ব্যয় বেড়ে মধ্যবিত্তরাও এখন অসহায় সংসার চালাতে বাড়ছে ঋণের বোঝা

0

আকরামুজ্জামান ॥ যশোর শহরতলীর উপশহর এফ ব্লকের একটি ভাড়াবাড়িতে বাস করেন আমিনুর রহমান। শহরের দড়াটানা এলাকার একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাকরি করেন তিনি। বাসা ভাড়া ৬ হাজার টাকা, বাজার খরচ মাসিক ১০ হাজার টাকা, দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ ৫ হাজার টাকাসহ অন্যান্য খরচ মিটিয়ে বেতনের পুরো টাকা শেষ করে এতোদিন কোনো রকম টিকে ছিলেন তিনি। কিন্তু নতুন বছরের শুরুতেই অর্থনৈতিক ধাক্কায় তিনি সামাল দিতে পারছেন না। বেতনের টাকা ব্যয় করেও গত জানুয়ারি মাসে তাকে দুই হাজার টাকা ঋণের মুখে পড়তে হচ্ছে। সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপের আভাস পেয়ে তিনি বড় চিন্তায় পড়েছেন।
আমিনুর রহমান বলেন, নতুন বছরে বাসা ভাড়া বেড়েছে। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ বেড়েছে। সেই সাথে চাল, ডাল, গ্যাসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও বেতন বাড়েনি। যেকারণে সংসারের বাড়তি ব্যয়ের সাথে সামাল দিতে গিয়ে তিনি পেরে উঠছেন না। এ অবস্থায় কী করবেন তাই-ই ভেবে উঠতে পারছেন না তিনি।
একই ধরনের আক্ষেপ করছিলেন একই এলাকার বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন। তিনি শহরের নলডাঙ্গা রোডের একটি দোকান ভাড়া নিয়ে মোটরসাইকেল মেরামতের কাজ করে সংসার চালিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন। এতো দিনের আয় দিয়ে তিন ছেলের লেখাপড়া, ঘরভাড়া, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা সাশ্রয়ী করছিলেন। কিন্তু জানুয়ারি মাসের খরচ মিটিয়ে তিনি কোনো টাকা জমাতে পারেননি। এরই মধ্যে বাসা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
শহরের পূর্ব বারান্দিপাড়া এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম জানান, তিনি শহরে ছোটখাটো একটা ব্যবসা করে মাসে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করতেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ওই এলাকায় বাস করে আসছেন। সন্তানদের শহরে পড়ানোর খরচ মেটাতে না পেরে গত ডিসেম্বরে স্ত্রী ও সন্তানদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন একাও শহরের ভাড়াবাসার খরচ মিটিয়ে সংসার চালাতে পারছেন না তিনি। বাধ্য হয়ে এ মাসে ছোট্ট একটি রুম আড়াই হাজার দিয়ে সাবলেট নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
আরিফুল ইসলাম বলেন, নিত্যপণ্যর বাজার এখন চরম পর্যায়ে থাকায় তার মতো লোকের শহরে জীবন-যাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় তিনিও গ্রামে চলে যাবেন বলে জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুই মাসের ব্যবধানে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুুুুুুুুুুুুুুুুুুুষের সংসার জীবনে বড় প্রভাব ফেলেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বাজারদর নিয়ন্ত্রণের বারবার আশ্বাস দেওয়া হলেও স্বস্তি মিলছে না ভোক্তাদের। উল্টো সময় যত গড়াচ্ছে ততই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে হু হু করে।
যশোর বড়বাজার এলাকার রহমানিয়া স্টোরের বিক্রয় প্রতিনিধি আরমান হোসেন বলেন, প্রতি মাসেই পণ্যর দাম বাড়া ছাড়া কমার কোনো খবর নেই। তিনি বলেন, গত নভেম্বর মাসে প্রতি কেজি চিনি ১৩৫ টাকা বিক্রি হলেও এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকারও বেশি। আর মসুর ডাল বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকা। যা ডিসেম্বরে বিক্রি হয়েছে ১৩৫ টাকা আর এখন জানুয়ারিতে বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়। প্রতিকেজি ছোলা নভেম্বরে ৮৫ টাকা বিক্রি হলেও ডিসেম্বরে ৯০-৯৫ টাকা ও বর্তমান জানুয়ারিতে ১০০ থেকে ১১০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, এভাবেই প্রতিটি পণ্যে দুই মাসের ব্যবধানের ৪০ থেকে ৫০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
পাশেই সুশান্ত ভ্যারাইটি স্টোরের বিক্রয় প্রতিনিধি শ্রীদাম সাহা বলেন, আমরা যারা ব্যবসায়ী তারাও পণ্যর দাম ওঠানামা নিয়ে অস্বস্তিতে থাকি। কারণ পণ্যর দাম বাড়লে ভোক্তারা তাদের সংসারের ব্যয় কাটছাঁট করেন। এ কারণে বেচাকেনাও কমে যায়। আর বেচাকেনা কমে গেলে আমাদের লাভও কম হয়। তিনি বলেন, নভেম্বর মাসে বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬৮ টাকা বিক্রি হলেও তা একমাস পর ডিসেম্বরে ১৭০ টাকা আর এখন জানুয়ারিতে ১৭৩ টাকা বিক্রি হচ্ছে। চাল, আটা-ময়দার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, সামনে রোজায় আরও দাম বাড়লেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এদিকে নিত্যপণ্য জিনিসপত্রের পাশাপাশি মাছ মাংসের দামও বেড়ে গেছে হতাশাজনক ভাবে। মাত্র এক মাস আগে ৬৫০ টাকা কেজি দরের গরুর মাংস এখন ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি ১৯০-২০০ টাকা, লেয়ার মুরগি ২৮০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আর সোনালী মুরগির প্রতিকেজিতে ২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকা। এছাড়া পেঁয়াজের কেজি ৮৫-৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মূলত চার-পাঁচবার হাত বদলের কারণে দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব কৃষিপণ্য থেকে একদিকে যেমন কৃষক কোনো লাভ পাচ্ছেন না, অন্যদিকে পণ্য কিনে ঠকছেন ভোক্তারা। ক্রেতাদের দাবি সরকারিভাবে বাজার তদারকির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় বাজারদর ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে পড়ছে।
এ বিষয়ে জেলা সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা (বাজার কর্মকর্তা) মো. রবিউল ইসলাম বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে সবসময় আমরা সক্রিয় রয়েছি। ইতোমধ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জেলার বিভিন্ন বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে। যেকারণে এখন চাল-ডাল, তেলসহ অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।