বৃষ্টিহীনতার রেকর্ড

0

 

তহীদ মনি॥ বিগত বর্ষাকালের অর্ধেকও বৃষ্টিও হয়নি এ মৌসুমে। ভয়াবহ বৃষ্টিহীনতায় প্রকৃতি হচ্ছে রুক্ষ্ম, পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। ধান উৎপাদনের ওপর ইতোমধ্যে প্রভাব পড়েছে। গ্রামাঞ্চলের পুকর, মাঠে-ময়দানে, ডোবা-নালা, খাল-বিল সব কিছুই পানিশূন্য অবস্থায় রয়েছে। এ অবস্থাকে যশোরসহ আশেপাশের এলাকার জন্য ভয়াবহ অশনি সংকেত বলে মনে করছেন সব শ্রেণির মানুষ।
যশোরের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য মতে জুন থেকে আগস্ট এই ৩ মাস পুরো বৃষ্টির মৌসুম। চলতি বর্ষা মৌসুমে ভাদ্র মাসের এ পর্যন্ত যশোরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ৪১৯ মিলিমিটার। ২০২১ সালে তা ছিল ৮২৮ দশমিক ৭০ মিলিমিটার এবং ২০২০ সালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম থাকলেও বর্ষা মৌসুমের প্রথম ৩ মাসে মোট বৃষ্টিপাত ছিল ৬১২ দশমিক ৭৭ মিলিমিটার। চলতি বছর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে আগস্ট মাসে; যার পরিমাণ প্রায় ১৫৬ মিলিমিটিার। তবে ২০২০ সালে একই সময় ২৪৩ দশমিক ২৮ মিলিমিটার এবং ২০২১ সালে এই সময়ের বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ২২২ দশমিক ৩৫ মিলিমিটার। ২০২১ সালের জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছিল, যার পরিমাণ ছিল ৩২১ মিলিমিটার, সেখানে চলতি বছর জুলাই মাসে বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ১৪৫ দশমিক ২৫ মিলিমিটার। গত বছর জুন মাসে ২৮৫ দশমিক ৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও এ বছর মাত্র ১১৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
যশোর ছাড়াও মাগুরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল অঞ্চলের বিস্তীর্ণ মাঠ পাট জাগ দেওয়ার অভাবে শুকিয়ে যেতে দেখা গেছে। কোথাও একটু পানি পেলে চাষিরা ভাগাভাগি বা পর্যায়ক্রমে পাট জাগ দিয়েছেন বলে জানান। অনেক স্থানে স্যালোমেশিনে পানি তুলে ডোবা ভরাট করে পাট জাগ দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
চাষিরা জানান, এতে পাটের উৎপাদন, আশের মান যথাযথ হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে পাট চাষ নিয়ে সন্ধিহান তারা।
সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে আমান ধান উৎপাদনে। মৌসুমের শুরুতে পানির অভাবে চাষিরা বীজতলা তৈরি করতে পারেনি। অনেকেই ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাধ্যমে বীজতলা করলেও পরে আবারও পানি অভাবে সেই চারা লাল হয়ে মারা গেছে। এরপরও বৃষ্টি অভাবে সময় মতো ধান রোপণ করতে পারেননি।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছিল মধ্য শ্রাবণেও যশোরের ১ লাখ প্রাং ৩৯ হাজার হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্য থাকলেও সে পর্যন্ত চাষ সম্পন্ন হয়েছিল মাত্র ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে। কৃষিবিভাগের সময় অনুয়ায়ী ১৫ আগস্ট চাষ সম্পন্নের লক্ষ্য থাকলেও বিপুল পরিমাণ জমি চাষের অপেক্ষায় ছিল সেই ১৫ আগস্ট পর্যন্ত। অবশ্য হাজার হাজার কৃষক বাধ্য হয়েই স্যালোমেশিন ও গভীর নলকুপের মাধ্যমে পানি তুলে আমন চাষ করেছেন বলে চাষিরা জানান।
যশোরের কৃষি সেচ বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আষাঢ়-শ্রাবণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর সাধারণত ২-৩ ফুটের মধ্যেই থাকে, অথচ এবার শ্রাবণের মাঝামাঝি সেই পানির স্তর প্রায় ২৩ ফুটে নেমে আসে। যশোর সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার অন্তত ১২-১৪ জন কৃষকের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, এই পানির স্তর নেমে যাওয়া মানেই সাধারণ টিউবওয়েলে পানি উঠবে না, মাটির জো থাকবে না, ফসল ফলবে না, শুষ্কতার কারণে গাছপালার ওপরতো বটেই প্রাণীকূলের ওপর বিরূপ প্রভাব বয়ে আনবে। সুজলা-সুফলা ভূমি ধীরে ধীরে মরুময়তার দিকে রূপ নেবে।
মানুষের মধ্যে।
পরিবেশবাদী শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আমিরুল আলম খান বলেন,শুধু যশোর বা বাংলাদেশ নয় জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব পড়েছে সারা বিশ্বে। কোথাও কোথাও অতিবৃষ্টি- কোথাও অনাবৃষ্টি। সমুদ্রের পানির স্তর উঁচু হচ্ছে, বরফ গলছে মেরু অঞ্চলে, ঋতু তার স্বভাবিক রীতি পরিবর্তন করছে। সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ পরিবর্তন ও পরিণতির দিকে এই পরিবেশ ও জলবায়ুূ। এ অবস্থায় আমাদের কৃষি পদ্ধতির পরিবর্তনের সময় এসে যাচ্ছে।
চাষি, সাধারণ মানুষ ও পরিবেশবাদীদের মতো যশোরের কৃষিবিভাগকেও এই কম বৃষ্টিপাতের বিষয় ভাবিয়ে তুলেছে। যশোর বরাবরই কৃষি উদ্বৃত্ত অঞ্চল। সবজিতেও দেশ সেরা, মৎস্য চাষ ও উৎপাদনেও দেশ সেরা অঞ্চল। বৃষ্টি যথেষ্ট না হওয়ায় সব কিছু ক্ষতিগ্রস্ত এবং বিপর্যস্ত হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হকের মতে, এবার বৃষ্টি কম হওয়ায় তারা চিন্তিত, তবে আশা হারাননি। জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে সাথে সাথে কৃষিবিভাগও সাধ্যমতো সব দিক খতিয়ে দেখে পরিবর্তনশীল সময়ে নতুন জাত ও ফসলের চিন্তা করছে।
যশোরে গত সপ্তাহে যশোর-ফরিদপুর অঞ্চলেল ১১ জেলার সকল পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা-কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কৃষিভাগ এক কর্মশালা আয়োজন করে। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এতে প্রধান অতিথি ছিলেন। সেখানেও মন্ত্রীসহ কৃষি কর্মকর্তা ও চাষি পর্যায়ে এবছর বৃষ্টিহীনতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। কৃষি মন্ত্রী নিজেও সেখানে কৃষি বিজ্ঞানীদের এই পরিবেশে ধান-তেলবীজ কেমন হবে বা কীভাবে এই অবস্থা মোকাবেলা করা যায় সে বিষয়ে উদ্ভাবনের ও গবেষণার পরামর্শ দেন।