চৌগাছার কুঠিপাড়ার দেবদারু গাছ এখন আর সৌন্দর্য ছড়ায় না

0

মুকুরুল ইসলাম মিন্টু, চৌগাছা (যশোর) ॥ যশোরের চৌগাছার শশ বিঘার দেবদারু বাগান বিলুপ্তির পথে। পৌর এলাকার ঐতিহ্যবাহী কুঠিপাড়া, তারিনিবাস ও কংশারীপুর মহল্লার বেশির ভাগ এলাকা জুড়েই ছিলো দেবদারু বাগান। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও গাছ মেরে বসতি গড়ে উঠায় হারিয়ে যাচ্ছে অপরুপ সৌন্দর্যের বাহক দেবদারু গাছ। প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া ও আপন গতিতে বেড়ে ওঠা এই গাছ সংরক্ষণের দাবি এলাকাবাসীর।
উপজেলা সদরকে অঘোষিতভাবে দু’ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে মহাকবি মাইকেল মধুসূদনের কপোতাক্ষ নদ। এক সময়ের খরস্রোতা কপোতাক্ষের দুই পাড়ে বর্তমান পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের তারিনিবাস, কংশারীপুর ও ৮নং ওয়ার্ডের ঐতিহ্যবাহী নীলকুঠি এলাকায় যুগ যুগ ধরে জন্ম নিচ্ছে দেবদারু গাছ। বিশাল আকৃতির গাছগুলো এলাকার সৌন্দর্যকে আরও বিকশিত করেছে। কিন্তু প্রায় দুই দশক ধরে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে দেবদারু গাছ।
বৃহস্পতিবার দুপুরে কুঠিপাড়া মহল্লায় কপোতাক্ষ নদের পাড়ে যেতে সড়কের দুই পাশে এখনও অসংখ্য ছোট বড় গাছ চোখে পড়ে। কোন ধরনের যতœ নেয়া হয়না, দেয়া হয়না সার-কীটনাশক। প্রতিটি চারা প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে উঠেছে। তবে বড় আকৃতির গাছ এখন আর তেমন দেখা যায়না।
চলতি পথে কথা হয় কুঠিপাড়া মহল্লার বাসিন্দা মৃত কাঠু বিশ্বাসের ছেলে নুর ইসলামের (৭২) সাথে। তিনি বলেন, দেবদারু গাছ অন্য গাছের মত রোপণ করা লাগে না। একটি গাছ হলে সেই গাছের ফল নিচে পড়লে ফল থেকেই চারা বের হয়। এবং সেই চারা নিজে নিজেই বেড়ে উঠে। তবে কেউ যদি ফল বা চারা নিয়ে অন্যত্র লাগায় তাহলে সেই গাছ বড় হয়না। এমনকি মারা যায়। আমি ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি নদের পাড় দিয়ে বিঘার পর বিঘা জমিতে এই বাগান। ছিলো বিশাল আকৃতির গাছ ।কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে অনেকে গাছ মেরে দিয়েছে।
আবুল খায়ের (৭০) জানান, বৃটিশ শাসনামলে কুঠিপাড়ার দেবদারু বাগানের মধ্যে বৃটিশরা একটি ভবন নির্মাণ করেন যা আজও ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। পাশাপাশি এখানে গুড় উৎপাদনের জন্যে বেশ কয়েকটি চুল্লি নির্মাণ করেন তারা। এখানে বসেই তারা এ অঞ্চলের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। আব্বা- চাচাদের মুখে শুনেছি সে সময়ে ঘন দেবদারু বাগান আর বৃটিশদের অবস্থানের কারণে মানুষ সচারচর ওই এলাকাতে যেতেন না। দেশ স্বাধীনের পরও ছিলো ঘন বন আর বড়বড় গাছ। এখন কিছুই নেই বললেই চলে। মৃত নজরুল ইসলামের স্ত্রী রমুসা বেগম (৭৫), মৃত তরিকুল ইসলামের স্ত্রী মাসুরা খাতুন বলেন, আমরা যখন গৃহবধূ হয়ে কুঠিপাড়ায় এসেছি তখনও দেখেছি দেবদারুর বিশাল বাগান। বাগান এতটাই ঘন ছিলো যে, বিকেল হলে প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাগান এলাকায় যেত না। বাগানে বসবাস করত শিয়াল, বেজি, গুইসাপসহ নানা ধরনের প্রাণী। এখন তো গাছ কেটে সব জায়গায় বসতি গড়ে উঠেছে। সে কারণে বড় গাছ এমনকি কোন বন্যপ্রাণী চোখে পড়েনা।
হুদা চৌগাছার মোবারক হোসেন (৭২) জানান, ঘন অরণ্যের মধ্যে বৃটিশরা বসবাস শুরু করেন। তাদের বিদায়ের পর ধীরে ধীরে বাগান উজাড় শুরু হয়।
৮নং ওয়ার্ডের পৌর কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র, কুঠিপাড়ার বাসিন্দা মো. শাহীন বলেন, আমরা তো এই প্রজন্মের মানুষ। ছোট বেলায় দেখেছি সারাদিন কপোতাক্ষে হরেক রকমের পাখি চরে বেড়াত। সন্ধ্যা হলে তারা সব এই দাবদারু গাছে এসে বসত। পাখির কিচিরমিচির শব্দে এলাকা মুখরিত থাকত। এখন গাছ কমে গেছে, নদে পানি থাকে না। তাই পাখিও দেখা যায়না।
পৌরমেয়র নুর উদ্দিন আল মামুন হিমেল বলেন, বৃটিশদের হাতে গড়া নীলকুঠি ও দেবদারু বাগানের কারণে কুঠিপাড়া মহল্লা পরিচিত। প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ বাগান উজাড় করছে। তবে গাছকে বাঁচিয়ে রেখে সকলের কাজ করা উচিত। গাছ যে শুধু সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এমনটি না, গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়। তাই নির্বিচারে গাছ না কেটে গাছকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।