রাজারহাটে বিপুল চামড়া, তবে দাম নিয়ে দ্বিমত মৌসুমী ব্যবসায়ী ও আড়তদারের

0

আকরামুজ্জামান ॥ কুরবানি ঈদ পরবর্তী শনিবার দ্বিতীয় হাটে বিপুল পরিমাণ চামড়া ওঠে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্ববৃহৎ মোকাম যশোর রাজাটহাটে। অবশ্য সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তবে আড়তদার ও ট্যানারি ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিদের দাবি খুচরা ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যতটা অভিযোগ করছেন সেটি শতভাগ সঠিক নয়। বৈরী আবহাওয়া ও চামড়ার সঠিক সংরক্ষণের অভাবে গুণগত মান কমে দামে হেরফের হওয়ায় বাজারে এ অস্থিরতা নেমেছে। মানসম্মত চামড়া ঠিকই কাঙ্খিত দামে বিক্রি হচ্ছে বলে তারা দাবি করেন।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম বড় চামড়ার মোকাম যশোরের রাজারহাট। খুলনা বিভাগের ১০ জেলার ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজশাহী, পাবনা, ঈশ্বরদী, নাটোরের বড় ব্যবসায়ীরা এ হাটে চামড়া বেচাকেনা করেন।
প্রতিবছর ঈদ পরবর্তী হাটগুলোতে বৃহত্তম এ চামড়ার মোকাম থেকে বিপুল পরিমাণ চামড়া বিক্রি হয়ে আসলেও গত প্রায় তিন বছর ধরে এ মোকামে দরপতনের কারণে বেচাকেনায় ধস নেমে আসছে। পরিস্থিতির জন্য ব্যবসায়ীরা ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেট ও সরকারের কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত কার্যকর না হওয়াকে দায়ী করে আসছেন।
ব্যবসায়ীদের দাবি গত কয়েক বছর ধরে কুরবানি মৌসুমে চামড়ার দরপতনের পর এবার তারা প্রত্যাশা করেছিলেন কাঙ্খিত দামে চামড়া বিক্রি করে কিছুটা হলেও ক্ষতি পুশিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু ঈদ পরবর্তী দ্বিতীয় হাটে খুচরা ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা তাদের মজুদ করা চামড়া বাজারে তুললেও দাম নিয়ে রীতিমত হতাশ হন।
শনিবার সকালে রাজারহাট চামড়া বাজারে গিয়ে দেখা যায়, হাটে বিপুল সংখ্যক ব্যবসায়ী চামড়া নিয়ে বসে আছেন। গত মঙ্গলবার প্রথম হাটে ক্রেতা-বিক্রেতাদের অনুপস্থিতির কারণে সুনসান নীরবতা থাকলেও শনিবার মানুষের উপস্থিতি সরব ছিলো। বেচাকেনায় ছিলো তুলনামূলক বেশি। তবে কাঙ্খিত দাম পাচ্ছেন না বলে জানান মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
তাদের অভিযোগ চামড়ার আমদানিতে হাট পরিপূর্ণ থাকলেও বাইরের জেলা থেকে আগত ক্রেতা ও ব্যাপারিদের সংখ্যা একেবারেই কম। অপরদিকে যশোরসহ পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে বিক্রির উদ্দেশ্যে চামড়া নিয়ে আসােেমৗসুমি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, সরকার নির্ধারিত মূল্য অর্থাৎ চামড়ার কাঙ্খিত দাম পাচ্ছেন না। বাইরের জেলার বড় ব্যাপারি ও ট্যানারি মালিকেরা এ হাটেঁ না আসায় স্থানীয় ব্যাপারিদের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে লোকসানে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের বলে অনেকের অভিযোগ।
কথা হয় পাইকগাছা থেকে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রাজ কুমারের সাথে। তিনি বলেন, আমি আজকের হাটে মাত্র ৯০ পিস চামড়া এনেছি শুধুমাত্র দাম যাচাই করার জন্য। প্রতি পিস চামড়া ৬০০ টাকা দরে বিক্রি করে দিয়েছি। তবে এই দামে চামড়া বেঁচে আমরা লাভতো দূরের কথা পূঁজিও রক্ষা করতে পারবো না। তিনি বলেন, চামড়া কেনা, লবণ দেওয়া, শ্রমিক খরচ, হাটে আনা, গুদাম ভাড়াসহ এক পিস চামড়ায় খরচ হয় ৬৫০ টাকা থেকে ৭শ টাকা। অথচ চামড়া বিক্রি করে আমরা সে দাম পাচ্ছি না।
একই কথা বলেন, মনিরামপুর থেকে আসেন শুকলাল নামে এক মৌসুমি ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ৬ পিস গরুর চামড়া ও ১৬ পিস ছাগলের চামড়া নিয়ে এসেছি। গরুর প্রতি পিস চামড়ায় কেনাসহ হাট পর্যন্ত নিয়ে আসতে আনুষঙ্গিক খরচ হয়েছে ৭৭০ টাকা। ব্যাপারিরা দাম বলছে প্রতি পিস গরুর চামড়া ৪০০ টাকা। অপরদিকে ছাগলের চামড়ায় কেনা খরচ ৫০ টাকা, ব্যাপারিরা দাম বলছে ২০ থেকে ৩০ টাকা। তিনি বলেন, এ দামে চামড়া বিক্রি করলে আমার পথে বসা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। হাটের নিয়ন্ত্রক ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
রাজারহাট চামড়া মোকামের ব্যবসায়ী হাসিব চৌধুরী বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি হচ্ছে না। ভালো মানের গরুর চামড়া ৫০ থেকে ৫৫ টাকা বর্গফুট এবং ছাগলের চামড়া প্রতি পিস ১৫ থেকে ২০ টাকা নির্ধারিত। কিন্তু আমরা গরুর ভালো চামড়া প্রতি বর্গফুট ৩০ থেকে ৩৫ টাকা দরে কিনছি। তিনি বলেন, চামড়া প্রক্রিয়াজাতের সঙ্গে যেসব কেমিক্যাল দরকার, সেগুলোর দামও বেড়েছে। এসব কারণে চামড়ার দামের সাথে বর্তমান বাজারদর সামঞ্জস্য হচ্ছে না।
অমিত সরদার নামে আরেক ব্যবসায়ী জানান, ২০০ পিস গরুর চামড়া কেনাসহ সংরক্ষণ ও লবণ খরচ দিয়ে মোট খরচ পড়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এ হাটে এসে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার বেচাকেনা হয়েছে। এ চালানে ২০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে তার। আরও কিছু গরুর চামড়া সংরক্ষণে রেখেছেন সেগুলো যাচাই করে সামনের হাটগুলোতে বিক্রি করবেন বলে তিনি জানান।
ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুর থেকে চামড়া কিনতে এসেছেন একটি ট্যানারি মালিকের প্রতিনিধি সিদ্দিক হোসেন। তিনি বলেন, হাটে আমরা যে মানের চামড়া কিনতে চাই সেই মানের চামড়া পাচ্ছি না। এখানে চামড়ার মান তেমন ভালো পাচ্ছি না। যে চামড়া পাওয়া যাচ্ছে তা তৃতীয়-চতুর্থ গ্রেডের। এসব চামড়া বেশি দামে কেনা সম্ভব না।
কুষ্টিয়া থেকে চামড়া কিনতে রাজাহাটে এসেছিলেন সোনালী ট্রেড এর মালিক কাজী আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, হাটে অনেক চামড়ার আমদানি। দাম আমাদের আয়ত্ত্বের মধ্যে। তবে চামড়ার মান ভালো মন্দ মিশিয়ে। এবছর টানা তাপপ্রবাহ ও গরমের কারণে চামড়ার মান কমে গেছে বলে তিনি দাবি করেন। তাছাড়া খুচরা ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া সংরক্ষণে যতœ না নেওয়ায় এ পরিস্থিতি হয়েছে। তিনি বলেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা তাদের ভুলের খেসারত দিচ্ছে। তারা চামড়া সংরক্ষণে গাফিলতি করেছে।
এ বিষয়ে রাজরহাট চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির নেতা হাসানুজ্জামান হাসু বলেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা গণহারে যে অভিযোগ করছেন এটি সঠিক নয়। তারা পানির দরে চামড়া কিনে বাজারে এনেছেন। সে হিসেবে তারা ৫ থেকে ৭শ টাকা চামড়া বেঁচে লোকসান করছেন এটি ঠিক না। অনেকে ২শ থেকে ৩শ টাকা দিয়েও গরুর চামড়া কিনে এনেছেন বলে তিনি দাবি করেন।
তবে দাম নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের এসব ক্ষোভের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন বৃহত্তম যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন মুকুল। তিনি বলেন, শনিবারের হাটে যে দামে চামড়া বিক্রি হয়েছে তাতে ব্যবসায়ীদের হতাশ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ দামে চামড়া বিক্রিতে ব্যবসায়ীরা প্রতি পিস চামড়ায় প্রায় ২শ টাকা লাভ করতে সক্ষম।
তিনি বলেন, ঈদের পরের দিন মঙ্গলবার যে হাট ছিলো সেটি মূল হাট ছিলো না। শনিবারই মূল হাট। এ হাটে প্রায় ৩৫ হাজার গরুর আর ২০ হাজার ছাগলের চামড়া উঠেছে। প্রথম হাটে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকার চামড়া বিক্রি হবে বলে তিনি দাবি করেন। একই সাথে সামনের হাটগুলোতেও চামড়ার বেচাকেনা বাড়বে বলেও তিনি জানান।