সেনা সমর্থন হারানো ইমরান খানের বিদায় ঘণ্টা!

0

মোস্তফা হোসেইন॥ পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে বলে দিয়েছে, ওআইসি সম্মেলনের পর আপনি ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। এদিকে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের জন্য স্পিকার সংসদের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করেছেন ২৫ মার্চ। সংসদ সদস্যদের আস্থা অর্জন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার তেমন সম্ভাবনা নেই ইমরান খানের সামনে। কারণ তার দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেনি। অন্যদিকে তার দলের ভিতরেও বিদ্রোহের আলামত স্পষ্ট। বলার অপেক্ষা রাখে না সেনাবাহিনীর ছায়াচ্যুত হয়ে গেছে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। শুধু জেনারেল বাজওয়া নয় সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আঞ্জুমসহ চার সামরিক কর্মকর্তা ইমরান খানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ইমরান খানকে টিকিয়ে রাখার কোনো পথই আর খোলা নেই। তার মানে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ এতদিন যে চেষ্টা করে আসছিল সবই ভেস্তে গেলো। তারা মনে করেছিলে সাবেক সেনাপ্রধান রাহিল শরিফ বাজওয়াকে হয়তো আস্থায় আনতে পারবেন। কিন্তু চার সেনা কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত প্রকাশ হওয়ার পর প্রতীয়মান হচ্ছে- ইমরান খানের সামনে আত্মরক্ষার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। সেনাবাহিনী মনে করেছে, ওআইসি সম্মেলন বিঘ্নিত হলে তাদেরও সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে, তাই এটুকু সময় তাকে দেওয়া যায়। অর্থাৎ এই মার্চ মাসই হচ্ছে ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষ মাস। আর পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তার রাজনৈতিক জীবনেরও ইতি ঘটবে কি না তাও বলা যাচ্ছে না।
সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করার মাধ্যমে ইমরান খান চেষ্টা করেছেন তাদের সুনজরে আসার জন্য। বাস্তবতা হচ্ছে সেনা কর্মকর্তারা আগেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে রেখেছেন এমনটা মনে করা যায় তাদের বক্তব্য থেকে। আগেও যেমন কোনো একটা ইস্যুকে সামনে এনে নির্বাচিত সরকার প্রধানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে, এবারও যে তার ব্যতিক্রম হয়নি তা বলা যায়। যেমনি আগে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সুশাসনের অভাব তথা দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক ব্যর্থতার অভিযোগ এনে এবারও পাকিস্তানের সেনানায়কেরা একই কথা বলছেন। আর সেই ব্যর্থতার দায় নিয়ে ইমরানকে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার স্পষ্ট কথাও তারা বলে দিয়েছেন। এবার দেখার পালা নওয়াজ শরিফদের মতো ভাগ্য যে ইমরান খানের জন্যও অপেক্ষা করছে কি না। বিরোধী দলের ক্ষোভ কি রাজনৈতিক নাকি কারও ইঙ্গিতে পরিচালিত সেই প্রশ্ন না করেও বলা যায়, তারা স্পিকারের কাছে যে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করতে যাচ্ছে, তার পেছনের শক্তিটা খুব একটা দুর্বল নয়। ইমরান খান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আস্থায় আনার চেষ্টা না করে ভেবেছিলেন সামরিক প্রশাসন তার পক্ষে থাকবে, তিনি অনাস্থার লড়াইয়ে উতরে যাবেন। অন্তত তার সাম্প্রতিক চিন্তাভাবনা থেকে এমন আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সেনাবাহিনী তাকেই আক্রে ধরেছে। সেনাবাহিনীর অনাস্থা প্রকাশের পর স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতিফলন ঘটবে সংসদেও। এক্ষেত্রে বলা যায়, ইমরান খানের গদিচ্যুতি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে ২৫ মার্চ আস্থা ভোট গ্রহণ পর্যন্ত তিনি যথেষ্ট অস্বস্তির মধ্যেই কাটাবেন। একই সঙ্গে ওআইসি সম্মেলন অনুষ্ঠান নিয়েও তাকে ভাবতে হচ্ছে। পাকিস্তানের সংসদে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন এবং সেনাবাহিনীর এই ধমক শুধু পাকিস্তানকেন্দ্রিক এমনটা ভাবার কারণ নেই। আসলে দুর্বল রাজনীতির সুবাদে পাকিস্তানে পশ্চিমাদের নাক গলানোর সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, আসলে ইমরান খান মস্কো ভ্রমণের মধ্য দিয়ে নিজের পথে নিজে কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছেন।
জাতিসংঘ যেখানে রাশিয়ার আগ্রাসী নীতিকে নিন্দা জানানোর উদ্যোগ নিয়েছে সেখানে ইমরান খান হেঁটেছেন উল্টোপথে। সেই সুযোগটা নিয়েছে সিআইএ। না হলে তার নিজ দলের এমপিদের অনেকেই তাকে ছেড়ে দিয়ে সরকার পতন নিশ্চিত করতো না। পার্লামেন্টে বিরোধী দলের হাতে পর্যাপ্ত সংখ্যক সদস্য নেই, যাতে করে ইমরান খানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে বিরোধী দল ইমরান খানের দলের কিছু সদস্যের সমর্থন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এমন কাজে বিদেশি শক্তির হাতকে অবশ্যই আমলে আনতে হবে। শুধু তাই নয়, যে সেনাবাহিনীর কাঁধে ভর করে ইমরান খান এতদিন ক্ষমতায় টিকে ছিল সেই সেনাবাহিনীও তাকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করছে এটাও স্বাভাবিক বলে মনে করার কারণ নেই। যদিও পাকিস্তানের রাজনীতিতে জনমতের বিষয়টি মুখ্য নয়, তারপরও বলতে হবে ইমরান খান তার শাসনকালে জনপ্রিয়তাও হারিয়েছেন ব্যাপক। বিশেষ করে অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতি তিনি আরও জটিল করে দিয়েছেন ব্যাপকভাবে সুশাসনের ঘাটতির কারণে। অর্থনৈতিক দুরবস্থা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। তিনি বিষয়টি অনুধাবন করেননি তা নয়। পরিস্থিতি এমন গিয়ে দাঁড়িয়েছে, আজ ইমরান খানকে তার নিজের দল, সংসদে বিরোধী দল, সেনাবাহিনী, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ থেকে শুরু করে তার দেশের জনগণ সবাইকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। চতুর্মুখী বৈরী পরিবেশ ডিঙ্গিয়ে তিনি কতটা সফল হবেন তা দেখার বিষয়। সেনাবাহিনীকে বাগে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, নিজ দলের এমপিএদের ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এমন প্রতিশ্রুতিও তিনি দিয়েছেন, যদি তার দলের বিদ্রোহী এমপিরা ফিরে আসেন তাহলে তিনি সবকিছু ভুলে যাবেন, যেমনি একজন পিতা তার সন্তানদের অপরাধ ভুলে যায়। কিন্তু তার এই আহ্বান যে অসার হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ধারণা করা হচ্ছে, ওআইসি সম্মেলনের মাধ্যমে কৌশলে তিনি আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করবেন। একই সঙ্গে তিনি জনমতের বিষয়টির কথাও ভাবছেন। তিনি ২৮ মার্চ বৃহদাকারের র‌্যালি করার পরিকল্পনা করেছেন। যাতে পাকিস্তানের বিরোধী রাজনীতিবিদরা বুঝতে পারেন পাকিস্তানের জনগণ তার পক্ষে আছে। কিন্তু ২৫ মার্চের অধিবেশনের পর তিনি সেই সুযোগ পাবেন কি না সেটাই ভাবার বিষয়। সবদিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইমরান খান কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছেন, যে পরীক্ষায় নির্ধারণ হবে পাকিস্তানে আরেকজন নওয়াজ শরিফের জন্ম হতে যাচ্ছে।
এমন সময় পাকিস্তানে ঝড় উঠেছে যখন বাঙালি স্মৃতিচারণ করছে একাত্তরের পাকিস্তানকে। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে একাত্তরে বাংলার আকাশ ছেয়ে গিয়েছিল স্বাধীন বাংলার পতাকায়। ২৫ মার্চ মুখোমুখি হয়েছিল গণহত্যার, যা সংঘটিত করেছিল ইমরান খানের চাচা এ এ কে নিয়াজী, পাকিস্তানি সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের তস্কর। ২০২২ সালের ২৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হচ্ছে নিয়াজির ভাতিজার কঠিন পরীক্ষা। যার চূড়ান্ত রূপ দেখা যাবে বাংলাদেশের গণহত্যা দিবসে, পাকিস্তানের পার্লামেন্টে। আস্থা ভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ হবে ইমরান খান আদৌ টিকে থাকবে কি না পাকিস্তানের মসনদে।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।