আমাদের বিভ্রান্তি আর কাটবে কবে?

0

আবু নাসের অনীক ।। সহস্র জীবন আর সহস্রাধিক মানুষের রক্তের বিনিময়ে ছাত্র- জনতার গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ পেয়েছে জাতি ৫ আগস্ট। সংঘটিত অভ্যুত্থান নিয়ে দেশের নাগরিকের চিন্তায় উদ্রেক ঘটছে হাজারো প্রশ্নের। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক তার সাংগঠনিক পরিচয় শিবির এটি গোপন রেখে তৎপরতা চালিয়ে ছিলেন। ২১ সেপ্টেম্বর তার সাংগাঠনিক পরিচয় প্রকাশিত হয়। তিনি শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি। তার পরিচয়টি এভাবে সামনে আসায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা যাচ্ছে।

ঢাবি’র শিবির সভাপতির পরিচয় প্রকাশ্যে আসার পর একটি অংশ যারা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সমর্থকগোষ্ঠী এবং পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারকে গত ১৫ বছর ধরে যারা টিকে থাকতে সহযোগিতা করেছে তারা ব্যাপক সোচ্চার হয়ে উঠেছে। তাদের বক্তব্য, ‘আগেই তো বলেছিলাম এটা শিবিরের আন্দোলন/ তাদের চক্রান্ত’; ‘দেশ এখন রাজাকারদেও দখলে’; ‘মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা জয়ী হয়েছে’; এরকম নানা ধরণের আওয়াজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরগরম। এই মুভমেন্টে শিবির, ছাত্রদল, হেফাজত, হিযবুত তাহেরীসহ একটি পর্যায়ে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট বিরোধী সকল রাজনৈতিক শক্তি সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। এটা তো কারো অজানা ছিলো না। যারা মুভমেন্ট করেছেন তারা যেমন জানতেন একই রকমভাবে তৎকালীন সরকারও জানতো। ২৪ জুলাই যখন ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায়; আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক পশু সেই সব পশুদের; শিরোনামে প্রকাশিত একটি লেখাতে আমি লিখেছিলাম, “এখন বলছেন, বিএনপি-জামাত এই সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে। আপনাদের কথাই ধওে নিলাম তারাই এসব করছে; সেই পরিস্থিতি তো আপনারাই তৈরি করে দিয়েছেন। দিনের পর দিন সরকারের নেতা-মন্ত্রী আপনারা বলেছেন, এটা কোর্টের বিষয় সরকার কিছু বলতে পারবে না। কোর্টেও রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

গোয়ার্তুমি করে সময় ক্ষেপণ করলেন। এরপর আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে কটাক্ষ করে তাদেরকে আরো বেশি উত্তেজিত করে তুললেন! সুকৌশলে তাদেরকে রাজাকার ট্যাগ দিলেন! শুধু তাই নয়, আপনাদের লাঠিয়াল বাহিনী ছাত্রলীগ- যুবলীগ-পুলিশ দিয়ে বল প্রয়োগ করে আন্দোলন দমন করতে যেয়ে অমানবিক নির্যাতন করলেন; ছাত্র হত্যাকান্ডের মতো ঘটনা ঘটালেন!

এরপর চূড়ান্তভাবে বল প্রয়োগ করে একের পর এক হত্যাকান্ড সংঘটিত করলেন!! আপনারা গত ৫/৬ দিন ধরে যা যা করলেন এইটা না করলে তো বিএনপি-জামাত বলেন আর ছাত্রশিবির-ছাত্রদলের কথাই বলেন, কারোই তো এই আন্দোলনে ঢোকার মতো পরিস্থিতি ছিলোনা। এসব করে তাদেরকে তো আপনারাই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন।

একটি আন্দোলনে বিভিন্ন ধরণের ইন্টারেস্ট গ্রুপের অংশগ্রহণ তৈরি হয়। আন্দোলন যতোই প্রলম্বিত হতে থাকে ইন্টারেস্ট গ্রুপের অংশগ্রহণ ততোই বাড়তে থাকে। সরকারের দায়িত্ব থাকে সেটিকে দক্ষতার সাথে হ্যান্ডেল করা। আপনারা শুধুই দোষারোপ করলেন আর এর বিনিময়ে কমলমতি ছাত্রদের প্রাণ কেড়ে নিলেন! চরম অদক্ষতার পরিচয় দিলেন”।

এমন মতামত প্রকাশ করে সেসময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার মতো অনেকেরেই লেখা এসেছে। কিন্তু আপনারা কর্ণপাত করেন নাই। বরং কি করেছেন, একের পর এক হত্যাকান্ড চালিয়ে গেছেন। আপনারা কি আশা করেছিলেন? এই আন্দোলনে বিএনপি-জামাত সক্রিয় হয়েছে বলে অন্যরা আপনাদেরকে রক্ষার কথা ভেবে আন্দোলন থেকে বেরিয়ে যেয়ে আন্দোলনকারীদের বিপক্ষে দাঁড়াবে বা নিউট্রালাইজ হয়ে যাবে?

৫ আগস্টের গণঅভ্যূত্থান একটি অনিবার্য পরিণতি হিসাবে নির্ধারিত হয়ে গেছিলো জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহেই। দীর্ঘ ১৫ বছরের শোষন-বঞ্চনা, সীমাহীন লুটপাট-দুর্নীতি, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার, দেশের নির্বাচন, আইন ব্যবস্থাসহ প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া, হত্যা-গুম, মত প্রকাশ করতে না দেওয়া, ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া, উন্নয়নের নামে প্রাণ-প্রতিবেশ ধ্বংস করা, একচ্ছত্র ক্ষমতাতন্ত্র-গুন্ডাতন্ত্র কায়েম করা এই সবকিছুই আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানের অনিবার্যতা তৈরি করে দিয়েছিলো।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বনাম রাজাকার এই ন্যারেটিভ দিয়ে আর বেশিদিন এই শাসন এগিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিলো না। নিজ দেশের জনগণকে যখন সরকার গণহত্যা করে আন্দোলন দমন করতে যায়, তখন সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকল হয়ে যায়; এর বিপরীতে তাকে রক্ষা করার জন্য।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন ঘটনা যে ঘটবে সেটা বহুবার আওয়ামী লীগকে সতর্ক করা হয়েছে। তাদের মিত্রদেরকে বলা হয়েছে। তখন তারা একটি কথাও কানে তোলেন নাই। বরং এমন কথা যাতে আইনগতভাবে কেউ বলতে না পারে তার জন্য ডিজিটাল অ্যাক্ট তৈরি করেছেন।

শুধুমাত্র রাজনৈতিক সমালোচনা করার জন্য গুম করা হয়েছে, গ্রেফতার করে জেলে পোরা হয়েছে; কোনও সময় হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে। কিশোর, মুস্তাকসহ এমন আরো অনেকের কথা মনে পড়ে আপনাদের? শুধুমাত্র সরকারের অনিয়মের রাজনৈতিক সমালোচনার কারণে তাদেরকে রাষ্ট্রদোহের অভিযোগে নির্যাতন কওে মাসের পর মাস জেলে পুরে রেখেছিলেন। লেখক মুস্তাককে তো হত্যা পর্যন্ত করলেন।

এই রাজনৈতিক সমালোচনাগুলো করা হতো যাতে বাংলাদেশকে আজকের এই বাস্তবতা দেখতে না হয়। কিন্তু আপনারাই তো এই অবস্থাটা দেখতে চেয়েছিলেন। না চাইলে তো স্বাধীন মতামত প্রকাশকে দমন করতেন না। বরং নিজেদেরকে সংশোধন করে নিতেন।

ঢাবি’র শিবিরের সভাপতি জুলাইয়ের আন্দোলনের পূর্বে ছাত্রলীগের অনুচর হিসাবেই তো ছিলেন। বিএনপি’র সময়ে যেমন শিবির ছাত্রদলের মধ্যে শেল্টার নিয়ে থাকতো। এটা তো নতুন কিছু না। এত প্রতিক্রিয়া দেখানোর কি আছে? আছে এজন্য যে এবার তারা প্রকাশ্যে সেটা ঘোষণা দিয়েছে। এবং সাধারণ ছাত্ররা তার পরিচয় জানার আগেই ঢাবি ভিসি তার পরিচয় জানতেন। আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে তো বাংলাদেশে অনেক কিছুই নতুন ঘটছে।

মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তো গত ১৫ বছর ধওে আপনারাই জিইয়ে রেখেছেন যারা আজকে হতবাক হয়ে যাচ্ছেন। এখন যা কিছু ঘটছে সেসব নিয়েও বিস্তর সমালোচনা আছে। কিন্তু এইটা ভাববেন না যে, তার জন্য আওয়ামী ফ্যাসিস্টের গত ১৫ বছরের কর্মকান্ড জাস্টিফাইড হয়ে যাবে। এটা ভাবার কোন অবকাশ নেই।

আমাদের যেসমস্ত প্রগতিশীল বন্ধুরা এই বিষয়ে ব্যাপক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন; একইসাথে এই বক্তব্য উপস্থাপন করছেন, ‘এমনটাই তো হবে বলেছিলাম’; তাদের উদ্দেশ্যে বলবো এসব বাদ দিয়ে আগে আত্মসমালোচনা করুন গত ১৫ বছরের জন্য। একটি সরকারকে ফ্যাসিস্ট হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে আপনারাই সবচেয়ে বেশি সহায়ক ভূমিকা রেখেছেন। এইটা রীতিমতো অপরাধ। সেজন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।

আরও একটি বিষয়, এই আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদসহ অপরাপর বিভিন্ন গোষ্ঠীর যুক্ততা ছিলো। সেটিও কিন্তু আন্দোলনকারী শক্তিসমূহ জানতো। বামপন্থীরাও জানতো। এবার বলতে পারেন তারা সাম্রাজ্যবাদের পারপার্স সার্ভ করসে!

৭১ সালেও কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ এক্টিভ ছিলো। একদিকে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ আর অন্যদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। তার জন্য কিন্তু দেশের মানুষ লড়াই বন্ধ করে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যায়কে রক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে নাই। এবারও একই রকমভাবে ফ্যাসিস্ট গণহত্যাকারী পতিত আওয়ামী সরকারকে রক্ষা করার জন্য আন্দোলন থেকে সরে আসে নাই। কারণ দেশের অভ্যন্তরে গণহত্যা সংঘটিত করবেন আর আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদসহ অন্যদের চক্রান্ত আছে এই বিবেচনায় গণহত্যাকে সমর্থন করে কোন সুস্থ- স্বাভাবিক মানুষ স্থির আর নির্লিপ্ত হয়ে থাকতে পারে না। তাতে যদি চরম দক্ষিণপন্থী শক্তির বিকাশ ঘটে তাও না। পূর্বেই বলেছি তার মূল কারণ ছিলো অনিবার্যতা। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের অনিবার্যতা ঠেকানোর উইপেন ছিলো একমাত্র আওয়ামী লীগের হাতে। সে সেটা ব্যবহার না করে বরং অনিবার্যতাকে আরো তীব্র কওে তুলেছিলো।

প্রত্যেকটি গণঅভ্যুত্থানেরই অর্জন থাকে। সবসময় এই অর্জন শতভাগ নাও হতে পারে। আবার অনেক সময় সেটি কিছু ঝুঁকিও তৈরি করতে পারে। তবে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় যেটা অর্জন সেটি হলো, জাতির জীবনে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা ফ্যাসিস্টকে উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়েছে। অভ্যুত্থানটিতে সকল স্তরের নাগরিকের বহুমুখী সক্রিয় অংশগ্রহণ ঘটেছে। জনমনে একটি বিশ্বাস স্থাপিত হয়েছে যে, ফ্যাসিস্ট যতোই শক্তিশালী হোক না কেন জনগণের ঐক্যবদ্ধতা তাকে উচ্ছেদ করতে সক্ষম। নাগরিকের মনে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বহুগুন। যে প্রশ্ন করার অধিকার সে হারিয়ে ফেলেছিলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, সেটি এখন সে চর্চা করতে পারছে। এসব নিয়ে বিস্তারিত অন্য কোন লেখায় আলোচনা করবো।

এটা ঠিক যে, অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে চরম দক্ষিণপন্থী শক্তির বিকাশ ঘটছে। সেটিকে রাজনৈতিভাবেই মোকাবেলা করতে হবে। এমন একটি রাজনীতি বির্নিমান করতে হবে যার হাত ধরে আগামীতে চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিকাশ না ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার না করে সেটি যেন নাগরিক জীবনে প্রতিফলন ঘটে সেই রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে হবে।

লেখক: আব নাসের অনীক-রাজনৈতিক বিশ্লেষক।