খানজাহান আলী (রহ.)’র বসতভিটা খননে মিললো ঐতিহ্যের নিদর্শন

0

 

বাগেরহাট সংবাদদাতা॥ ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত স্থাপনা বিখ্যাত ইসলাম প্রচারক খানজাহান আলী (রহ)’র বসতভিটা খননে পাওয়া প্রত্নতত্ত্ব প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার দিনব্যাপী বাগেরহাট সদর উপজেলার ষাটগম্বুজ ইউনিয়নের সুন্দরঘোনা গ্রামে বসতভিটার ডিবিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আয়োজনে এই প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
সকালে প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান। এ সময় বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবাইয়া তাসনিম, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন, সহকারী পরিচালক গোলাম ফেরদৌস, ষাটগম্বুজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আখতারুজ্জামান বাচ্চু, বাগেরহাট জাদুঘরের কাস্টডিয়ান মোহাম্মাদ যায়েদ, আল আমীন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ফিল্ড অফিসার মোসা. আইরীন পারভীন, হাসানুজ্জামানসহ স্থানীয়রা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে প্রত্নতত্ত্ব বস্তু প্রদর্শনী খবরে স্থানীয় বাসিন্দা ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা খানজাহান আলী (রহ)’র বসতভিটায় ভিড় জমান। খননে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় বাগমাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মৌসুমি আক্তার বলে, খানজাহান আলী (রহ) ও ষাটগম্বুজ মসজিদের বিষয়ে বইতে পড়েছি। আজ এখানে এসে নিজের চোখে বসতভিটা দেখলাম। বসতভিটা খননে প্রাপ্ত খানজাহান আমলের বিভিন্ন তৈজসপত্র, পাথর ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য দেখে আমাদের খুব ভাল লাগছে।
ষাটগম্বুজ খানজাহানিয়া-জব্বারিয়া আদর্শ আলিম মাদরাসার সহকারী শিক্ষক ওজায়ের সরকার বলেন, প্রত্নতত্ত্ব বস্তুর প্রদর্শনীর জন্যে শিক্ষার্থীদের নিয়ে এখানে এসেছি। অনেক পুরোনো পণ্য দেখলাম। খানজাহানের এই বসতভিটার সাথে বাগেরহাট জেলা প্রতিষ্ঠার অনেক ইতিহাস জড়িত রয়েছে। বাগেরহাটকে জানতে হলে খানজাহানকে জানার আহবান জানান এই শিক্ষক।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলি ইয়াসমিন বলেন, ‘খান জাহানের বসতভিটা হিসেবে সংরক্ষিত এই প্রত্নতত্ত্ব স্থলটি বেশ কয়েকবার খনন করা হয়েছে। এবারের খননে প্রাচীন দেয়াল, মেঝে, পয়ঃনিষ্কাশন প্রণালির নালা, পোড়ামাটির তৈরি পাইপসহ বিভিন্ন স্থাপত্য নিদর্শন প্রদীপদানি, পোড়ামাটির পুঁতি, লাল, কালো ও ধূসর বর্ণের মৃৎমাত্র, প্লেট, গ্লাস, পিরিচ, নল, জালের গুটি, টাইলস, অলংকৃত ইটসহ বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ব বস্ত পাওয়া গেছে। এই প্রদর্শনী শেষে প্রত্নতত্ত্ব বস্তুগুলো বাগেরহাট যাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে। পরবর্তীতে এই গবেষণাপত্র প্রকাশেরও ইচ্ছে পোষণ করেন বিভাগীয় এই কর্মকর্তা।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, পৃথিবীর প্রাচীন শহরের মধ্যে খলিফাতাবাদ অন্যতম। যা কালের বিবর্তনে বাগেরহাট নাম ধারণ করেছে। বাগেরহাটের ইতিহাস, ঐহিত্য অনেক প্রাচীন ও সম্মৃদ্ধ। প্রত্মসম্পদে ভরপুর এই জেলা। এই জেলাকে পর্যটকদের জন্যে আরও বেশি আকর্ষণীয় করতে প্রত্মসম্পদ বিষয়ে গবেষণা বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্যে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানান জেলার এই শীর্ষ কর্মকর্তা।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জানায়, ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি খানজাহান আলী (রহ)’র বসতভিটা খনন শুরু হয়। এই খনন কাজে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের ১০জন কর্মকর্তা-কর্মচারী অংশগ্রহণ করেন। এদের পাশাপশি খনন কাজে দক্ষ শ্রমিকরাও অংশ নেন। ৪০ দিনের এই খননে বিভিন্ন ইমারতে দেয়াল ও সংযোগ দেয়াল, পাকা মেঝে, প্রাচীন রাস্তার ধ্বংসাবশেষ, ইটের নির্মিত পাকা ড্রেন, বিভিন্ন যুগের ইটের সলিং, তৈল প্রদীপ, আয়রন নেইল, টাইলস, টেরোকোটা সম্মৃদ্ধ পাত্র, মাটির তৈরি স্প্রিং কলার, মাটির তৈরি পানি নির্গমন নল পাওয়া গেছে। খননে প্রাপ্ত এসব প্রত্নতত্ত্ব পরবর্তীতে যাদুঘরে রাখা হবে বলে জানিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলি ইয়াসমিন।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৮৫ সালে খানজাহান আলী (রহ)-র নির্মিত ষাটগম্বুজ মসজিদসহ ১৭টি স্থাপনাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে। এর মধ্যে বাগেরহাট সদর উপজেলার সুন্দরঘোনা এলাকায় অবস্থিত খানজাহান আলী (রহ)-র বসতভিটা অন্যতম। ষাটগম্বুজ মসজিদ থেকে মাত্র ৩০০ মিটার উত্তরে এই বসতভিটাটি রয়েছে। ২০০১ সালে এখানে প্রথমবার প্রত্নতত্ত্বিক খনন পরিচালনা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এরপর ২০০৮ থেকে এ পর্যন্ত মোট ১২ বারের খননে ঢিবিটিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন পাওয়া গেছে। যার মধ্যে সাড়ে ৬০০ বছর আগের উলুঘ খান জাহান (হজরত খানজাহান আলী (রহ.) আমলের নানান স্থাপনা ও ইট বিছানো সড়ক ছাড়াও আগে ও পরের বিভিন্ন যুগের স্থাপনা এবং বসতির নিদর্শন রয়েছে। খান জাহানের বসতভিটা ছাড়াও স্থানটি মধ্যযুগের অন্যতম টাকশাল নগরী খলিফাতাবাদ শহরের অংশ হিসেবে পরিচিত।