যশোর সদরের সালতাপীরের ঢিবি, ৫০ বিঘা এলাকা জুড়ে মাটি চাপা রাজপ্রাসাদ!

0

তহীদ মনি ॥ যশোর সদর উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের সালতাপীরের ঢিবিতে খনন শুরু করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া প্রাথমিক খননেই একটি রাজপ্রাসাদের অস্তিত্ব আবিস্কারের অপেক্ষায় রয়েছেন প্রত্ন বিশেষজ্ঞরা।

তাদের অনুমান ৫০ বিঘা ভূমির চার পাশে পরিখা বেষ্টিত রাজপ্রাসাদ চাপা পড়ে আছে মাটির নিচে। এ সীমানার মধ্যে শান বাঁধানো পুকুর ও সীমানা প্রাচীরের অস্তিত্ব এখনো স্পষ্ট। পুরো সীমানার মাঝ বরাবর একটি উচু ঢিবি, যেটাকে স্থানীয়রা সালতাপীরের ঢিবি বা বুড়িমার থান বলে থাকেন, সেটি ১০ দিন খনন করে মসজিদ আকৃতির একটি স্থাপনার সন্ধান পেয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এ স্থাপনাকে সামনে রেখে স্থানটি মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন বলে অনুমান করছেন গবেষক দলের প্রধান প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন।

তিনি বলছেন, প্রাথমিক খননে দুই স্তর বিশিষ্ট দেওয়াল দেখা গেছে। যা এ অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার ইতিহাসে নতুনত্ব এনেছে। সব মিলিয়ে যশোরের ইতিহাস নতুন করে গবেষণা ও ভাবার সময় এসেছে।

যশোর-মাগুরা সড়কের রাজাপুর বাজার থেকে পশ্চিমের পাকা রাস্তা ধরে ৩ কিলোমিটার গেলেই ফুলবাড়ি পীর সিদ্দিন আওলিয়া মাজার ও স্কুুল। সেখান থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে গেলেই ওসমানপুর গ্রাম। এ গ্রাম লাগোয়া সালতা মাঠ। চারিদিকে ধান ক্ষেত, ফসলি জমির মাঝে প্রায় ৫০বিঘা উঁচু ভূমি। কোথাও ঘন জঙ্গল, কোথাও ফলদ, কোথাও বনজ গাছের বাগান। চার পাশের একই আকৃতির ধান ক্ষেত সুস্পষ্ট পরিখার প্রমাণ দিচ্ছে। উচু ভুমির মধ্যে ঘন জঙ্গল বেষ্টিত সবচেয়ে উচু ভূমিই সালতা পীরের ঢিবি।

স্থানীয়রা যাকে বুড়িমার থান বা ‘বুড়োমার দরগা’ বলে থাকেন। দীর্ঘ বছর ধরে এ থানে মানত করে, ধুপ জ¦ালায় স্থানীয় বাসিন্দারা। খায়রুল নামের এক ব্যক্তি এ দরগার খাদেমের দায়িত্বও পালন করেন। তবে থান বা বুড়ি মার বিষয়ে কেউ কিছুই জানেন না। বতর্মানে যারা ওই এলাকায় বসবাস করছেন, যাদের বষস ৭০-৮০ বছর তারাও বলছেন তাদের বাবা-দাদারাও কিছু জানতেন না।

স্থানীয়দের বিশ্বাস করেন, বুড়িমার থান ও দেড় কিলোমিটার দূরের পর ফুলবাড়ি বাজারের দীঘি ও হযরত সিদ্দীন আউলিয়া (র) এর মাজার একই সূত্রে গাথা। সিদ্দীন আউলিয়া ওই বুড়ি মায়ের ছেলে। বাগেরহাটের পীর আউলিয়া খানজাহান আলী(র) এই এলাকায় যখন এসেছিলেন, হযরত সিদ্দীন (র) সেই সময় এসেছিলেন। জ্বীন পরীরা এখানকার দীঘি খনন করে। এ বিশ্বাস থেকেই জঙ্গল ঘেরা ঢিবিতে সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বলে, মানত করে, ধূপ-ধুনা দেয়, মুর-িখাসি ছেড়ে দিয়ে মানত শোধও করে স্থানীয়রা। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সব ধর্মর মানুষ গভীর ভক্তি-শ্রদ্ধা সেখানে মিলিত হয়।

ঢিবি সংলগ্ন উঁচুভিটার কয়েকবিঘা জমির মালিক অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আকবার আলী খান। তিনি জানান, নানাবাড়ির সম্পত্তির ওয়ারিশ সূত্রে এই জমির মালিক তিনি। এই স্থান ভয়ের জায়গা ছিল। মানত-পূজা, রান্না সবই হয় এই দরগায়। বালামুসিবত এলে অনেকেই রাতজেগে জিকির আসগর করে। জমিতে গাছ লাগাতে যেয়ে ইটের টুকরো পান। কয়েকবছর আগে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটি সরিয়ে ঘরের ভিত্তি বা দেওয়ালের মতো কিছু পেয়েছিলেন, লোকে নিষেধ করায় আর খনন করেননি। তিনি প্রচিলত কয়েকটি উপকথাও শুনিয়ে জানান, এই জমির কিছু কেউ নিয়ে গেলে তার বিপদ হতো। মানুষের ভিতর এক ধরণের ভয় কাজ করতো।

তার জ্ঞাতিভাই ষাটোর্ধ্ব কৃষক আব্দুর রাজ্জাক জানান, তিনি এটি মসজিদ কিনা দেখার জন্যে গড়ের পশ্চিম দিকে লম্বা করে খনন কাজ করেছিলেন, স্থানীয়রা তাকে বিভিন্ন প্রকার ভয় দেখায় এবং তাদের চাপে তিনি খনন বন্ধ করেন।

ওই গ্রামের ৬৩ বছরের আক্তারুজ্জামান খানও একই রকম কথা শোনান। তারা কেউ এর ইতিহাস জানেন না, পূর্ব পুরুষের কাছে বংশানুক্রমে বিভিন্ন কথা ও কাহিনী শুনেছেন আর মানুষকে বিশ্বাস ও ভক্তি করতে দেখেছেন। হিন্দু মুসলিম সবাই এখানে আসেন, সম্মান করেন।

যশোর জেলার চতুর্থ প্রত্নঢিবি হিসেবে সদর উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের এই সালতা গ্রামের সালতাপীরের ঢিবিতে ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে পরীক্ষামূলক প্রতাত্ত্বিক খনন কাজ শুরু হয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক দপ্তরের পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন এর নেতৃত্বে গঠিত ৮ সদস্য বিশিষ্ট অভিজ্ঞ খননটিম খননকাজ পরিচালনা শেষে প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত নমুনা নিয়ে গবেষণা করবেন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিয়মানুসারে গবেষণা শেষে এটা কোন আমলের স্থাপনা, কোন সভ্যতা বা যুগের সাথে সম্পর্কত সে সব বিষয় অনুসন্ধান ও গবেষণার ফল জানাবেন। সরকারিভাবে খনন কাজ হচ্ছে বলে প্রতিদিন সালতা ওসমানপুরসহ আশে পাশের গ্রাম থেকে নারী পুরুষ বৃদ্ধ শিশু যুবক স্থানটিতে ভিড় করছে।

২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে যশোর সদর উপজেলায় পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের সময় এই এলাকায় মাঝারি আকৃতির উচ্চতা বিশিষ্ট ঢিবিটি শনাক্ত হয় এবং প্রাথমিক ৫ থেকে ১০ দিনের খনন কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৬৮ সালের প্রত্নসম্পদ আইন অনুযায়ী এর প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব পরিলক্ষিত হওয়ায় ঢিবিটিকে জরিপ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে সংশি¬ষ্ট অধিদপ্তর।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক দপ্তরের পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন জানান, প্রাথমিক ভাবে ঢিবির নীচে আদি ঐতিহাসিক থেকে আদি মধ্যযুগের বিলুপ্ত সাংস্কৃতিক নিদর্শন লুকায়িত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটা মুসলিম সভ্যতার একটি নিদর্শন। এর দুই স্তর বিশিষ্ট দেওয়াল এদ্বাঞ্চলে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার সাথে নতুনত্ব এনেছে।

সালতা পীরের ঢিবিটি অন্তত ৫০ বিঘা জমির উপর দাড়িঁয়ে, এর কেন্দ্রস্থলে মূল ঢিবি, চারিপাশে পরীখা বেষ্টিত, রয়েছে পুকুর ও শান বাঁধানো পুকুর ঘাটের চিহ্ন এবং মূল ঢিবিটির অন্তত ৬০ ফুট দূরত্বে চারিদিকে প্রাচীরের চিহ্ন। তিনি মনে করেন, এটা ছিল কোনো শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থল, পুরাতন কোনো সভ্যতার অংশ। তবে গবেষণা শেষে এর উত্তর মিলবে জানিয়ে তিনি নিশ্চিত করেন যে, স্থাপনাটি মুসলিমদের।

যেহেতু ফুলবাড়ি বাজারের দীঘিটি ও পাশের মাজার রয়েছে, হতে পারে এই কেন্দ্রের রাজত্ব এর চারিপাশে বিস্তৃত ছিল, তবে নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্ত তিনি এখন দিতে পারেন না।

আশেপাশে বারোবাজারের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা ও মুসলিম সভ্যতা, অদূরের দীঘি ও পীর হযরত সিদ্দীন আউলিয়া(র) এর মাজার এবং খলিফাবাদ বা বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ-দীঘির সাথে সম্পর্ক আছে কিনা তা অধিদপ্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবে। এখান থেকে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু, বিলুপ্ত স্থাপত্যকাঠামো পুনরুদ্ধার, স্তরবিন্যাস সমীক্ষা ও বিশে¬ষণ করে আপেক্ষিক সময়কাল নির্ধারণের পাশাপাশি ঢিবির পরম সময়কাল নির্ধারণের লক্ষ্যে প্রত্নস্থান থেকে কার্বন-১৪ টেস্টের নমুনা সংগ্রহ করা হবে।

পরীক্ষামূলক খননে প্রাপ্ত ফলাফলের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে এখানে ধারাবাহিক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলেও তিনি জানান। তিনি আরো বলেন, গবেষকরা দাবি করেন, যশোরের ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়, কিন্তু মণিরামপুরের দমদম পীরের ঢিবিসহ জেলায় হিন্দু ও মুসলিম সভ্যতার অনেক নিদর্শন রয়েছে ফলে নতুন করে গবেষণা ও ভাবার সময়ও এসেছে।