যশোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে চিরবিদায় সুকুমার দাসের

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যশোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রাণকেন্দ্র টাউন হল মাঠ থেকেই সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চিরবিদায় নিলেন জেলার সংস্কৃতি কর্মকান্ডের প্রাণপুরুষ সুকুমার দাস। এখান থেকে তাকে নিয়ে নীলগঞ্জ মহাশ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়।
শেষ শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজনে ছিলেন স্থানীয় সরকার ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য, আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা। ছিলেন যশোর শহর ও বিভিন্ন উপজেলার সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের নেতা-কর্মীসহ জেলা ও পুলিশ প্রশাসন, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠন।
এ সময় স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ বলেন, সাংস্কৃতিক সংগ্রামী সুকুমার দাস জীবনের সিংহভাগ সংগ্রাম করেছেন সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তচিন্তার পক্ষে। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ও সম্পন্ন একজন মানুষ। পুনশ্চ যশোরের প্রতিষ্ঠাতা সুকুমার দাস গত বুধবার রাতে হৃদ রোগে আক্রান্ত হন। এরপর যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে আইসিইউতে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল)  সকালে তার মরদেহ প্রথম নেওয়া হয় তার প্রতিষ্ঠিত পুনশ্চ যশোর প্রাঙ্গনে। এরপর সকাল ১০টায় সুকুমার দাসের মরদেহ টাউন হল ময়দানে এনে রওশন আলী মঞ্চে রাখা হয়। শোকাবহ পরিবেশে সেখানে প্রথিতযশা এ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ সময় শোকাহত হয়ে ওঠেন তার সতীর্থ, সহকর্মী ও বন্ধুরা। কাঁদতে দেখা যায় অনেককে। শতাধিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান তাদের প্রিয় ব্যক্তিত্বকে অন্তিম শ্রদ্ধা জানান।
শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, স্থানীয় সরকার ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য, যশোরের জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান, পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার, যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আহসান হাবীব, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগ,

বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক নার্গিস বেগমসহ নেতৃবৃন্দ, জেলা জাসদ, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ মার্কসবাদী, বৃহত্তর যশোর ছাত্র ইউনিয়ন, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ, যশোর শহর ও পৌর আওয়ামী লীগ, যশোর শিল্পকলা একাডেমি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, প্রেস ক্লাব যশোর, যশোর সাংবাদিক ইউনিয়ন, দৈনিক লোকসমাজ, দৈনিক গ্রামের কাগজ, দৈনিক স্পন্দন, দৈনিক রানার, ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, যশোর ইনসটিটিউট, উদীচী যশোর, সুরবিতান যশোর, কিংশুক যশোর, বিবর্তন যশোর, যশোর সাহিত্য পরিষদ, তির্যক যশোর, স্পন্দন যশোর, চারুতীর্থ, নৃত্যবিতান, নন্দন যশোর, বাউলিয়া সংঘ, প্রথম আলো বন্ধু সভা, সনাক-টিআইবি যশোর, সরকারি এমএম কলেজ, জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, বাঘারপাড়া কলেজ, জয়তী সোসাইটি, নান্নু চৌধুরী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট, শেকড় যশোর, দ্যোতনা সাহিত্য পরিষদ, উপশহর কলেজ, শিশু একাডেমি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ঝিকরগাছা, প্রত্যয় থিয়েটার, মা নৃত্যালয়, ব্যঞ্জন যশোর, থিয়েটার ক্যানভাস, জনউদ্যোগ, আব্দুর রাজ্জাক কলেজ, সম্মিলন স্কুল প্রাক্তন ছাত্র পরিষদ, নাসিব, হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন, চারুপল্লী শিক্ষালয়, আরআরএফ, সিটি ক্যাবল, মহিলা পরিষদ, উৎকর্ষ যশোর, সদর উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদ, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যশোর, পুলিশ লাইন স্কুল, সপ্তর্ষী অভয়নগর, বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি, যশোর শাড়ি কাপড় ব্যবসায়ী সমিতি যশোর বাজার শাখা, যশোর জিলা স্কুলসহ আরও বেশ কয়েকটি সংগঠন।
সুকুমার দাস গত ৫ এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসকরা তাকে খুলনায় স্থানান্তর করেন। খুলনা সিটি হাসপাতালে তার হার্টে একটা রিং পরানো হয়। ৯ এপ্রিল যশোরে ফিরে আসেন তিনি। ওইদিনই আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে সন্ধ্যায় আবার যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা নেওয়া হয়। এরপর সুস্থ হওয়ায় ১১ এপ্রিল দুপুরে তাকে বাড়িতে নেওয়া হয়। ১২ এপ্রিল রাত ৯টার দিকে বাড়ি খাট থেকে পড়ে তিনি গুরুতর অসুস্থ হন। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সুকুমার দাস ১৯৭৩ সালে যশোর উদীচীর সাথে যুক্ত হন এবং ২০১১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত একাধিকবার এ সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১১ সালের শেষ দিকে তিনি গড়ে তোলেন আরেক সাংস্কৃতিক সংগঠন পুনশ্চ। সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। যশোরে জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলনী পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, পদ্ধতিগত সঙ্গীত শিক্ষার বেসরকারি সঙ্গীত শিক্ষা বোর্ড ধ্রুব পরিষদ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোরে দীর্ঘ ২৮ বছর তিনি মূল দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে কেন্দ্রীয় জোটের সদস্যসহ যশোরেরর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। এছাড়া বর্তমানে টিআইবি যশোর সনাকের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন একইসাথে যশোর শিল্পকলা একাডেমির সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।
তার সুরকরা গান ‘আয় আয় দিন বদলের প্রত্যয়’ গানটি যশোর জেলা প্রশাসনের ওয়েলকাম টিউন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তারই সুর করা আরেকটি গান ‘আরশীর সামনে একা একা দাঁড়িয়ে’ আজ উদীচীর সংগঠন সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তার সুর করা মাইকেল মধুসূদন দত্তের রচিত ব্রজাঙ্গনা কাব্য সনেট ও নাটকের অসংখ্য গান বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একাধিকবার পরিবেশিত হয়েছে ও হচ্ছে । তিনি অসংখ্য দেশের গান, গণসঙ্গীত, ছড়া গান ও আধুনিক গানের সুর করেছেন। গণসঙ্গীতের প্রশিক্ষক হিসেবে তিনি ঢাকা, খুলনা, রাজশাহীসহ সারাদেশে কাজ করেছেন। পেশায় কলেজ শিক্ষক সুকুমার দাস ১৯৮৪ সালে যশোরের বাঘারপাড়া ডিগ্রি কলেজে অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন। ২০১৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তিনি শিক্ষকতা থেকে অবসর নেন।
এদিকে সুকুমার দাসের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ প্রকাশ করেছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বিবদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন।
এক শোক বার্তায় অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, অধ্যাপক সুকুমার দাস সকলের শ্রদ্ধেয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যবিপ্রবির উপাচার্য হিসেবে তার সঙ্গে আমি কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। যশোরের মানুষের কাছে তিনি অত্যন্ত সজ্জন মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে পরিচিত যশোরকে নিজের স্বীয় গুণাবলী দিয়ে আরও সমৃদ্ধ করেছেন, সেবা দিয়ে গেছেন। তার মৃত্যুতে যশোরবাসী একজন অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তমনা মানুষকে হারালো। আমি তার মৃত্যুতে যবিপ্রবির শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। একইসঙ্গে তার পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক সহকর্মীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।