ভোক্তাশ্রেণী ক্ষোভ জানাবে কার কাছে

0

ড. মাহবুব হাসান
বিক্ষুব্ধ হতে পারি আমরা নানান বিষয়েই কিন্তু সেই বিক্ষুব্ধ মানুষকে শান্ত করবে কে? দায়িত্ব সরকারের। কারণ সরকারই সব কিছুর নিয়ন্তা শক্তি। দ্রব্যমূল্য নিয়মিতই বাড়ছে। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। এখন আর তারা আনন্দের সাথে নিত্যপণ্য কিনতে পারে না। তারা সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হচ্ছে, কিন্তু সরকার তা পাত্তা দিচ্ছে না বা পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরছে না। আসলে লাগামটি পাগলা ঘোড়ার তাই লাগামে টান দিয়েও তাকে বাগে আনতে পারছে না। সরকারের মন্ত্রীরা নিত্যপণ্যের বাজারের লাগাম টেনে ধরার চেয়ে বলে থাকেন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কথা। বিশেষ করে আমদানি করা পণ্যের ব্যাপারে তারা এ কথা বলেন। দেশে উৎপাদিত হয়, হচ্ছে সেই পণ্যের দামও তো নিত্যই বাড়ছে বা ওঠানামা করছে। পাইকারি বাজার থেকে শুরু করে খুচরা বাজারের কোন কোন ধাপে দাম বাড়ে, কী কী কারণে বাড়ছে তা অনুসন্ধান করে ভোক্তাক্রেতাদের আপডেট দিতে পারত সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাণিজ্যমন্ত্রীর একটাই কথা আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে গেলে কী করতে পারেন তিনি? আসলেই তো কী করতে পারতেন তিনি? তার তো কিছু করার নেই। তিনি পদত্যাগ করতে পারতেন। না, তিনি সে পথে যাননি। পদত্যাগে সমাধান নেই। তিনি চলে গেলেই কি পণ্যের ঊর্ধ্বগতি স্থিতিশীল হবে? দুর্মুখেরা বলে, তিনি পদত্যাগ করলেই রাহুমুক্ত হবে কাঁচাবাজার, পাইকারি বাজার। খুচরা বাজারেও তার সুফল পড়বে। তার মানে তার পদত্যাগই সব আমদানি বাণিজ্যের মুক্তি। এটা আমরা মনে করি না।
২. আগামী ৩১ মার্চ থেকে খোলা সয়াবিন আর বিক্রি করতে পারবে না খুচরা দোকানদাররা। সরকার খোলাবাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না, তাই ওই ব্যবস্থা। ওই দিন থেকে খুচরা ক্রেতারাও পলিপ্যাকে কিনবে সয়াবিন তেল। পলিপ্যাকগুলো কত ছোট আকারের হবে তা অবশ্য বলেননি বাণিজ্যমন্ত্রী। হতে পারে তা ১০০ গ্রাম থেকে শুরু করে ১০০০ গ্রাম বা এক কেজি পর্যন্ত। আবার এমনও হতে পারে যে ১০০ গ্রামের পর ২৫০ গ্রাম, ৫০০ গ্রাম, সাড়ে ৭০০ গ্রাম প্যাকও হতে পারে। কিন্তু সমস্যা তো খোলা সয়াবিন বিক্রিতে নয়, দামের হেরফেরের ওপর। দাম কে নির্ধারণ করে? বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং তাদের এতদসংক্রান্ত সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো। যারা দাম নির্ধারণ করেন, তারাই তো আন্তর্জাতিক মার্কেটে দাম বাড়ার অজুহাতে খুচরা বাজারেও দাম বাড়িয়ে দেন। এ কথাগুলো বলছি সামনে রোজার মাস আসছে, সেই সময়ের দাম বাড়াবার ধকল সহ্য করার লক্ষ্যে। নিশ্চিত করেই বলা যায়, ঐতিহ্যগত স্বভাবে পাইকারি ও খুচরা দোকানে রোজার মাসে দাম বাড়বে সয়াবিনের। এই তেল ছাড়াও হাজারটা কাঁচাবাজারের পণ্য আছে যার দাম বাড়াবে পাইকারি মার্কেটের নিয়ন্ত্রকরা। রোজার সময়, ঈদের আগে দাম বাড়িয়ে টু-পাইস কামানো (টু-পাইস মানে কয়েক হাজার কোটি টাকা) তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার আওতায় পড়ে। তাদের সেই দাম বাড়ানোর স্বাধীনতায় কে ‘কাবাব মে হাড্ডি’ হতে যাবে? কেউ যাবে না। মন্ত্রী মহোদয় তো যাবেন না, কারণ তিনি দাম ঠিক করে দিয়ে মনে করছেন, তিনি যে দামে কিনতে ও বিক্রি করতে বলেছেন, তারা তা নতমস্তকে মেনে তা পালন করছেন। না, বিষয়টা অত সহজও নয়, স্বাভাবিকও নয়। স্বাভাবিক একমাত্র তাই, তা হচ্ছে মূল্যবৃদ্ধি।
৩. কাঁচাবাজারে গিয়েছিলাম সবজি কিনতে। চিকিৎসক বলেছেন, আপনাকে শাক-সবজি বেশি করে খেতে হবে। সেই নির্দেশ মানতেই কাঁচাবাজারে গিয়েছি। একটি লাউ (গাঁয়ের মানুষ বলে কদু) আঠারো ইঞ্চি লম্বা হবে, দাম একশ টাকা। চৈত্র মাসের লাউয়ের দাম যদি একশ টাকা হয়, তাহলে আমরা যারা সীমিত আয়ের মানুষ, তারা তো কদুর গন্ধও শুঁকতে পারব না। তাই কদু না কিনে ফিরে এলাম। ফুলকপির দাম আকার/প্রকার ভেদে ৪০-৫০-৬০ টাকা। এতদিন গোল আলুর দাম ৩০-৩৫ টাকাই ছিল। বেগুন এতদিন ৭০-৮০ টাকায় দেখেছি, রোজা এলেই বেগুনের গুণ বেড়ে ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যে কোথায় উঠবে, তা কেউ বলতে পারবে না। বাণিজ্যমন্ত্রী বলবেন, কাঁচাবাজারের দাম নিয়ন্ত্রণ তো আমার নয়। তাহলে কে নিয়ন্ত্রণ করেন? কৃষিমন্ত্রী? নাকি খাদ্যমন্ত্রী? বাণিজ্য-কৃষি-খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয় যদি কাঁচাবাজারের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ না করেন, তাহলে আমাদের জানার অধিকার আছে কে এর দায়িত্বে? যদি একই সাথে তিন মন্ত্রণালয়ের বাজার তদারকি কর্তৃপক্ষ খোলাবাজারের এবং পাইকারি বাজারের মূল্য নিয়ন্ত্রণের কাজে তৎপর থাকেন, তাহলে কি মূল্যবৃদ্ধির এমন এনার্কি চলতে পারে? না, পারে না, পারত না। আসলে মন্ত্রীরা একটি সংবাদ সম্মেলন করে দাম বেঁধে দেন, আর শুরু হয় সেই দামের ঊর্ধ্বগতি। সেই গতি আর থামে না। দামের গতির রাশ টেনে ধরার চেষ্টা অবশ্য মন্ত্রণালয়ের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সম্মেলন কক্ষে বেশ চলে, গণমানুষের ভোগান্তি চড়তেই থাকে উপরের দিকে। মূল্যবৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক মার্কেটের সাফাই দিয়েই যদি মন্ত্রীরা ক্ষান্ত হন, তাহলে তো আর তাদের দরকার নেই। মন্ত্রণালয়ে একজন করণিকও এ দায়িত্ব পালন করতে পারেন। মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের কাজ মন্ত্রণালয়েই সীমাবদ্ধ, তাদের শীতল হাওয়ার ঝাপটা কখনোই ক্রেতাসাধারণের গায়ে এসে লাগে না। দাম কমানোর ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটাটা কে আনতে পারবেন গরিব মানুষের কেনাকাটার নিত্যপণ্যের বাজারে? সরকার দাবি করে, তারা জনগণের সরকার। কিন্তু তাদের সাথে জনগণের কখনোই দেখা হয় না। সিস্টেমটা দেখা হওয়ার নয়। সিস্টেমটা হচ্ছে জনগণ থেকে দূরে থাকার। ফলে জনগণের খোঁজখবর করার চেয়ে টু-পাইস কামানোর কাজেই তারা বড্ড বেশি ব্যস্ত।
৪.শাক-সবজির কথা বলি। নিত্যই লাগে। কাওরান বাজারের সবজি মার্কেটের ভিড় মধ্যরাতে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। এই রকম কত পাইকারি বাজার আছে ঢাকায়? জানি না। তবে, আছে এটা বুঝতে পারি। বিভিন্ন জেলা থেকে আসে ওই সবজি। পথে চাঁদাবাজি করে রাজনৈতিক মাস্তান-সন্ত্রাসী, শ্রমিক সংগঠনগুলোর লোকেরা, পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশ। এসব চাঁদাবাজির খেসারত টানে ক্রেতা-ভোক্তাশ্রেণী। যারা ধনবান তাদের সমস্যা হয় না। তাদের আয়-রোজগার বৈধ পথে খুবই কম। কিন্তু যারা খেটে খাওয়া মানুষ, তাদের পক্ষে ওই রকম উচ্চমূল্যে সবজি কেনা সম্ভব হয় না। তাদের জীবনে নিত্যই নাভিশ্বাস। এই পরিস্থিতির কী অবসান হবে না?