যশোর পৌর হকার্স মার্কেটে জমেনি ব্যবসা, লোকসানে দোকানিরা

0

আকরামুজ্জামান ॥ রাস্তায়-ফুটপাতে পুরনো পোশাক সামগ্রী বিক্রি করে ভালোই সংসার চলতো ষাটোর্ধ আব্দুস সোবহানের। কিন্তু পুনর্বাসনের নামে যশোর পৌর কর্তৃপক্ষ ১ লাখ টাকা নিয়ে ব্যবসার জন্যে ছোট্ট একটি পাকা ঘর নির্মাণ করে দেয় যশোর স্টেডিয়ামের বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের সামনে। বুকভরা আশা নিয়ে তিনি নতুন ঠিকানায় গেছেন বটে। তবে ৬ বছরের মধ্যে আজও পর্যন্ত তিনি সেই পাকা ঘরে ব্যবসা শুরু করতে পারেন নি । বৃদ্ধ বয়সে এখনো শহর ও গ্রামগঞ্জে তাকে ফেরি করে পোশাক বিক্রি করে জীবিন নির্বাহ করতে হচ্ছে।
যশোর শহরের যানজটমুক্ত রাখতে ২০১৭ সালের দিকে শহরের মুজিব সড়ক, দড়াটানা মোড়সহ আশপাশের রাস্তায়-ফুটপাতে পোশাক সামগ্রি ও জুতো-স্যান্ডেল বিক্রিকারী হকারদের উচ্ছেদ করা হয়। এরপর এসব ব্যবসায়ীকে পুনর্বাসনের নামে যশোর শামস-উল-হুদা স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেসিয়ামের পাশে তৈরি করা হয় যশোর পৌর হকার্স মার্কেট।
মোট ১৫০টি ছোট পাকা দোকানঘর নির্মাণ করে পৌর কর্তৃপক্ষ ঘরপ্রতি ১ লাখ টাকা ও মাসিক ভাড়া বাবদ ৩৬০ টাকা চুক্তিতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মাঝে বরাদ্দ দেয়। সেই থেকে মাস প্রতি পৌরসভাকে ৩৬০ টাকা ভাড়া দিয়ে আসলেও দীর্ঘ এই ৬ বছরেও ভাগ্যের চাকা ঘোরেনি এখানকার ব্যবসায়ীদের। এক সময় রাস্তায় ফুটপাথে ব্যবসা করে যাদের সংসার সুখ-শান্তিতে সংসার চলতো তাদের এখন চরম দুর্দিন। আর যারা অন্যের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন তারাও কাঙ্খিত বেচাকেনা করতে না পেয়ে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
রোববার দুপুরে হকার্স মার্কেটে গিয়ে দেখা যায় অধিকাংশ দোকানই বন্ধ রয়েছে। আর যে কয়টি দোকান খোলা আছে সেখানে নেই কোনো ক্রেতা। মার্কেটের পরিত্যক্ত ঘরের অন্ধকার গলিতে বসে আড্ডা দিচ্ছে উঠতি বয়সের যুবক ও স্কুল পলাতক ছাত্ররা।
বাজারে কথা হয় ফজলুর রহমান নামে একজন ক্ষুদ্র পুরাতন কাপড় ব্যবসায়ীর সাথে। তিনি বলেন, কয়েক যুগ ধরে যশোর কালেক্টরেট মার্কেটের আশপাশে রাস্তায় পুরাতন পোশাক বিক্রি করে সংসার চালিয়ে এসেছি। সে সময়ে সংসার ভালোই চলতো। কিন্তু পৌরসভা আমাদের পুনর্বাসনের নামে এখানে ঠিকানা করে দেয়ার পর আর সংসার চলছেনা। ক্রেতাশূন্য বাজারে কোনো কেনাবেচা না থাকায় আমরা মরতে চলেছি। সঞ্চিত সবটুকুও শেষ হতে চলেছে।
থ্রি স্টার ছিট বিতান নামে কাপড়ের দোকানের বিক্রয় প্রতিনিধি আল আমিন বলেন, এই মার্কেটে ১৫০টি দোকানঘর রয়েছে। এরমধ্যে ৮০ টি দোকান ভ্রাম্যমাণ হকার্স ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন হিসেবে বরাদ্দ দেয়া হয়। বাকি ৭০ টি দোকান শহরের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নামে বরাদ্দ হয়। ওই সব ব্যবসায়ীর অনেকেই বাড়তি ভাড়া নির্ধারণ করে দোকান ভাড়া দিয়েছেন। এখন ব্যবসার যে অবস্থা তাতে আমরা ঘরভাড়াও পরিশোধ করতে পারছিনা। অথচ এই সময়ে শহরের কালেক্টরেট মার্কেটসহ আশপাশে মার্কেটে জমজমাট ব্যবসা চলছে।
প্রায় একই কথা বলেন, লাবণ্য ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী রাবেয়া বশরী। তিনি বলেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দোকান খুলে ক্রেতার অপেক্ষায় মুখিয়ে থাকি। মাঝেমধ্যে ক্রেতা আসেন বটে, তবে দাম-দর করেই তারা চলে যান। তিনি বলেন, শহরের অন্যান্য দোকানে যেসব পোশাক বিক্রি হয় তা ঢাকার বঙ্গবাজার থেকে আনা। আমরাও বঙ্গবাজার থেকে মালামাল কিনে দোকানে তুলেছি। দামও অন্যান্য জায়গার চেয়ে কম। তারপরও বাজারটি জমছেনা ক্রেতার অভাবে। তিনি বলেন, শহরের এক সাইডে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে এখানে কোনো ক্রেতা আসতে চাননা।
দোকানিদের কেউ কেউ জানান, এখানে এসে ব্যবসায়ীক মন্দার মুখে অনেকে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার অনেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে মাসিক ভাড়ায় অন্যদের কাছে দোকান ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ এসব বরাদ্দের ঘর ৪/৫ লাখ টাকায় অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছেন। যারা মোটা অংক ব্যয় করে এসব দোকান ঘর কিনেছেন তারা চরম বিপাকে পড়েছেন।
নাম প্রকাশ করতে চাননা এমন এক ব্যবসায়ী বলেন, মার্কেটে এখনো ৬০টিরও বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এসব বন্ধ দোকান ঘরের গলিতে বিভিন্ন বয়সের মাদকসেবীর আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। রাতে বা দিনে সব সময় তারা এসব অলিগলিতে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, কালেক্টরেট ও দড়াটানা এলাকা থেকে আমাদেরকে উচ্ছেদ করে এখানে আনা হয়েছে। কিন্তু সেখানে নতুন কিছু ব্যবসায়ী ব্যবসা করে ফুলেফেঁপে উঠেছে। আর আমরা না খেয়ে মরছি।
এ বিষয়ে যশোর পৌর হকার্স মার্কেট ক্ষুদ্র কাপড় ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান লাভলু বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে মার্কেটটিকে পূর্ণাঙ্গরূপ দিতে আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করে আসছি। কিন্তু যোগাযোগ ব্যববস্থার কিছুটা ঘাটতি থাকার কারণে এখানে ক্রেতারা আসছেন না। তিনি বলেন, মার্কেটটিতে যাতায়াতের জন্যে শহর থেকে পৌর কমিউনিটি সেন্টার হয়ে যাওয়ার জন্যে একটি মাত্র রাস্তা। এর বাইরে পশ্চিম বা দক্ষিণ সাইড দিয়ে এখানে আসার জন্যে তেমন কোনো রাস্তা নেই। যেকারণে এখানে ক্রেতারা আসতে চাননা। তিনি বলেন, পৌর কর্র্তৃপক্ষ একটু আন্তরিক হলে মার্কেটটিকে জমজমাট করা সম্ভব।
এ দিকে পৌরসভার এ হকার্স মাকের্টের বিষয়ে তথ্য আনতে গিয়ে গতকাল রীতিমত গলদঘর্ম হয়ে যেতে হয়। এ বিষয়ে তথ্য নিতে প্রথমে পৌরসভার প্রশাসনিক ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উত্তম কুমার কুন্ডুর কাছে জানতে চাইলে তিনি এই মার্কেটের বিষয়ে কোনো কিছুই জানেন না বলে জানান। একই কথা বলেন পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জায়েদ হোসেন। তিনি বলেন, হকার্স মার্কেটটি বিগত মেয়রের আমলে নির্মাণ হয়েছিলো। ফলে এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই।
পরে সহকারী প্রকৌশলী (পানি) কামাল আহম্মেদের দপ্তরে গিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০১৭ সালে এখানে ১৫০ টি দোকান ঘর নির্মাণ করা হয়। নির্মাণ বাবদ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা করে নেয়া হয় এবং প্রত্যেক দোকান বাবদ ৩৬০ টাকা ভাড়া আদায় করে পৌরসভা। তিনি বলেন, পৌরসভার পক্ষ থেকে মার্কেট করে দেয়া হলেও নির্মাণে পৌরসভার কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি। দোকান মালিকদের দেয়া এক লাখ টাকা দিয়ে দোকানঘর নির্মাণ করা হয়।
এ বিষয়ে যশোর পৌরসভার মেয়র হায়দার গনি খান পলাশের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।