নার্গিস বেগম। যিনি বিগত কঠিন রাজনৈতিক সময়ে ব্যক্তিগত ও দলীয় সবভাবেই অত্যাচার ও নির্যাতনের লক্ষ্যমাত্রা থেকেও রাজপথ ছাড়েননি। আহ্বায়কের পদে থেকে পালন করে গেছেন দায়িত্ব। ফলে পদটি তিনি পেতেই পারেন। কিন্তু যশোরের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের বর্তমান সময়ের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম এ মানুষটি চিরপ্রচলিত ধারণা পাল্টে দিলেন হঠাৎ।

গতকাল জানা গেল যশোর জেলা বিএনপির সভাপতি পদে তিনি থাকবেন না বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। নিমিষেই পাল্টে গেল অনেক হিসেব-নিকেষ। দ্বার উন্মোচন হল যশোর জেলা বিএনপির নতুন নেতৃত্বের।গত ১০ ফেব্রুয়ারি যশোর জেলা বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে সম্মেলন। সাথে সাথে শুরু হয় কমিটি গঠন নিয়ে আলোচনা। জানা গেল নির্বাচনের মাধ্যমে গঠন হবে নতুন কমিটি। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ভোট গ্রহণ করা হবে সম্মেলনের দিনই। কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তারা সোমবার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে।

একই সাথে দলের মধ্যে শুরু হয়ে যায় আলোচনা কমিটির শীর্ষ পদে স্থান পেতে কোন নেতা কোন পদে লড়বেন তা নিয়ে। বৃহৎ রাজনৈতিক দলটির জেলা কমিটির আসন্ন নতুন কমিটি নিয়ে গণমাধ্যমও সরব হয়ে ওঠে। তবে একটি বিষয়ে সকলে নিশ্চিত ছিলেন যে অন্য দুইটি পদে যা-ই হোক বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক নার্গিস বেগমই থাকছেন সভাপতি পদে। অন্য দুই পদে একাধিক নেতার প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা শোনা যেতে থাকে। গতকাল ছিল মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা দেওয়ার দিন।

এদিন সকালে যে খবরটি সকলকে বিস্মিত করলো তা হল সভাপতি পদে থাকছেন না নার্গিস বেগম। শুরু হল মিশ্র প্রতিক্রিয়া। নেতা-কর্মীরা বিস্ময় কাটিয়ে প্রতিবাদমুখর হলেন তাঁর এ সিদ্ধান্তে। কর্মীরা তাঁর বাসায় গিয়ে অবস্থান নিলেন। দাবি ও অনুরোধ জানালেন সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের। কিন্তু প্রবীণ এ রাজনীতিক তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেন। কর্মীরা তখন ধর্ণা দিলেন দলীয় কার্যালয়ে। সেখানে অবস্থানরত দলের নির্বাহী কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) অনিন্দ্য ইসলাম অমিতসহ জেলার অন্যান্য নেতাদের কাছে দাবি করলেন তাদের মাতৃসম অধ্যাপক নার্গিস বেগম যেন তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন সেই অনুরোধ যেন তারা তাকে করেন।

তাদের দাবি যিনি পাঁচটি বছর অত্যাচার নির্যাতন সয়ে দলের নেতা-কর্মীদের মনে সাহস যুগিয়েছেন, এক সুতায় বেধে রেখেছেন। যখন যে প্রয়োজন সেই প্রয়োজন মিটিয়ে তাদেরকে রাজপথে থাকতে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন এবং নিজেও রাজপথে থেকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পুলিশের আক্রোশের শিকার হয়েছেন আজ কেন তিনি এই নিষ্কণ্টক সময়ে দলের শীর্ষ পদে থাকবেন না?

কিন্তু তিনি (অধ্যাপক নার্গিস বেগম) বললেন, দলের নেতৃত্ব রদবদল হবে এটাই স্বাভাবিক। বিএনপি একটি উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। এই দলে অবারিত গণতন্ত্রের চর্চা রয়েছে। সেই গণতন্ত্রের চর্চার অংশ হিসেবে দলের নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে আমার এমন সিদ্ধান্ত।

তাঁর কোন কথা মানতে চাইছেন না নেতা-কর্মীরা। তারা তাঁকে আজীবন তাদের মাথার উপরে দেখতে চান। দলের ভেতরে থেকে তিনি তারা স্নেহ-ভালোবাসায় তাদেরকে গতিশীল করবেন এটাই তাদের কামনা। আবার একই সাথে দলের বিজ্ঞজনেরা অধ্যাপক নার্গিস বেগমের এ সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। দেশের রাজনীতির জন্য শিক্ষণীয় বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

দলের যুগ্ম-আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকন বলেন, অধ্যাপক নার্গিস বেগম একজন উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ- এটা তারই যথার্থ প্রমাণ। উনি নিজে নেতৃত্ব থেকে সরে গিয়ে আজকে নতুনদের জন্য জায়গা করে দিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন এটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বিরল ঘটনা। এটা আমাদের বিএনপির জন্য না, সকল রাজনৈতিক দলের জন্য শিক্ষণীয়। আজকে আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলে নতুন নেতৃত্ব আনার যে চিন্তা করছেন, সেখানে আমাদের অভিভাবকের এমন দৃষ্টান্ত মাইফলক । উনি দলের নেতৃত্বে থেকে সরে গেলেও দলের আগামীর নেতৃত্ব তাকে ছেড়ে যাবে না। উনি বিগত দিনে আমাদের অভিভাবক হিসেবে যে ভাবে দল পরিচালনা করেছেন। আগামীর নেতৃত্বও তাকে নিয়ে দল পরিচালনা করবে।

জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান খান বলেন, অধ্যাপক নার্গিস বেগম আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ হিসেবে নতুন নেতৃত্ব তৈরির জন্য যে উদার মানসকিতার পরিচয় দিয়েছেন সেটি কেবলমাত্র যশোর নয় সমগ্র বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। উনি যাদেরকে মাতৃ স্নেহে আগলে রেখেছিলেন তাদের জন‍্য জায়গা ছেড়ে দিলেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে দাবি আমাদের প্রয়াত অভিভাবক তরিকুল ইসলাম দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। উনার শূন্যতায় তারই যোগ্য স্ত্রী স্বনামধন্য রাজনীতিক ও শিক্ষাবিদ হিসেবে নার্গিস বেগমকে যেন দল যথাযথ মূল্যায়ন করে।

এ বিষয়ে দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির খুলনা বিভাগী সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক বাবু জয়ন্ত কুমার কুন্ডু বলেন, অধ্যাপক নার্গিস বেগম এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে মহত্বের পরিচয় দিয়েছেন। আমাদের দেশে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত কেউ দায়িত্ব ছাড়তে চায় না। কিন্তু উনি দলে নতুন নেতৃত্বকে জায়গা দিতে গিয়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এটি একটি মহান সিদ্ধান্ত। উনার প্রতি আমরা বরাবরই শ্রদ্ধাশীল, তবে তাঁর এই সিদ্ধান্তের কারণে উনার প্রতি যশোর শুধু নয় সমগ্র খুলনা বিভাগের মানুষের শ্রদ্ধা আরো অনেক গুণ বেড়ে গেলো। সেই সাথে উনি নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। উনি এবং উনার পরিবার অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল চেতনা এবং আধুনিক রাজনীতির ধারক ও বাহক । নার্গিস বেগম ছাত্রজীবন থেকেই এগুলো ধারণ এবং লালন করেন।

আমি দলের একজন কর্মী হিসেবে না, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে তাঁকে সম্মান-শ্রদ্ধা করি। একজন মা, একজন নারী হিসেবে কীভাবে দল পরিচালনা করতে হয়, সেটা তিনি করে দেখিয়েছেন। তাঁর স্বামী দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম যখন দলের কারণে নিজে সংকটে নিমজ্জিত হতেন, তখন তিনি পরিবার সামলে কীভাবে দলীয় নেতা-কর্মীদের সাহস যুগিয়েছেন। তাদের মনোবল চাঙ্গা করেছেন এটা অনুকরণীর দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমাদের সকলের মাতৃতুল্য হয়েও তিনি দলের সকলকে যার যার অবস্থান থেকে যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন। উনি জেলা বিএনপির পদে থাকছেন না এটা আমাদের জন্য খুবই বেদনাদায়ক। আমি ব্যাক্তিগতভাবে খুবই মিস করবো।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ডামি নির্বাচন পরবর্তী সময়ে উনি দলের পক্ষ থেকে লিফলেট বিতরণের মত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে একজন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ এবং বয়জ্যেষ্ঠ নাগরিক হয়েও পুলিশের আক্রোশের শিকার হয়েছিলেন। এই ধরণের কর্মসূচিতে তিনি সম্পৃক্ত না থাকলেও দলের কাছে উনাকে কোন জবাবদিহি করতে হতো না। তারপরও তিনি দলের সংকটময় মুহূর্তে কোনদিনই থেমে থাকেননি। সেই নেত্রী আজকে নিজে দলের নেতৃত্ব থেকে সরে গিয়ে অন্যদের জন‍্য জায়গা করে দিলেন, আমি তাঁর এই সিদ্ধান্তকে ব্যক্তিগত ভাবে স্যালুট জানাই।

এই প্রতিবেদক যখন অধ্যাপক নার্গিস বেগমের প্রতিক্রিয়া জানতে চান, তখন হাসি মুখে তিনি বলেন, বক্তব্যের কিছু নেই। দলের নেতৃত্বে রদবদল হবে এটাই স্বাভাবিক। বিএনপি একটি উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। এই দলে অবারিত গণতন্ত্রের চর্চা রয়েছে। সেই গণতন্ত্রের চর্চার অংশ হিসেবে দলের নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে আমার এমন সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দলে কেবল মাত্র নতুন নেতৃত্ব তৈরি হবে না, দল আরও গতিশীল ও সুসংগঠিত হবে।

এদিকে শেষ খবর পাওয় পর্যন্ত গতকাল যশোর জেলা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং তিনটি সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আটজন মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে সভাপতি পদে অ্যাড. সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, আলহাজ্ব মিজানুর রহমান খান ও মারুফুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক পদে দেলোয়ার হোসেন খোকন ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে মুনির আহমেদ সিদ্দিকী বাচ্চু, কাজী আজম, প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম ও শহিদুল বারী রবু মনোনয়নপত্র জমা দেন।

এসময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, নির্বাচন কমিশনের আহ্বায়ক অ্যাড. মো. ইসহক, অ্যাড. হাজী আনিছুর রহমান মুকুল, ডা. এস এম রবিউল আলম, সাইফুল ইসলাম সজল প্রমুখ।