চুয়াডাঙ্গার মিশন পল্লীর বাসিন্দাদের পাটের তৈরি পণ্য বিদেশে যাচ্ছে

0

রিফাত রহমান,চুুয়াডাঙ্গা॥ পাটজাত সামগ্রী তৈরি করে ১৯৭৬ সাল থেকে স্বাবলম্বী চুুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা খ্রিস্টান মিশন পল্লীর নারী-পুরুষ। এখানকার তৈরি পণ্য যাচ্ছে বিদেশে। প্রতিদিন কাজের অবসরে এ পল্লীর বাসিন্দারা চাহিদা মত পাটের সামগ্রী তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা দিনের অবসরের পুরোটাই ব্যয় করছেন এ কাজে।
কার্পাসডাঙ্গা খ্রিস্টান মিশন পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, ড্যানিয়েল মন্ডল মন্টুর স্ত্রী মহিলা সমিতির সম্পাদিকা বুলবুলি মন্ডল (৭০) তার বাড়ির সরু বারান্দায় বসে কার্পেটের অংশ বিশেষ তৈরি করছেন। ৪৭ বছর এ কাজে যুক্ত রয়েছেন তিনি। ২৫০ টাকা মণ দরে যে পাট তিনি আগে কিনেছিলেন তা এখন ৪ হাজার টাকা মণ দরে কিনতে হচ্ছে। কিন্তু থেমে নেই তার কাজ। চাহিদা মত সামগ্রী বানিয়েই চলেছেন তিনি। অবসর সময় অন্য কাজে ব্যয় করতে তিনি নারাজ। পাশের বাড়ির সৌম মন্ডলও (৬৭) একই সময় ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন এ কাজ। গ্রাহকের চাহিদা মত তাদের পণ্য বানিয়ে দিতে কাজ করছেন তারা।
বুলবুলি মন্ডল ও সীরা মন্ডল জানালেন, ৩০০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৮০ সেন্টিমিটার চওড়া, ২০০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৮০ সেন্টিমিটার চওড়া, ৫২০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ২৯০ সেন্টিমিটার চওড়া কার্পেটসহ চাহিদা মোতাবেক পাট দিয়ে তৈরি করা হয় টেবিলম্যাট, ঘরের আড়াই টাঙ্গানো শিকা ও তার ভেতরকার বাক্স, পাখি, মাছ, মেয়েদের ব্যবহৃত হাত ব্যাগ, বালতি, ফুলদানি,জায়নামাজ প্রভৃতি। পাট দিয়ে তৈরি একটি কার্পেট ও ম্যাটের টুকরো জুড়ে পরিপূর্ণরূপ আনা লাগে। কর্মীদের দিয়ে ওই অংশগুলো তৈরি করে নেয়া হয়। সে অনুযায়ী তাদের টাকা পরিশোধ করা হয়। ১২ সেন্টিমিটার লম্বা ও চওড়া ৬ সেন্টিমিটার কার্পেট তৈরি করতে মজুরি পড়ে ৭৭ টাকা, ছোট ৪ কোনা তৈরি করা হয় প্রতি টুকরা ২৭ টাকা মজুরি দিয়ে , ৩ কোনা তৈরি করা হয় প্রতিটি ৭৬ টাকা মজুরিতে, পাঁচ ও ছয় কোনা কোনা তৈরি করা হয় প্রতিটি ৬২ টাকা মজুরিতে ও শেষের অংশ ২টি সেলাই করা হয় ৪০০ টাকা মজুরি দিয়ে। তারপর রঙ করে গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করা হয়। কর্মীরা এই অংশগুলো যে যত তৈরি করতে পারবেন তিনি তত টাকা রোজগার করতে পারবেন। কাজের অবসরে এ কাজ করে একজন কর্মী প্রতি মাসে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা রোজগার করতে পারছেন।
ওই পল্লীর কর্মী চাইনা মন্ডল জানান, আমরা একেকজন একেকটি কাজ করি। আমরা আমাদের মিশন থেকে চাহিদা মত পাট কিনে আনি। ওই পাট ভালভাবে প্রস্তুত করে পাটের কাজ করতে হয়। ৮ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে কাজের অংশ জমা দিই। জমা দেয়ার পর পারিশ্রমিকের অংশ থেকে পাটের টাকা কেটে নিয়ে মজুরি দেয়া হয়। তাতে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা রোজগার করা যায়।
কর্মী সীরা মন্ডল বলেন, ১৯৭৪ সালে বিয়ের পর তারা আলাদা হয়ে যান। শ্বশুরকুল থেকে কোন সহযোগিতা পাননি। তার স্বামী শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। তাতে সংসারের টানাটানির শেষ ছিলনা। সেই টানাটানি কাটিয়ে উঠতেই তিনি পাট দিয়ে তৈরি হস্তশিল্পের কাজ শুরু করেন। এই কাজ করে তিনি তার দু’ছেলে মেয়েকে ভাল জায়গায় নিয়ে গেছেন। মেয়ে নাসিংয়ে পড়াশুনা শেষ করে সরকারি চাকরি করছেন। ছেলে ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। তিনি আরো বলেন, আমি বর্তমানে স্বাবলম্বী। কিন্তু এ কাজ ছাড়িনি। তিনি বলেন, এ কাজে ছেলের স্ত্রীকে তিনি যুক্ত করেছেন। হস্তশিল্পের এ কাজ করে তিনি প্রায় ৪ মাস পর পর ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় করেন।
কর্মী স্বপ্না মন্ডল বলেন, বছর দুয়েক হলো তিনি এ কাজে শুরু করেছেন। প্রথমে কষ্ট মনে হলেও এখন ভালই লাগে।
খ্রিস্টন মিশন পল্লীর বুলবুুলি জানান, ১৯৭৬ সাল থেকে মেহেরপুুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার খ্রিস্টান মিশনারির মাধ্যমে এ কাজগুলো করানো হয়। এর আগে ইটালি থেকে কার্পাসডাঙ্গায় ধর্ম প্রচার করতে আসেন ফাদার জন। তিনিই তাদের এ কাজে সম্পৃক্ত করেন। সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হলেও এ কাজ থেমে যায়নি। এ কাজের প্রয়োজনীয় শুকনো পাট ফরিদপুর ও গোপলগঞ্জ জেলার মকসুদপুর উপজেলার বানিয়ারচর ও খুলনা থেকে সংগ্রহ করা হয়।
কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল করিম বিশ্বাস বলেন, দেশের জাতীয় সম্পদ পাট। পাট দিয়ে ১৯৭৬ সাল থেকে কার্পাসডাঙ্গা মিশন পল্লীর যে পণ্য তৈরি হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে তা প্রশংসার দাবিদার। সরকারিভাবে এ কাজের সহায়তা না থাকার কারণে এর বিকাশ ঘটছেনা।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোকসানা মিতা বলেন, কার্পাসডাঙ্গা মিশন পল্লীতে বিশেষ করে মেয়েরা পাটজাত দ্রব্য ব্যবহার করে যে পণ্য তৈরি করছেন তা প্রশংসনীয়। এ পর্যন্ত এ হস্তশিল্পের সম্প্রসারণ ও বিকাশ ঘটানোর জন্যে তারা কোন সরকারি সাহায্য সহযোগিতা চাননি। তারা যদি সহায়তা চান তবে তা অবশ্যই করা হবে।