আচমকা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ সন্দেহ-সংশয়

0

॥ মিজানুর রহমান ॥
অনেকটা নাটকীয়ভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে মিয়ানমার সরকার। ওই পরিকল্পনা মতে, ৭০০ জনের মতো রোহিঙ্গা মুসলিমকে তারা ফিরিয়ে নেবে! তবে ঠিক কবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে চায় মিয়ানমার তা এখনো খোলাসা করা হয়নি। ইয়াংগুনের একটি কূটনৈতিক সূত্র মিয়ানমার সরকারের ওই পরিকল্পনার বিষয়টি মানবজমিন-এর সঙ্গে শেয়ার করেছে। মূল ডকুমেন্টটি বার্মিজ ভাষায় তৈরি, তবে এর একটি আন-অফিসিয়াল ইংরেজি ট্রান্সলেশন আমরা হাতে পেয়েছি। ডকুমেন্ট বলছে, প্রত্যাবাসন নিয়ে গত ক’মাসে সিরিজ বৈঠক হয়েছে নেপি’ড এবং সিত্তুয়েতে। মিয়ানমারের বর্তমান ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী উ কো কো হ্লাইং, পুনর্বাসন বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ড. থেট খাইং, সীমান্ত বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল তুন তুন নাউং রাখাইন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ড. অং কিয়াও মিন এবং তার প্রতিনিধিদের নিয়ে সীমান্ত এলাকায় থাকা প্রত্যাবাসন সংশ্লিষ্ট অফিসগুলো পরিদর্শন করেছেন। তারা মংডু টাউনশিপের বিভিন্ন আইডিপি ক্যাম্পও পরিদর্শন করেন। ওই পরিদর্শনের পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ড. থেট খাইং, রাখাইন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ড. অং কিয়াও মিন এবং অন্য কর্মকর্তারা নেপি’ডতে প্রত্যাবাসন পরিকল্পনার খুঁটিনাটি নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক করেন। গত ৮ই মার্চ রাখাইন রাজ্য পরিষদে ওই পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। ওই আলোচনা শেষে স্থানীয় সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন স্টেট কাউন্সিলের মুখপাত্র হ্লা থেইন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া ৭০০ জনেরও বেশি মুসলিমকে আমরা রাখাইনে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছি। তারা বাংলাদেশে নিবন্ধিত এবং মিয়ানমার সরকারের দ্বারা যাচাইকৃত। ৮ই মার্চ দুপুরে হ্লা থিনের কার্যালয়ে উপস্থিত সাংবাদিকরা প্রত্যাবাসন শুরুর সময়ক্ষণ জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুখপাত্র তা জানাতে অপরারগতা প্রকাশ করেন। বলেন, আমরা এখনো প্রত্যাবাসনের সঠিক সময়টা জানি না।
মিয়ানমারের তরফে বরাবরই বলা হয়, আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাবাসন শুরু না হলেও বাংলাদেশ থেকে না-কি শত শত রোহিঙ্গা রাখাইনে নিজ উদ্যোগে ফিরেছেন। ওই ডকুমেন্টে সেই বিষয়টিরও উল্লেখ রয়েছে। ওই প্রত্যাবাসন উদ্যোগ বা পরিকল্পার বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে কিছুই জানায়নি মিয়ানমার। তবে বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব চ্যানেলে এ বিষয়ে অবহিত- এমনটাই দাবি সেগুনবাগিচার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার। গত বুধবার মানবজমিন-এর জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি বলেন, সংখ্যা বিষয় নয়, পরিবার ভিত্তিক যে লিস্ট আমরা শেয়ার করেছি তা ধরে যদি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হয়, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। তবে মিয়ানমার এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে পরিকল্পনার বিষয়টি আমাদের জানায়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং অনানুষ্ঠানিক আলাপে ঢাকাস্থ মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত এমন আভাস দিয়েছেন জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকের একটি ফর্মেট রয়েছে। ত্রিদেশীয় এমন বৈঠক আয়োজনে বন্ধু রাষ্ট্র চীন চেষ্টা করছে অবিরত। মিয়ানমারে সেনা শাসন জারির পর বহুদিন ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ ছিল। তবে সম্প্রতি সেটি শুরু হয়েছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় পর মিয়ানমারের সঙ্গে প্রথম কোনো দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয় গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সেখানে আলোচনা হয়, তবে কোনো পরিকল্পনা শেয়ার করেননি মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা। ‘অ্যাডহক টাস্কফোর্স ফর ভেরিফিকেশন অব দ্য ডিসপ্লেসড পারসনস ফ্রম রাখাইন’- শীর্ষক ওই বৈঠক হয় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। এর আগে, সবশেষ ২০২১ সালের সূচনাতে চীনের মধ্যস্থতায় মন্ত্রী ও কর্মকর্তা পর্যায়ে (ত্রিপক্ষীয়) বৈঠক হয়েছিল। চলতি মাসে কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে একটি বৈঠক আয়োজনের চেষ্টা চলছে জানিয়ে ঢাকার ওই কর্মকর্তা বলেন, সেটি সম্ভব হলে হয়তো পরিকল্পনার বিস্তারিত জানা যাবে। ওই কর্মকর্তা এ-ও বলেন, ঢাকাস্থ চীনের রাষ্ট্রদূতও আকার- ইঙ্গিতে প্রত্যাবাসনে নাটকীয় অগ্রগতি আসার সম্ভাবনার কথা বলেছেন। চীন বরাবরই দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগে প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে আশাবাদী। তবে ওই কর্মকর্তার বক্তব্যের ভিন্নতাও মিলে মন্ত্রণালয়ের অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপে। তাদের মতে, মিয়ানমার আদতে প্রত্যাবাসনে কতটা আন্তরিক? তা নিয়ে শুরু থেকেই সন্দেহ রয়েছে। তারা সময়ক্ষেপণে বিভিন্ন সময় নানান পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে। এটি তাদের আন্তর্জাতিক চাপ এড়ানোর কৌশলমাত্র! আমরা যদি মিয়ানমারের ভাষা এখনও বুঝতে না পারি তবে রোহিঙ্গা সংকট আরও ঘনিভূত হবে সন্দেহ নেই এমন মন্তব্য করে এক কর্মকর্তা বলেন, ৭০০ জনকে গ্রহণে তাদের যে পরিকল্পনা এটি সেই কৌশলের অংশ হতে পারে।
জাতিসংঘের রিপোর্ট মতে, ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যের মংডু পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার পর যে ক্লিয়ারেন্স অপারেশন শুরু করে বার্মিজ সেনারা তা থেকে প্রাণে বাঁচতে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তাছাড়া আগে থেকে বাংলাদেশে আরও প্রায় সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস করছিল। রাখাইনে ২০১৭ সালে জাতিগত নিধনের শিকার হয়েছেন রোহিঙ্গারা। সেখানে গণহত্যার সংঘটিত হয়েছে মর্মে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা করেছে সদস্য রাষ্ট্র গাম্বিয়া। ওই মামলার সর্বশেষ শুনানি হয়েছে গত মাসে। যেখানে উভয়পক্ষ যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের সুযোগ পেয়েছে। সেই শুনানিতে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার প্রশ্নে মিয়ানমারের আপত্তি নাকচ করা হয়েছে। গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল দাওদা জালো মিয়ানমারের আপত্তি নাকচ করে দিয়ে গণহত্যার মূল মামলা বিচারের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) প্রতি ফের আহ্বান জানান। শুনানিতে মিয়ানমারের দাবি খণ্ডন করে আইনজীবী পল রাইখলার ও দাওদা জালো বলেন, গণহত্যা বন্ধ এবং এর বিচারে সনদে স্বাক্ষরকারী সবারই দায়িত্ব আছে। আর গাম্বিয়া সেই দায়িত্ব পালন করেছে। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে আদালতের কাছে মিয়ানমারের প্রাথমিক আপত্তিগুলো নাকচ করার আরজি জানান। গাম্বিয়া ওআইসি’র প্রতিনিধি হিসেবে মামলা করেছে বলে মিয়ানমারের দেওয়া বক্তব্যকে নাকচ করে তারা বলেন, গাম্বিয়া রাখাইনে গণহত্যার লাশের গন্ধ পেয়েছে বলেই গণহত্যা সনদের অংশগ্রহণকারী হিসেবে এই মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাখাইনের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো সাম্প্রতিক সময়ে আইডিপি ক্যাম্প ভেঙে গ্রাম তৈরির খবর ফলাও করে প্রচার করছে। গতকালও এ নিয়ে একাধিক রিপোর্ট প্রচারিত হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা বাতিলের আবেদন নাকচের পর রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের বর্তমান সরকার মানবিক বলে ব্যাপক প্রচার চলছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এটি করা হচ্ছে। প্রত্যাবাসন পরিকল্পনার বিষয়টি এমনই হতে পারে! উল্লেখ্য, এর আগে চীনের মধ্যস্থতায় দু’দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল কিন্তু তা সফল হয়নি।