মহান শহীদ ও ভাষা দিবস সংখ্যা-২০২২

0

সাধারণ মানুষ এখন অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে
সালাহউদ্দিন বাবর

আমাদের সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের সীমা ও পরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২(ক) বলা আছে – ‘১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পূর্বে যেসব এলাকা লইয়া পূর্ব পাকিস্তান গঠিত ছিল এবং সংবিধান (তৃতীয় সংশোধন) আইন ১৯৭৪-এ অন্তর্ভুক্ত এলাকা বলিয়া উল্লিখিত এলাকা। কিন্তু উক্ত আইনে বহির্ভূত এলাকা বলিয়া উল্লিখিত এলাকা তদবহির্ভূত; এবং ২(খ) ‘যে সকল এলাকা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সীমানাভুক্ত হইতে পারে।’ এই বর্ণনা অনুসারে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের কিছু বেশি এলাকা নিয়ে বাংলাদেশের পরিধি। বস্তুত দেশটি আমাদের আয়তনের দিক থেকে ছোট বটে। আমাদের প্রিয় এই মাতৃভূমি আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের ৯৪তম একটি দেশ। তবে জনসংখ্যার নিরিখে বাংলাদেশ পৃথিবীর ৮ম বৃহৎ দেশ। বাংলাদেশের জনসংখ্যা আনুমানিক ১৭ কোটি ছুঁই ছুঁই করছে।
যাই হোক, এই জনপদকে ছোট বলি আর বড়ই বলি, আমরা কিন্তু হাজারো সমস্যার আবর্তে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি, হালভাঙা তরী যেমন মাঝ দরিয়ায় কেবলই ঘুরপাক খায়, তেমনই আমরাও খাচ্ছি। গত ৫০ বছরে ‘দেশের সমস্যা কমেনি বরং বেড়েই চলেছে। দেশের মানুষ গত অর্ধশতাব্দী ধরে কেবল জীবন বাঁচানোর সংগ্রামে লিপ্ত, জীবনটা অবশ্য সংগ্রামের তথা যুদ্ধের। কিন্তু তার তো একটা ফল থাকে, স্বস্তি, শান্তি আর স্বাচ্ছন্দ্যের। কিন্তু অহর্নিশ যুদ্ধের ফলতো কেবল ‘সকলই গরল ভেল’। পরিসংখ্যানের মারপ্যাঁচে বলা হচ্ছে আমাদের আয়-রোজগার বাড়ছে, হয়তো বাড়ছে, কিন্তু প্রশ্নটা তো হলো, কাদের বাড়ছে, বড় জানতে ইচ্ছা করে। আমরা তো নানা গবেষণা নিবন্ধে দেখছি, মধ্যবিত্ত সমাজজীবন যুদ্ধের কশাঘাতে হারিয়ে যাচ্ছে, দরিদ্র ক্রমেই হতদরিদ্র হচ্ছে। আমরা সাধারণরা তো দেখি সরকারি সেবা কিনতে গাঁটের সব পয়সাই দিতে হচ্ছে।
আর কোথাও থেকে আয় বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়ে সব সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান তাদের আয় বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় রয়েছে। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, বাস ভাড়া, ট্রেন ভাড়া বাড়িয়ে চলছে। অর্থাৎ দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত সবার মাথায় মুগুর মারা হচ্ছে, মনে হয় কর্তৃপক্ষ ভাবে, এরা সবাই সর্বংসহা। অন্য দিকে অপচয়, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার অতীতের সর্ব রেকর্ড ‘ব্রেক’ করে বসে আছে। বলা হচ্ছে উন্নতি হচ্ছে, হ্যাঁ হচ্ছে মেট্রো রেল হচ্ছে, পাতাল রেল, ট্যানেল হচ্ছে। অথচ গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাটের কী বেহালদশা, ব্রিজ, কালভার্ট সব জরাজীর্ণ হয়ে ভেঙে পড়ছে, নদীর পাড় ভাঙছে, মানুষের বসতবাড়ি জমিজমা নদীতে বিলীন হচ্ছে। স্কুল-মাদরাসাগুলোর কাহিল অবস্থা, স্বাস্থ্যসেবার কী ভয়ানক দৈন্য। অথচ এসব গ্রামগঞ্জেই দেশের বেশির ভাগ মানুষ বাস করেন কী নিদারুণ বৈষম্যের শিকার হয়ে। এসব মানুষই দেশের জন্য খাদ্যশস্য শাকসবজি ফলান। কিন্তু পরে পানির দরে বিক্রি করতে বাধ্য হন, তাতে খরচ ওঠে না। কয়েক হাত ঘুরে তা যখন জেলা সদরে, বড় শহরে, রাজধানী আসে, সেটাই অগ্নিমূল্যে বিক্রি হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শস্য-সবজি ফলায়ে এখন রিক্ত নিঃস্ব হচ্ছে। মাঝে মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভের গুড় শতভাগই খাচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি সংস্থা এর কি একটা সমাধান দিতে পারে না? বাজারজাতের একটা বিকল্প ব্যবস্থা জরুরি ব্যবস্থা করে কৃষিজীবীর স্বার্থটা সংরক্ষিত করা যায় না? এমন পরিকল্পনা নেয়া হলে উৎপাদনকারী ও ভোক্তা সমভাবে লাভবান হতো।
এ দিকে জাতীয় দৈনিকগুলো পরিকল্পনা কমিশনের বরাত দিয়ে খবর প্রকাশ করেছে, দেশের মানুষের নাকি মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বছরে মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৫৯১ ডলারে উন্নীত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারের বার্ষিক আয় ২৭ হাজার ৯৫৫ ডলার। এটা টাকায় যদি রূপান্তরিত করা হয়, এক ডলার সমান ৮৬ টাকা ধরে, সে হিসাবে ওই পরিবারের বার্ষিক আয় দাঁড়ায় ২৪,০৪১৩ টাকা।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কোভিডের ভয়াবহ ছোবলে অসংখ্য মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছেন, বহু প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাসিক বেতন তাদের প্রতিষ্ঠান কমিয়ে দিয়েছে, কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। আয় রোজগার এতটা কমেছে যে, তারা এখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম দুর্ভোগে। অথচ পরিকল্পনা কমিশন বলছে, মানুষের আয় বেড়েছে, হয়তো বেড়েছে; কিন্তু কাদের বেড়েছে? সেই ভাগ্যবান যারা কোভিডের সময়ে পরিস্থিতি সুযোগ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে দুই নম্বরি করা থেকে এককাঠি উপরে উঠে এখন তিন নম্বরি করেছেন, তাদের আয়-রোজগার অবশ্যই চতুর্গুণ বেড়েছে। এ দিকে জনগণের সঙ্গীন অবস্থা অন্য দিকে ব্যবসা-বাণিজ্যে যত অনিয়ম তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা আছে কি! প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের এসব কর্মকা- দেখে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতের অংশবিশেষের কথা স্মরণে আসছে ‘চোখ তো অন্ধ নয় বরং বুকের মাঝের হৃদয় অন্ধ’ (সূরা ২২ : আয়াত ৪৬)। হৃদয়টা যদি নিকষ কালো হয়ে থাকে তবে সেখানে স্বচ্ছতা আসবে কিভাবে? তারা আর কী দেখবে। তাদের বিবেচনা তো উবে গেছে।
একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি খবর উদ্ধৃত করছি। সেটা পাঠ করে তা থেকে মনে যে বোধ সঞ্চারিত হয়েছে, তা হৃদয়বান পাঠকদের সাথে শেয়ার করার বাসনা পূরণ করতে চাই। শিরোনাম হচ্ছে ‘সিটি করপোরেশনে দক্ষ চালক নিয়োগের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর।’ খবরের বিস্তারিত হচ্ছে ‘সিটি করপোরেশনে দক্ষ চালক নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’
তিনি বলেছেন, ময়লার গাড়ির চালকের কারণে সম্প্রতি রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। সে রকম যেন আর না হয়।’ খবরের এতটুকু থেকে দু’টি বিষয় মনে জাগ্রত হয়েছে, প্রথম হলো প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি সব দিকেই যে খোলা সেটা একটি ইতিবাচক দিক। দ্বিতীয়ত. প্রশ্ন হচ্ছে সিটি করপোরেশনের এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে এত ওপর থেকে কথা বলতে হবে কেন? তাদের দায়-দায়িত্বের এত ঘাটতি থাকলে এসব স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান যে তিমিরে পড়ে আছে সেখানেই তাকে পড়ে থাকতে হবে। তারা নগরবাসীকে কিভাবে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে সক্ষম হবেন? করপোরেশনের আর এ খবর হয়তো দৃষ্টি এড়ায়নি। সেটা হলো – ময়লার গাড়ির চালকরা বহু ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে অন্যদের দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নেন। সেই চালকরা এত হেভি ভেহিকেল চালানোর ক্ষেত্রে দক্ষ কিনা, তাদের যথাযথ লাইসেন্স রয়েছে কিনা তা কে জানে। এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সেবা পাওয়ার জন্যই দুই নগর পিতা তথা মেয়রদ্বয়কে নাগরিকগণ নির্বাচিত করেছিলেন। কিন্তু এখন প্রশাসনের কাছ থেকে রাজধানীতে বসবাসকারী নাগরিকগণ সর্বনিম্ন সেবাটাই পাচ্ছেন। তাই জিজ্ঞাসা – দুই করপোরেশন আগামীতে কেমন ও কতটুকু সেবা তারা মানুষকে দিতে পারবে?
প্রসঙ্গটা উঠেছে দক্ষ গাড়িচালক নিয়ে। এ দিকে সড়কের মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক দুঃখের কাহিনী রয়েছে। নিরাপদ সড়ক চেয়ে দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন চলছে, তা নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। মানুষ ঘর থেকে বের হয় কাজের জন্য। কাজ শেষে নিরাপদে ঘরে ফিরবে – এটাই পরিবার-পরিজনদের আশা। কিন্তু এখন তো সড়কে মৃত্যুর ফাঁদ পেতে বসে আছে বাস-ট্রাক, অন্যান্য যন্ত্রচালিত যানবাহন। সম্প্রতি কক্সবাজারে পিতার শ্রাদ্ধক্রিয়া সম্পন্ন করার পর বাড়ি ফেরার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ সহোদর ভাইয়ের প্রাণ কেড়ে নেয় এক গাড়ি। এখন এই পরিবারের আর কী অবশিষ্ট থাকল? তাদের পরিবার যে নিঃস্ব সর্বস্বান্ত হলো তার কী প্রতিকার হবে! এরপর দিন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার পাইন্দং ইউনিয়নের হাইদচকিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর দুই ছাত্রীকে একটি যান চাপা দেয়, ঘটনাস্থলেই দুই সহপাঠীর প্রাণ যায়। কিছুদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মধ্যে এক ছাত্রকে ট্রাক চাপা দিলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এ-তো দুই-একটি ঘটনা মাত্র, অথচ প্রতিদিন দেশে বিভিন্ন স্থানে সড়কে যানবাহনে পিষ্ট হয়ে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে চলেছে। গত ছয় মাস আগে দেশে ৪১৮ ব্যক্তি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। সড়ক মানুষের জন্য নিরাপদ করতে কী ব্যবস্থা হচ্ছে, মানুষের তা জানার অধিকার আছে। তা ছাড়া সড়কে আরো কত অনিয়ম অব্যবস্থাপনা রয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মহাসড়কে দ্রুতগামী বাস ট্রাকের পাশাপাশি চলছে স্বল্প গতির নানা যানবাহন; এসবও দুর্ঘটনার কারণ। মহাসড়কে পণ্যবাহী, যাত্রীবাহী যানবাহন থেকে চাঁদাবাজি করছে স্থানীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত টাউট মাস্তানরা। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধেও রয়েছে চাঁদাবাজির অভিযোগ।
প্রতি ১০ বছর পরপর আদমশুমারি করার নিয়ম থাকলেও সেটা হচ্ছে না। অথচ আদমশুমারির মাধ্যমে প্রকৃত জনসংখ্যা পাওয়া গেলে; দেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিষেবা নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলে সেটা বাস্তবভিত্তিক হয়; কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তেমন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে কি? দেশে সর্বশেষ আদমশুমারি হয়েছিল ২০১১ সালে, তখন দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৪ জন। পূর্ববর্তী শুমারি থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৪.৯৭ শতাংশ। সব চেয়ে বেশি জনসংখ্যা ছিল ঢাকা বিভাগে, সংখ্যাটা চার কোটি ৭৪ লাখ ২৪ হাজার ৪১৮ জন। কম জনসংখ্যা ছিল বরিশাল বিভাগে, ৮৩ লাখ ২৫ হাজার ৬৬৬ জন। গত শুমারির ১২ বছরের মাথায় এখন জনসংখ্যা অবশ্যই বেড়েছে। তবে গত দুই বছরে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১২ ফেব্রুয়ারি ’২২ পর্যন্ত ২৮ হাজার ৭৯১ জন। কিন্তু কোভিডে আক্রান্ত হয়ে প্রকৃতপক্ষে কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন তার সঠিক হিসাব কারোই জানা নেই। তবে সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়। তাতে মোট জনসংখ্যা কিছু তো কমবেই, বহু দেশেই এমন ঘটেছে। যাই হোক এখন অনুমান করে দেশের জনসংখ্যা যা নির্ণয় করা হয়েছে, তাতে প্রতি বর্গমাইলে জনবসতি ২৮৮৯ জন। সরকারি হিসাব অনুসারে দেশে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ যারা কিছু লিখতে-পড়তে পারেন, তাদের শতকরা হিসাব হচ্ছে ৬৫ শতাংশ। তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও নানা হিসাবে বহু গরমিল আছে। তাই আমাদের সত্যিকার শিক্ষিত জনশক্তি কত, আর আমজনতার সংখ্যা ৩৫ শতাংশ অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন, প্রকৃত ‘জনশক্তি’র সঠিক হিসাব কত, জানা না থাকলে কোনো পরিকল্পনা করা কঠিন, সেই ‘আমজনতার’ সংখ্যাটা বৃদ্ধি রোধ করার কোনো উদ্যোগ সস্পর্কে তো কিছু জানা যায় না। তা ছাড়া জনশক্তি আর জনসম্পদের মধ্যে তফাৎ আছে। জনশক্তি তখনই জনসম্পদে পরিণত হবে যখন কোনো কর্মে দক্ষ, বিভিন্ন ‘ট্রেডে’ প্রশিক্ষিত। এ ব্যক্তিদের নিয়ে দেশ গঠনের কাজ হতে পারে। জনশক্তি নিয়ে এখন বেশি কিছু ভাবা হয় না। তাদের নিয়ে কোনো ‘প্রেডিকশন’ করা যায় না। কারণ আমজনতা মুহূর্তেই উচ্ছৃঙ্খল জনতায় পরিণত হয়ে অঘটন ঘটাতেই পারে। অন্যদের সাধু সিদ্ধবা বলি কী করে। কোভিডকালে প্রতিনিয়ত এমন সব কর্মকাণ্ড হচ্ছে যা প্রায়ই সর্বত্র দেখা যায়, স্বাস্থ্যবিধি তোয়াক্কা করছেন না কেউই। দেশের সব মানুষকে যদি জনসম্পদে পরিণত করার সত্যিকার চেষ্টা থাকত, তবে স্বাধীনতার পরপর, গত পাঁচ বছরে এ কাজে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো।
এ জন্য দায়ভার রাজনৈতিক দলগুলোকে নিতে হবে, যে দল ‘নির্বাচন’কে ‘মোকাবেলা’ করে ক্ষমতায় আসে। নির্বাচনের প্রাক্কালে দলে পেশ করা ‘ইশতেহারে’ জনগণকে হাজারো প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাস দিয়ে থাকে তারা। কিন্তু ক্ষমতার মসনদে বসে সব ভুলে যায়। ক্ষমতার ‘কুরসিতে’ বসে সে কুরসির ‘ওমে’, এর সুখবোধে সব কথাই ভুলিয়ে দেয় তাদের। তবে এতটুকুও ভুলে যায় না, তাদের ক্ষমতাকে নিরাপদ নিরঙ্কুশ করতে প্রয়োজনে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে দলনে কালক্ষেপণ করে না। অন্য কথা না হয় থাক, এতটুকু একান্ত প্রয়োজন ছিল জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করা আর জনতাকে জনশক্তিতে পরিণত করা। এতেও এই জনপদের অনেক সমস্যার সুরাহা হতো। দেশে অনেক কিছুরই অভাবের মধ্যে জনসম্পদের অভাবটা কম কিছু নয় বরং মৌলিক একটা ব্যাপার। সত্যিকার জনসম্পদ যে মানুষ, হৃদয়ের ভেতর লুকায়িত থাকে মানবিকতা। তার বিকাশ ঘটলে সে জানবে রাষ্ট্রের কাছে তার কী অধিকার আর ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ ও রাষ্ট্রের কী অধিকার তার ওপর গচ্ছিত রয়েছে। আর সেজন্য এসব পরিশীলিত মানুষকেই প্রয়োজন দেশের খেদমতের জন্য। তারা দেশের কোনো দায়িত্বে আসীন হলে সমাজ রাষ্ট্রে যে অনিয়ম অব্যবস্থা সেটা দূর করা অনেকটা সম্ভব হতো। সমাজে অবস্থানকারী এসব আলোকিত মানুষ বেছে নেয়ার একটি মাত্র পথ আর সেটা হচ্ছে প্রশ্নহীন স্বচ্ছ নির্বাচন। পরিবারে কোনো সদস্য অপেক্ষাকৃত গুণপনায় এগিয়ে আছে তা শুধু পরিবার নয় মহল্লা, গ্রাম, অঞ্চল সবার কাছে তার সদগুণ, সত্যনিষ্ঠতা, কালোকে কালো বলেই জানা, দায়িত্ব পাওয়া আমানত হিসেবে জ্ঞান করে পরসেবায় আত্মনিয়োগ করা হতো তার নীতি। এসব কারণে সবাই তাকে উত্তম হিসেবে বিবেচনা করবে। এভাবেই যদি দেশের সব এলাকায় এমন সব মানুষকে বেছে নেয়ার অধিকার জনগণের বহাল হয়, তথা সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তবে দেশের চেহারা পাল্টে যেত। দুর্নীতি জোচ্চুরি যথেচ্ছাচার, সমাজ রাষ্ট্রের সম্পদ গ্রাস-পাচার বন্ধ হতো। দায়িত্ব হাতে পেলে তারা পাহারাদার হয়ে মানুষ, সমাজ ও দেশের সত্যিকার সেবক হতো। এখন এর প্রচ- অভাব।
রাজনৈতিক দলগুলো যদি উল্লিখিত প্রক্রিয়ায় নিজেদের দলের জন্য এমন সজ্জন, যারা পরার্থে নিবেদিতপ্রাণ, নেতাদের খুঁজে নিত, তবে দেশের অনেক কল্যাণে তারা আসতে পারতেন। এমন লোক থেকে দলের কাছে নির্বাচনে প্রার্থী হতে যাচ্ঞা করবে না, ছুটে আসবে না, তাদের কাছে দলকে যেতে হবে। এখন বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীনদের নেতাদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ, ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম অন্যায় পথে চলে, দেশের নয়, দশের নয় নিজে ভোগ-বিলাস ও আখের গোছানোর কাজে ব্যবহৃত হচ্ছেন। তেমন হয়তো হতো না। দল যেমন প্রাণবন্ত হয়ে উঠত, সেই সাথে দেশের মানুষ দলের প্রতি আস্থাশীল হতো, দলকে সমর্থন সহযোগিতা করতে প্রস্তুত থাকত। এখন ক্ষমতায় আসতে দলকে যত ছলাকলা, কৌশল অনৈতিক পথের আশ্রয় নিতে হয় সেটার আর প্রয়োজন পড়ত না। আজকাল যেভাবে দলগুলো ক্ষমতা লাভ করে মসনদে বসে তাতে তাদের বুকের ভেতর যে হৃদয়টা আছে, সেটা গ¬ানিতে ভরে আছে। সুস্থ প্রক্রিয়ায় নেতা হয়ে যারা আসেন, তাদের কাজে-কর্মে যে সৌরভ সৌন্দর্য বেরিয়ে আসত সেটার বিচ্ছরণ ক্ষুব্ধ মানুষকে আনন্দ উল¬াসে মাতিয়ে তুলত, নবতর চেতনায় মানুষ উদ্বুদ্ধ হতে পারত।
এমন সব নেতৃত্ব সমাজ ও সমাজের মানুষকে আলোকচ্ছটায় উজ্জ্বলতর করে তুলতে পারত। তাদের সংস্পর্শে সমাজের সাধারণ মানুষ এখন অসাধারণ হয়ে উঠত। তারা যদি ভুলক্রমেও অনিয়মে, চৌবাচ্চায় পড়ে তবে তৎক্ষণাৎ বিবেকের তাড়নায় সেখান থেকে উঠে আসার জন্য অবিরত চেষ্টায় নিয়োজিত হতো। এখন সমাজ যে পঙ্কিলতায় ভরে আছে, আমাদের নেতারা সে দিকে চোখ মেলে তাকান না, তা অপসারণের কোনো কোশেশ করেন না। এসব সবার অলক্ষ্যে তারাই তো কামাই করছেন। জাতীয় জীবনের এমন সব জঞ্জাল দেখে কেউ আর স্বস্তি বোধ করেন না। তবে এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। সেই অতীতে বঙ্গবন্ধু বেদনায় কাতর হয়ে আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘আমি তো সোনার বাংলা গড়তে সোনার মানুষ পাইনি।’ আমাদের তেমন মানুষ নেই যিনি ‘কথায় না বড় হবে, কাজে বড় হবেন।’ আমরা মূলত জাতি হিসেবে ‘টকেটিভ’; কাজের ক্ষেত্রে সব ঠনঠন। আমাদের নেতৃবৃন্দ কিন্তু এ ক্ষেত্রে এক কাঠি ওপরে। নানা ঘটনার দিকে নজর দিলে আমাদের কথার সত্যতা মিলবে। কাল কী কথা বলবেন, হয়তো দিন মান তা ভেবেই গুজরান হয়। তাই কাজ করবেন কখন! তবে সুধী সমাজ ভাবেন, ‘কাজের কাজী’ তো আকাশ থেকে নেবে আসবে না। এখান থেকেই তাদের বেছে নিতে হবে। ওপরে যে কথা বলেছি, এখন তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই, সমাজে এখনো বহু সৎ যোগ্য মানুষের খুব একটা কমতি নেই, তারা সংগঠনের কাছে অকর্মাদের ভিড় ঠেলে আসবে না। সংগঠনকে তার সন্ধান করে নিতে হবে; তবেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়া যাবে। সে পথে চলার এরাদা আমাদের রয়েছে।
আমাদের নেতাদের সংস্পর্শে এসে এখন সাধারণ মানুষ অসাধারণ হয়ে উঠবেন, সে সুযোগ তো নেই। দেশের ওপর তলার মানুষের বহু অপকর্ম নিয়ে আমরা সবাই কিছু না কিছু জানি। নানা মিডিয়ায় তার বিস্তারিত সব কাহিনী আমরা শুনেছি ও পড়েছি। কিন্তু একেবারে তৃণমূলের শিক্ষাহীনতার অজ্ঞতা হোক বা পেটের দায়ে হোক বা আইনের প্রয়োগ না হওয়ার জন্য হোক তারা নিজের অজান্তেই মানুষের মারাত্মক ক্ষতি করছে। দেশের কিছু মানুষ তার শিকার হচ্ছে। লক্ষ করলে দেখবেন, রাস্তাঘাটে মাইকিং করে সর্বরোগে মহৌষধ, ভাঙা হাড় জোড়া দেয়ার তেল, নানা চর্মরোগের ‘ম্যাজিক’ মলম বেচাকেনা চলছে। এসব দাওয়াই রোগ নিরাময় করে আর কতটা অপচিকিৎসা, ওষুধ প্রশাসন কি কখনো এসব ‘ওষুধ যাচাই-বাছাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছে? অসচেতন ও নিম্ন আয়ের মানুষ ক্যানভাসারদের চটক বক্তৃতা শুনে এসব ‘ওষুধ’ ব্যবহার করেন। তারপর সে রোগীদের কী হয় না হয় তা কি কেউ কখনো জেনেছে? নিঃসন্দেহে এসবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তো আছেই। এসব ‘ওষুধ’ ব্যবহার করে ভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়। যারা এসব ‘ওষুধ’ বিক্রি করছে, তারা এককভাবে এ জন্য দায়ী নয়। রাষ্ট্র তো তাদের জন্য আয়-রোজগারের বিকল্প পথে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে পারেনি। এসব ‘ওষুধ’ ক্ষতিকর সেটা তো তাদের বলা হয়নি বা বিকিকিনির ব্যাপারে বাধা সৃষ্টি করেনি কেউ। তবে দাঁড়াল কী? দেশের মানুষ কি ‘গিনিপিগ’, এর কোনো জবাব দেবে ওষুধ প্রশাসন? এ ছাড়া ভদ্রবেশী জোচ্চোরও আছে ওষুধের জগতে। সব নামীদামি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ওষুধের নকল ভেজাল তৈরি করে বাজারজাত করছে এ দুর্বৃত্তরা।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে ফল কিনে খাওয়া কি সম্ভব? সাধারণ মানুষ তখনই ফল কিনে ঘরে যায়, যখন স্বজনদের কেউ অসুস্থ হয়ে ম্লান মুখে বিছানায় পড়ে থাকে। কিন্তু সেই কি পথ্য না কুপথ্য তা আমরা তো জানি না। আঙ্গুর, বেদানা, আপেল, নাশপাতিসহ সব ফলই বাজারে পাওয়া যায়। কিন্তু এসব ফল কি দেশে জন্মে? জবাব, না। সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে এসব ফল আসছে। সে ফল আসার জন্য অনেক সময়ের দরকার। আর ফল তো দ্রুত পচনশীল পণ্য। কিন্তু আমাদের বাজারে যে ফল আমরা দেখি, তা দেখে তো মনে হয় এখন গাছ থেকে তা পেড়ে আনা হয়েছে। তাহলে এর রহস্য কী? রহস্যটা হচ্ছে এসব ফলে কয়েক দফা ‘প্রিজারভেটিভ’ দেয়া হয় পচন রোধের জন্য। সে কারণে এসব ফল এত তরতাজা মনে হয়। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ‘প্রিজারভেটিভ’ প্রয়োগ করা হলে তা হবে মানুষের জন্য সেøা ‘পয়জনিং’; তাহলে প্রশ্ন হলো আঙ্গুর বেদানা নাশপাতি আপেল খাওয়া যাবে না? যাবে, যদি তাতে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় প্রিজারভেটিভ দেয়া হয়। কিন্তু এসব ফলে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় প্রিজারভেটিভ দেয়া আছে কি না তা তো দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের কিন্তু তাদের মন এসব থেকে যদি অন্য দিকে পড়ে থাকে! কিছুকাল বাদে বহু মানুষ নানা সব মারাত্মক রোগে ভুগতে শুরু করবে। আমাদের সমাজে এমন বহু অসঙ্গতি বিরাজ করছে। তা বলে লিখে শেষ করা যাবে না।
মোদ্দা কথা শাসনব্যবস্থায় অনেক ব্যত্যয় রয়েছে। এসব বজায় রেখে দেশ এগিয়ে যাবে, সে তো অলীক কল্পনা; আলো নয় আলেয়া। দেশের জন্য সুস্থ সবল জনবল অপরিহার্য। সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা দুর্যোগ অব্যবস্থার শিকার হয়ে মানুষ যদি দুখী হতে থাকে, তবে তার পরিণতি শুভ হতে পারে না। মানুষ তো আনন্দ সুখ স্বস্তি নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। তার ব্যত্যয় কেউ সইতে পারে না। এসব বিষয় পত্রিকায় তো আছে, দেশের সব আইনকানুন আছে। কিন্তু তার প্রয়োগ কোথায়? সমস্যাগুলোর একটা বিহিত করা যেতে পারে। কিন্তু এ জন্য সঠিক পথ অনুসরণ করা হচ্ছে না। দেশে এসব ব্যবস্থা উদ্যোগ আয়োজন, আইনকানুন বিধিব্যবস্থা সবাই এখন ‘ডিপ ফ্রিজের’ ভেতর সংরক্ষিত রয়েছে। তা জমে কঠিন বরফ পিন্ড হয়ে আছে। এর ফল গলবে কিভাবে!


মাতৃভাষায় বিশ্ব ভ্রমণ
রফিক আহমদ খান

বাঙালি সমাজ এখনো মনে করে, ইংরেজি না জানলে বিশ্ব ভ্রমণ করা যায় না, শুধু মাতৃভাষা দিয়ে ভিন দেশের অলিগলি ঘুরে দেখা কল্পনাতীত বা ভিন দেশে গিয়ে দরদাম করে পণ্য কেনা দুরূহ ব্যাপার। ইংরেজি জানা দূরের কথা প্রান্তিক মানুষ যারা ইংরেজিতে কথোপকথন কখনো শুনেননি তাদের কেউ ভিন দেশে ঘুরতে যাবেন একা একা- এটা আমাদের সমাজে ভাবাও যায় না। আসলে বিশ্ব পরিমন্ডলে বাস্তবে তা নয়।
আজকাল বিশ্ববাসী মাতৃভাষা দিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশ থেকে দেশ। ইংরেজি ভাষা না জানায় কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না নতুন দেশের নতুন শহরে ঘুরতে। আমাদের পাশের দেশ ভারতের তামিলদের কথাই যদি বলি- তাদের অনেকেই তামিল ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানেন না, বোঝেন না। এমনকি তাদের স্বদেশ ভারতের জাতীয় ভাষা হিন্দিও তাদের বোধগম্য নয়। তাদের অধিকাংশ নাগরিক হিন্দি বোঝেন না, জানেন না। শুধু মাতৃভাষা তামিলই একমাত্র সম্বল। তারপরও তাদের বিশ্ব ঘুরতে দেখা যায়। সপরিবারে ভিন দেশের পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়। তারা দলে দলে বিদেশে ঘুরতে যায়। আমরা এটা বলছি না, বৃহত্তর পরিসরে ভাব বিনিময়ের জন্য ইংরেজি শেখা-জানার দরকার নেই। অবশ্যই দরকার আছে। ইংরেজি বা অন্য ভাষা শেখা ও জানায় একজন মানুষের যোগ্যতা বাড়ায়। ভিন দেশির সাথে মনখুলে কথা বলা সহজ হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভাব-বিনিময়ে সামর্থ্য বাড়ায়। ভাব-বিনিময়ে প্রাণচাঞ্চল্য বজায় থাকে। তবে ইংরেজি বা অন্য ভাষা না জানলেও যে বিশ্ব ভ্রমণ করা যায় সে কথাটাই তুলে ধরার প্রয়াস এই গদ্যে।
মাতৃভাষার এতো জোর- জাপান, কোরিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, ফ্রান্স, স্পেনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের মধ্যে অনেক মানুষকে দেখেছি তারা তাদের মাতৃভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষা জানেন না; এমনকি টুকটাক ইংরেজিও না। শুধু মাতৃভাষা দিয়েই তারা ঘুরে বেড়ান দেশে দেশে। ইংরেজি বা সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা না জেনেও কোনো কোনো পুরুষ মানুষ ভিন দেশে গিয়ে নানা রসালয়ে ঘুরেফিরে রসাহরণ করে আসেন; এটাও এক মজার ব্যাপার। দেহ-মনের চাহিদার ব্যাপারে মূলত একই মনোভাব ও প্রকাশ ভঙ্গি জগৎবাসীর।
আমরা তখন কুয়ালালামপুরের বহু রঙে রঙিন চায়না টাউনে দোকান করি, পৃথিবীর নানা দেশের নানান জাতের নারী-পুরুষের কাছে দরদাম করে পণ্য বিক্রয় করি। একবার দুই জাপানি তরুণ-তরুণী ক্রেতা এসেছেন দোকানে। সম্ভবত ২০১৫ সালে। তারা একটা হাতব্যাগ পছন্দ করে দাম জিজ্ঞেস করতে গিয়ে দেখি মুঠোফোনের বাটনে টিপছেন জাপানি ভাষা। সাথে সাথে অনুবাদ দেখাচ্ছে ‘দাম কত’? আমিও ক্যালকুলেটর চেপে দাম দেখালাম।
দাম বেশি বলায় তারা চলে যাচ্ছেন দেখে বললাম, কত হলে নেবেন? তারা আবারো মুঠোফোনে অনুবাদ করে দেখালো তাদের প্রত্যাশিত মূল্য। আমি আমার মূল্য থেকে আরেকটু কমিয়ে দেখালাম, যা তাদের প্রত্যাশিত মূল্য থেকে অনেক বেশি। তখন তারা চলে যাচ্ছিলেন। আমি আরও কমিয়ে দিলাম দাম। তখনো তারা মুঠোফোন চেপে দেখালেন- সরি, এখন টাকা নেই, পরে আসবো।
সব কথাই তারা বলেছেন মুঠোফোনে অনুবাদ করে ও ইশারা-ইঙ্গিতে। শুধু একবার নয়, জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশের বহু পর্যটককে দেখেছি ইংরেজি জানেন না মোটেও। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের নাগরিকরাও সপরিবারে ঘুরে বেড়ান বিভিন্ন দেশে; তাদের মধ্যেও অনেকে মাতৃভাষা আরবি ছাড়া আর কোনো ভাষায় আলুপোড়া খাবে নাকি কচুপোড়া খাবে কিছুই বলতে পারেন না।
ইংরেজি বলতে ‘ইয়েস’ ‘নো’ ‘গুড’ এইটুকুই জানেন কেউ কেউ। তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা দিয়েই তারা নানান ভাষার নানা দেশ ঘুরে-ফিরে, কেনাকাটা করে বস্তা ভরে। ভিন দেশে গিয়ে আরবি ভাষায়ই পণ্যের দাম নিয়ে কেউ কেউ রাজ্যের তর্কাতর্কিতে মেতে ওঠেন। বিক্রয়কর্মী বেচারা কিছুটা বোঝেন কিছুটা বোঝেন না। তারপরও যথাসাধ্য চালিয়ে যান বিদেশি ক্রেতার মন জয়ের চেষ্টা। তার তো বেচা দরকার যেভাবেই হোক।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যারা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও শিল্পোন্নত, তাদের নাগরিকদের মধ্যেও দেখেছি কেউ কেউ ইংরেজি জানেন না। ইংরেজি না জানা তাদের ভিন দেশ ভ্রমণে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। তারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন সব কাঙ্ক্ষিত দেশে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
ইংরেজি না জানা পর্যটকদের জন্য বহুভাষা রপ্ত করে নেন পর্যটকনির্ভর শপিংমল ও পর্যটন স্পটে কর্মরত কর্মী ও ব্যবসায়ীরা। যেমন কুয়ালালামপুরের চায়না টাউন ও বুকিত বিনতাং এলাকায় দোকানে কাজ করা বাংলাদেশি কর্মীরা মালয় ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি, আরবি, ফারসি, ইন্দোন, চাইনিজ, ইতালীয়, তামিলসহ পৃথিবীর নানা দেশের ভাষায় কম-বেশি কথা বলতে পারেন কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো। ক্রেতার সুবিধার জন্য ও ক্রেতার মন জয় করার জন্য তার ভাষায় কথা বলা বিক্রয়কর্মীর ভালো গুণগুলোর একটি। বাংলাদেশি প্রবাসীরা সেক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্য জাতির চেয়ে কিছুটা এগিয়ে বলবো।
জাপানের ইংরেজি না জানা মানুষদের সারল্য দেখলে বড় মায়া লাগে। আগাগোড়া সারল্যতায় ভরা জাপানি পর্যটকদের আচরণ। তাদের দেশে তারা কেমন জানি না। ভিন দেশের শহরে তারা খুব কোমলপ্রাণ। দৃশ্যমান দু’চোখের সাথে মনের চোখেই তারা সবকিছু বোঝার জানার চেষ্টা করেন। আসলে যে দেশের মানুষই হোক, ঘুরে বেড়ানোর সময় মনের চোখ খোলা রাখতে হয়। জগতের সব বিষ্ময় তো মনের মাঝেই গেঁথে যায়। ছায়া হয়ে রয়ে যায়। অটো-কম্পোজ হয়ে স্মৃতিগ্রন্থের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় অদৃশ্য অক্ষরে ভরে যায়।
বাঙালিরা একাধিক ভাষায় দক্ষতা অর্জনে দ্রুতগতির হলেও মাতৃভাষার প্রতি মায়া ও ভালোবাসায় জগতের অন্য জাতির চেয়ে কম নয়, বরং এগিয়ে; যার প্রমাণ দিয়েছেন আমাদের ভাই সালাম, রফিক, বরকত, শফিউর, জব্বারেরা তাদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে- সেই ১৯৫২ সালে। তাই তো ইংলিশদের দেশ যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে দীর্ঘকাল বসবাস করা সিলেটি বাঙালি ভাইটা কুয়ালালামপুরে এসে আরেক বাঙালি ভাইয়ের সাথে প্রাণখুলে বাংলায় কথা বলে ভাব বিনিময় করেন। ভাগ্যক্রমে কুয়ালালামপুরে বিক্রয়কর্মী ভাইটাও যদি সিলেটি হয়, তাহলে সরাসরি সিলেটি আঞ্চলিক ভাষায় কথার খই ফোটে। একই কথা চট্টগ্রামের মানুষদের বেলায়ও বলা যায়।
চট্টগ্রাম থেকে কুয়ালালামপুর শহরে বেড়াতে গিয়ে বুকিত বিনতাং এ হঠাৎ পরিচয় হওয়া চাটগাঁইয়া ভাইটাকে কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করেন চাটগাঁইয়া পর্যটক। তার সাথে জুড়িয়ে দেন চাটগাঁইয়া ভাষায় রাজ্যের কাহিনি; যা মাতৃভাষার প্রতি মানুষের স্বভাবজাতটান বলা যায়। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। আমাদের মাতৃভাষা ‘বাংলা’ আমাদের অহংকার, আমাদের ‘বাংলা বর্ণমালা’ আমাদের চিরকালের গর্ব।
সার কথা- ইংরেজি, স্প্যানিশ, আরবি, ফারসি, চাইনিজ বা একাধিক ভাষা শেখা মানে নিজস্ব দক্ষতা ও যোগ্যতা বাড়ানো। ইংরেজি বা ভিন দেশি ভাষা না জানলেও মনের জোর ও ইচ্ছাশক্তি থাকলে মাতৃভাষা দিয়েই সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দেওয়া যায়। ঘুরে দেখা যায় বিশ্ব। আহরণ করা যায় নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। ভারী করা যায় উপলব্ধির নির্যাস ভা-ার। ঋদ্ধ করা যায় হৃদয়ের খেরোখাতা।

আদালতে বাংলা ভাষা : যুক্তি-তক্কো-গপ্পো
প্রকাশ বিশ্বাস

হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন
তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি
পরধন লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ
পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
মেরুদ-ে যাদের আচার আর আনুষ্ঠানিকতা-সবর্স্বতার ঘুণপোকার আসন, তারাই শুধুমাত্র ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলে সর্বস্তরে বাংলা চালুর আবেগে উথলে ওঠেন। বাংলাকে আন্তজার্তিক মাতৃভাষায় পরিণত করা গেছে এটাই কি বড় পাওয়া? এতেই কি সব অর্জন শেষ? বাংলার চেয়ে ইংরেজিকে কি মোক্ষ-জ্ঞান করেন না আমাদের বিদ্বোৎসমাজ? দু’লাইন ইংরেজি বলতে পারলে এখানে বড় চাকরি মেলে। প্রজাতন্ত্রের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হওয়ার জন্য যে বিসিএস পরীক্ষা দিতে হয় সেখানে মৌখিকে ইংরেজিতে কথা বলতে পারলেই ভালো পদ পাওয়া যায়। যেখানে ইংরেজি সব মুশকিল আসান করে দেয় সেখানে বাংলার শক্তি কোথায়? ব্রিটিশ কলোনির সে সংস্কারের ভুষন্ডী মাঠের ভূত তাড়াবার জাগরণের মন্ত্র কোথায়? আর আইন-আদালতে বাংলা? সে তো মূল্যহীন আমজনতার দিনগত পাপক্ষয় মাত্র!
আইন-আদালতের সাংবাদিকতা করতে গিয়ে দেখেছি, চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এবং চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলা যখন লিখি যথাক্রমে মুখ্য মহানগর হাকিম এবং মুখ্য বিচারিক হাকিম- তখন কোনো কোনো বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা প্রতিবাদ করেন। কোনো কাজে তাঁদের খাসকামরায় গেলে তাঁরা এ বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছে তাঁদের ‘গোস্বা’ প্রকাশ করেন। অথচ মহামান্য উচ্চ আদালত অর্থাৎ হাইকোর্ট থেকে আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য বিধান দেওয়া হয়েছে। সেটা এরকম এক ভাষা আন্দোলনের মাসেই। বেতার, দূরদর্শনে বাংলাকে বিকৃত করা যাবে না বলে অন্তবর্তীকালীন নির্দেশ দেওয়া আছে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক যখন হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন সে সময় অর্থাৎ ২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলায় মামলার রায় লেখা শুরু করেছিলেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এর সংখ্যা ছিল প্রায় দুশো। প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরও তিনি বাংলায় রায় লেখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তারপরও উচ্চ আদালতে বাংলার আদর নেই। অনাদরে-অবহেলায় দুঃখিনী অশক্ত বর্ণমালা ফাঁপা রাষ্ট্রযন্ত্রের মিথ্যা স্তাবকতায় বিবর্ণ হতেই থাকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। ভাষাকেও বাংলাদেশ নামের মাতৃভূমির মতোই বঞ্চনার মুকুটই শিরোধার্য করতে হয়।
আদালতে বাংলা বিষয়ে আমাদের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে রয়েছে ছোট্ট একটি বাক্য। সেটি হচ্ছে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ কিন্তু বেদনাদায়ক প্রহসন এটাই যে, এখনও পর্যন্ত সর্বস্তরে বাংলা চালু করা সম্ভব হয়নি। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস কারও অজানা নয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ঘটনা এখন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে স্থান পেয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্ব আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করছে। অনেক দেশে রাষ্ট্রভাষা সেসব দেশের আদালতেও স্থান পেয়েছে। কোনো কোনো বিচারক মাতৃভাষায় বিচারকাজ চালাচ্ছেন। রায় দেওয়া হচ্ছে। অথচ ভাষা নিয়ে যে দেশে এত কিছু ঘটেছে, সে দেশের আদালতে বাংলা চালু করা যায়নি।
সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের ওপর ভিত্তি করে ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ২ ও ৩ (১) ধারায় বলা আছে, কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তাহলে তা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। ৩ ধারায় বলা আছে, কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারি এ আইন অমান্য করলে তা সরকারি কর্মচারি শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ বলে গণ্য হবে এবং এর বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। অসদাচরণের সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরিচ্যুতি। এ আইনে কোনো ব্যক্তির শাস্তি হয়েছে এমনটি শোনা যায়নি। এ আইন মানতে বাধ্যও করা হয়নি কাউকে। প্রশাসনে ইংরেজির ব্যবহার চলছে। আদালতেও চলছে। কোনো বাধা নেই।
সবই তালগোল পাকানো। আদালতে ভাষার ব্যবহার চলছে যথেচ্ছভাবে। উচ্চ আদালতে ইংরেজির ব্যবহার বলা যায় বাধ্যতামূলক। তবে নিম্ন আদালতে ইচ্ছেমতো বাংলা-ইংরেজি ব্যবহৃত হয়। আইন বিশারদদের মতে, দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ ধারা সংশোধন না হওয়ায় উচ্চ আদালতে বাংলার প্রচলন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ওই ধারায় বলা হয়েছে, ১৩৭ এর ১ উপধারায় “সরকার অন্যভাবে নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই আইন বলবৎ হওয়ার সময় যে ভাষা হাইকোর্ট ডিভিশনের অধীনস্থ আদালতের ভাষা হয় ওই ভাষাই অনুরূপ আদালতের ভাষা হিসাবে চলিতে থাকিবে।” ২ উপধারায় বলা হয়েছে,“অনুরূপ কোনো আদালতের ভাষা কী হইবে এবং অনুরূপ আদালতে কোন ধরনের দরখাস্ত এবং কার্যধারা লিখিত হইবে সরকার উহা ঘোষণা করিতে পারে।” ৩ উপধারায় বলা হয়েছে “যেক্ষেত্রে অনুরূপ আদালতে সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করা ব্যতীত কোনো বিষয় এ আইনে লিখিত হওয়ার প্রয়োজন বোধ হয় বা অনুমতি প্রদান করা হয় সে ক্ষেত্রে অনুরূপ লিখন ইংরেজিতে হইতে পারে; কিন্তু যদি কোনো পক্ষ অথবা তাহার উকিল ইংরেজির সহিত অপরিচিত হন তবে তাহার অনুরোধে আদালতের ভাষায় উহার অনুবাদ তাহাকে সরবরাহ করা হইবে; এবং আদালত ওই অনুবাদের খরচ প্রদান সম্পর্কে উপযুক্ত মনে করে এরূপ আদেশ প্রদান করিবে।”
বাংলা প্রচলনের ক্ষেত্রে সংবিধান ও আইনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও আদালত এ বাধ্যবাধকতার বাইরে রয়েছেন। এ প্রশ্নে বেশ কিছু দেওয়ানি বিষয়ের আবেদনপত্র নিষ্পত্তি করতে গিয়ে ১৯৯১ সালের ৮ নভেম্বর হাইকোর্ট একটি রায় দেন। ওই রায়ে বলা হয়, দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ ধারার ১ উপধারা মতে, আদালতে ইংরেজির ব্যবহার, যথা রায়, আরজি, সওয়াল-জবাব ইত্যাদি লেখা হলে তা বেআইনি হবে না। কাজেই বাংলা ভাষা প্রচলন আইন প্রণীত হওয়ার আগে আদালতে যেমন ইংরেজি ভাষায় আরজি, সওয়াল-জবাব, দরখাস্ত, রায় লেখা হত- তেমনটি চলতে পারে। ওই রায়ে ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়। বলা হয়, ভাষার তিনটি ব্যবহার। এগুলো হচ্ছে- রাষ্ট্রভাষা, সরকারের ভাষা ও আদালতের ভাষা। রাষ্ট্রভাষার অর্থ, যে ভাষা রাষ্ট্রের সব কাজে ব্যবহৃত হয়। সরকারের ভাষা হল নির্বাহী কার্যক্রমে ব্যবহৃত ভাষা। আদালতের ভাষা বিচারিক কার্যক্রমে ব্যবহৃত ভাষা।
হাইকোর্টের এ রায়ের পর আর নিম্ন আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়নি। শুধু ফেব্রুয়ারি এলেই সরকারের পক্ষ থেকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রশ্ন সামনে আসে, বাংলা প্রচলনের অঙ্গীকার করা হয়। অথচ আদালতে মাতৃভাষা প্রচলনের বাধা দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ ধারা সংশোধনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। কথার ফুলঝুড়িতে ময়দান গরম হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের ভাষাপ্রেম, তাদের দেশপ্রেমের মতোই আন্তরিকতাহীন কিছু বুলি হয়ে ওঠে।
আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনে আইন কমিশনের সুপারিশ রয়েছে। ওই সুপারিশের প্রতি সরকার কোনো নজরই দেয়নি। সুপারিশে বলা হয়েছে, সাংবিধানিক রাষ্ট্রভাষা বাংলা। আইন করে বাংলা চালু করা উচিত। ইংরেজিতে লেখা বিদ্যমান আইনগুলো বাংলায় অনুবাদ করা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি উচ্চতর আদালতেও বাংলায় বিচারকার্য পরিচালনা ও রায় লেখা দরকার। সুপারিশে বলা হয়, যদিও ১৯৮৭ সনে আদালতে বিচারিক কাজসহ অন্যান্য আইনি কাজকর্মে বাধ্যতামূলক বাংলা ব্যবহারের জন্য “বাংলা ভাষা প্রচলন আইন” করা হয়, তারপরও বিশেষত উচ্চ আদালতে ইংরেজির ব্যবহার নির্বিবাদে চলছে। আরও বলা হয়, রায় ইংরেজিতে লেখা হলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বৈষ্যমের শিকার হন। তারা ইংরেজি না বোঝার কারণে খুব বিপদের মধ্যে পড়েন। আদালতের ভাষা তাই গণমানুষের ভাষাকে অনুসরণ করা উচিত।
আইন কমিশনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সংবিধানের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদ এবং এবং বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ ইনট্রোডকশন অ্যাক্ট ১৯৮৭ অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের সব কাজ বাংলায় করতে হবে। কিন্তু “হাসমতউল্লাহ বনাম আজমেরী বিবি ও অন্যান্য” মামলার রায়ে হাইকোর্ট বলেন, দেওয়ানী কার্যবিধির ১৩৭ (২) ধারা অনুযায়ী সরকার আদালতে বাংলা ব্যহারের বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেবেন না। সুপারিশে বলা হয়, ফৌজদারি কার্যবিধির দুটি এবং দেওয়ানী কার্যবিধির একটি ধারার কারণে আদালতের কাজে বাংলা ব্যবহারের প্রতিবন্ধকতা থেকে যায়। বাধা না থাকলেও উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন নেই।
সাম্প্রতিক ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, বিচারপতিদের মধ্যে প্রয়াত আমীরুল ইসলাম চৌধুরী বাংলা ভাষায় আদেশ দান ও রায় লেখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেগুলো আইন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়নি। ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও বিচারপতি হামিদুল হক সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নজরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র মামলায় বাংলায় রায় দেন। রায়টি আইন সাময়িকী ঢাকা ল’ রিপোর্টস-এ ৫০ ডিএলআর ১০৩ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে। একই দিনে বিচারপতি হামিদুল হক অপর একটি ফৌজদারি রিভিশন মামলায় বাংলায় রায় প্রদান করেন। আবদুল আজীজ বনাম সেকান্দর আলী নামক সে রায় ৫০ ডিএলআর পৃষ্ঠা ১১১ তে ছাপা হয়। হাবিবুর রহমান বনাম সেরাজুল ইসলাম নামক একটি ফৌজদারি রিভিশন মামলায় বিচারপতি কাজী এবাদুল হক বাংলায় রায় লিখেন যেটি ৫১ ডিএলআর ১৪৭ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়।
এরপর সবুর আলী বনাম রাষ্ট্র নামক একটি ফৌজদারি মামলা বিচারে যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের সুবিধা কখন আসামি লাভ করতে পারে, সে সংক্রান্ত নজির সৃষ্টিকারী একটি রায় দেন বিচারপতি কাজী এবাদুল হক। এটি ৫১ ডিএলআর পৃষ্ঠা ১৬ তে প্রকাশিত হয়। ফৌজদারি মামলায় পুলিশের সাক্ষ্য কখন বিশ্বাসযোগ্য বলে গ্রহণ করা যাবে, তা ব্যাখ্যা করা হয় আবদুর রেজ্জাক বনাম রাষ্ট্র নামক মামলায়। ৫১ ডিএলআর পৃষ্ঠা ৮৩ তে রায়টি প্রকাশিত হয়।
এছাড়া বিচারপতি হামিদুল হক ও বিচারপতি আবদুল কুদ্দুছ বাংলায় বেশ কয়েকটি নজির সৃষ্টিকারী রায় প্রদান করেছেন। সম্প্রতি যে বিচারপতিরা সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত রয়েছেন তাঁদের মধ্যে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বাংলায় বেশ কয়েকটি মামলার রায় প্রদান করেছেন। ২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মতিউর রহমান মিয়া বনাম আছিয়া খাতুন ও অন্যান্য মামলায় তিনি বাংলায় রায় দিয়েছিলেন। আইনজ্ঞরা বলছেন, এ রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হল উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহারে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।
উচ্চ আদালতে বিচারপতিরা বাংলায় রায় লিখেন না বললেই চলে। ২০০৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলায় লেখা একটি জামিন আবেদন তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. আবদুল মতিন ও বিচারপতি মো. আবদুল হাই সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে এ ঘটনা ঘটে। ওই বছরের ৭ জানুয়ারি একই বেঞ্চে বাংলায় আবেদন করায় ওই আবেদন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ওই আবেদনের পক্ষে আইনজীবী আবু ইয়াহিয়া দুলাল জানান, একটি ফৌজদারি জামিন আবেদন তিনি বাংলায় নিয়ে যান। বাংলায় শুনানি শুরু করলে আদালত প্রশ্ন তোলেন, বাংলা ভাষায় আবেদন কেন? তখন আইনজীবী বলেন, বিচারপতি হওয়ার সময় আপনি বাংলায় শপথ নিয়েছেন, এখন বাংলায় আবেদন শুনবেন না কেন? আদালত জানায়, এটা আমাদের ট্রাডিশন নয়। আইনজীবী বলেন, ট্রাডিশন জাতীয় ও বিজাতীয় দুই রকমের হয়। ইংরেজিতে আবেদন করা ও আদালতে ইংরেজি ভাষার প্রয়োগ একটি বিজাতীয় কালচার। শুনানি শেষে আদালত আবেদনটি তালিকা থেকে বাদ দেয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি, ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তখন থেকে আইন মহাবিদ্যালয়ে বাংলায় আইন শিক্ষা দেওয়া শুরু হয়। এরপর অধস্তন আদালতে বাংলার ব্যবহার বাড়তে থাকে। ১৯৭৫ সালের পর আবার আদালত অঙ্গনে ইংরেজি ভাষার প্রচলন বেড়ে যায়।
এ অপচেষ্টা রোধ করার জন্য ১৯৮৭ সালে প্রণীত হয় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন। এ আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে ৩ (১) আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনগত কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে। (২) (১) উপধারায় উল্লেখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহলে তা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হইবে। (৩) যদি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারি এ আইন অমান্য করেন, তাহা হইলে ওই কার্যের জন্য তিনি সরকারি কর্মচারি শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ করিয়াছেন বলে গণ্য হবেন এবং তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারি শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে। দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ ধারা মোতাবেক আদালতে ইংরেজি ভাষার বাধ্যবাধকতা কিংবা ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫৮ ধারা মতে যেকোনো ভাষা ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।
সংবিধানের ১৫৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিধানের বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে সেক্ষেত্রে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাইবে।’ অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ে বলা হয়েছে, আদালত তার ইচ্ছামতো ভাষা ব্যবহার নির্ধারণ করতে পারবে, এতে কোনো বাধা নেই। এ অর্থে আদালতে বাংলা ও ইংরেজি দুটি ভাষারই ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নেই বললেই চলে। হাসমতুল্লাহ মামলার রায়ে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রভাষার অর্থ হবে তিনটি। রাষ্ট্রভাষা, অফিসের ভাষা আর আদালতের ভাষা। দেশের বিশিষ্টজনরা বলছেন, এ মামলার রায়ের ন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, বাংলা ভাষার ব্যবহার উচ্চ আদালতে নিষিদ্ধ করা হয়নি। বিচারপতি হাবিবুর রহমান প্রধান বিচারপতি থাকাকালে কয়েকজন বিচারপতিকে নিয়ে উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলন বিষয়ে একটি সমীক্ষা করেছিলেন। কিন্তু ওই সময় বিচারকদের একটি অংশ বাংলা ভাষায় শুনানি ও রায় ঘোষণার বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। পরে এ প্রকল্পটি আর বাস্তবায়ন করা যায়নি।
অ্যাডভোকেট সামছুদ্দিন ও ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট গাজীউল হক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় আরজি, জবাব বিষয়াদি দাখিলের ক্ষেত্রে জোর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্য আইনজীবীদের অসহযোগিতা এবং আদালতের অনাগ্রহের কারণে তা আর রেওয়াজে পরিণত হতে পারেনি। আদালতে যারা বাংলা ভাষার বিরোধিতা করেন তাদের মত হচ্ছে, মামলা রুজু করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন নজির নিতে হলে ইংরেজি বই থেকে নিতে হয়। তাছাড়া ইংরেজি ভাষার বাংলা প্রতিশব্দের অভাব, বাংলা সাঁটলিপিকার ও মুদ্রণ সহকারীর অভাব রয়েছে। তাছাড়া সুপ্রিম কোর্টের অনেক রায় বিদেশের আদালতগুলোতে নজির হিসেবেও নেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলায় লেখা থাকলে তা আর সম্ভবপর হয়ে উঠবে না।
অন্যদিকে যারা আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারে পক্ষে তাদের মত হচ্ছে, আদালত সাধারণ জনগণের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির জায়গা। সেখানে ভাষা হবে জনসাধারণের ভাষা যাতে বিচারপ্রার্থীরাই বেশি উপকৃত হন। আদালতে ইংরেজি ব্যবহারের ফলে বিচারপ্রার্থীরা তাদের তথ্য জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, মামলার রায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারছেন না। অনেক আইনজীবী বলছেন, উচ্চ আদালতে শুনানির সময় কোনোভাবেই বাংলা ব্যবহার করা যায় না। কারণ উচ্চ আদালতের বিচারপতিরা বাংলা শুনতে চান না। কিন্তু এ প্রথা দূর করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। উচ্চ আদালতে বর্তমানে বাংলা প্রচলনে যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা হল, দৈনন্দিন কার্যতালিকাটুকু বাংলায় ছাপা হচ্ছে।
আমাদের উচ্চ আদালতে যেহেতু কয়েকজন বিচারপতি অনেক মামলায় বাংলায় রায় দিয়েছেন তাতে বোঝা যায়, বাংলায় রায় দেওয়ায় নিষেধ নেই। তবুও বাংলায় রায় দেওয়াতে কেউ উৎসাহবোধ করেন না। বাংলায় রায় দেওয়াটা মানসিক বিষয়। যেসব রায় বাংলায় দেওয়া হয়েছে তা কি আইনগতভাবে মূল্যহীন? তাহলে অন্যরা কেন বাংলায় বিচারকাজ করেন না? এ প্রশ্নের উত্তর মেলে না।
মাতৃভাষায় রায় দেওয়া হলে দেশের মানুষের বুঝতে সুবিধা হয়। মামলার বাদী-বিবাদীকে অন্যের কাছে রায় বুঝে নিতে যেতে হয় না। এটা সহজ সমীকরণ। অনেক রায় নিয়ে এ দেশের রাজনীতিকরাও তর্কে জড়িয়ে পড়েন। সাধারণ মানুষকে তাঁরা নিজেদের মতো করে বুঝিয়ে থাকেন। বাংলা ভাষার প্রচলন ঘটলে সর্বোচ্চ আদালতে বিচারকাজ পরিচালনা সহজ, স্বচ্ছ ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হবে জেনেও এ কাজটি কেউ করেন না। সংখ্যায় নগণ্য হলেও বেশ কয়েকজন বিচারক ইংরেজিতে শুধু আদেশ এবং রায় দেন, এর বাইরে সাক্ষীদের জবানবন্দী, জেরা বাংলায় নেন। কিন্তু অনেক হাকিম ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও ইংরেজিতে রের্কড করেন। কারণ তাঁরা ইংরেজিতে লেখাকে সন্মানজনক ও অভিজাত কাজ বলে মনে করেন।
অথচ উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে, সাক্ষীর নিজের ভাষা সেটি আঞ্চলিক অথবা প্রমিত যাই হোক না কেন ঠিক সে ভাষাতেই তার জবানবন্দী রেকর্ড করতে হবে। যারা ইংরেজিতে লিখেন তাঁরা মনে করেন, তাঁরা নিজেরা ইংরেজি ভাষাভাষীদের মতোই ইংরেজি জানেন। ইংরেজিই তাদের ধ্যান-জ্ঞান। অবশ্য এদের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে।
একজন ফৌজদারি বিষয়ক প্রবীণ আইনজীবীর মুখ থেকে শোনা তাঁর পেশাগত জীবনের কাহিনী উল্লেখ না করে পারা গেল না।। ঢাকার আদালতে মানিকগঞ্জের একজন লোক মাছ চুরির মামলায় বাদী হিসাবে জবানবন্দী দিচ্ছেন। “তখন বিয়ান বেলা। ঘুম থিকা উইঠা অব্যাস মতো চকের দিকে আটতে থাকি। পরেই ডাঙ্গার চালা। ডাঙ্গার পারে খারায়া দেহি কি দূরে কয়েকজন দবুড় দিয়া পলাইয়া যাইতেছে। আমার রেইঞ্জের মইদ্যে তারা ছিল না। ডাঙ্গার পাড়ের চ্যারদিকে পানি থিকা জালে ওঠা তোলা ক্যাদা আর ক্যাদা। পাড়ে পানি ভেজা ক্যাদা মাখা একটি মাছ দরার জাল পাই। ” জজ সাহেব তার জবানবন্দী ইংরেজিতে লিখতে গিয়ে ‘দবুড়’ শব্দটির ইংরেজি লিখলেন পযধংরহম, অর্থাৎ ধাওয়া করা। বাদীকে তার দেওয়া জবানবন্দী ব্যাখ্যা করা হল। বাদি বললেন, এ কথা তো আমি বলি নাই। তার আইনজীবীর আবেদনক্রমে লাইনগুলোই বিচারক কেটে দিলেন। সময় নষ্ট হল। আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা বিরক্ত হলেন।
তাহলে প্রেসক্রিপশনটি কী? আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারে দেওয়ানি কার্যবিধি সংশোধন করা যেমন জরুরি, তেমনি উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারে নতুন আইন প্রণয়ন করা দরকার। অনেক আইনজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উচ্চ আদালতে বাংলার প্রচলন হলেও পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় ব্যবহার থাকলে রায় বুঝতে সাধারণ মানুষের যেমন সুবিধা হবে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবে এ রায় সিদ্ধান্ত হিসেবে স্বীকৃতিও পাবে।
আজকাল কত কিছুই বাংলায় হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর আহবানে মুঠোফোন কোম্পানিগুলো এগিয়ে এসে কি-বোর্ড বাংলায় তৈরি করছে। কিন্তু ইন্টারনেটের ডোমেইন, হোস্টিং বাংলায় কি সম্ভব নয়? সম্ভব করা না গেলে একটি গর্বিত জাতি হিসেবে আমাদের পক্ষে সামনে এগুনো সম্ভব নয়। আর তাহলে আদালতসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের স্বপ্ন আকাশকুসুমই থেকে যাবে।
[প্রকাশ বিশ্বাস : আইনজীবী


সর্বস্তরে বাংলা প্রয়োগে আইনি পদক্ষেপ দরকার
আমিনুল ইসলাম সুজন

স্বাধীন হবার ৫০ বছর পূরণ হল, আমরা এখনও ভাষা আন্দোলনের মর্ম অনুধাবন করতে পারি নি। ভাষা আন্দোনের তাৎপর্য স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয় নি। অনেক ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায় নি। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা পেশার মানুষদের মধ্যে প্রয়োজন ব্যতিত ইংরেজি নির্ভরতা কি বাংলা ভাষার প্রতি অমর্যাদা নয়? যদি অমর্যাদা-ই হয় তবে ভাষার মর্যাদা রক্ষায় কঠোর হওয়া জরুরি বৈকি!
চিকিৎসকরা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সাধারণ মানুষ, বিশেষত যারা ধর্ম বিশ্বাসী তাদের কাছে সৃষ্টিকর্তার পূর্বে শেষ আশ্রয় হলেন চিকিৎসক। বাংলাদেশে বর্তমানে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর যিনি জীবনের কোন না কোন সময়ে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হন নি। নানা কারণেই মানুষ অসুস্থ হয় আর অসুস্থ হলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। রোগী দেখে চিকিৎসকরা যে ব্যবস্থাপত্র দেন সেটা বাংলাবর্জিত। নিরক্ষর, স্বল্পশিক্ষিত কী শিক্ষিত, সবার ক্ষেত্রেই একই নীতি, ইংরেজি ব্যবস্থাপত্র। চিকিৎসকরা এমনভাবে লিখেন তা শিক্ষিত মানুষের পক্ষে বোঝাও দুঃসাধ্য। ব্যাপারটা যেন এমন, তিনিই বড় চিকিৎসক যার হাতের লেখা ব্যবস্থাপত্র সাধারণের কাছে সর্বাধিক দুর্বোধ্য। এর কি কোন বিকল্প নেই? বাংলাদেশে কি রোগীর ব্যবস্থাপত্র বাংলায় লেখার নিয়ম করতে পারি না? পৃথিবীর আর কোন দেশে তাদের মাতৃভাষা ব্যতিত অন্য ভাষায় ঔষুধের ব্যবস্থাপত্র লেখে কিনা আমার জানা নেই।
গণমাধ্যমকে বলা হয় সমাজের আয়না। গণমাধ্যম মানুষকে খুব সহজেই প্রভাবিত করতে পারে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রধানত তিনভাগে বিভক্ত। দেখা ও শোনার দূরদর্শন (টেলিভিশন) ও চলচ্চিত্র, শ্রবণনির্ভর বেতার (রেডিও) ও প্রধাণত পাঠনির্ভর সংবাদপত্রও প্রায় একই গোত্রের আধুনিক সংস্করণ অনলাইন সংবাদ।
প্রথমেই যদি আসি টেলিভিশন প্রসঙ্গে, তবে হতাশা দিয়েই শুরু করতে হয়। নাটকে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার দোষের নয়। কিন্তু সাম্প্রতিকালের নাটকে এমন এক ভাষার প্রচলন শুরু হয়েছে যা বাংলা ভাষার কথ্যরূপকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। বিশেষ করে, নাটক দেখে নাটকে ব্যবহৃত কথ্য ভাষার প্রয়োগে উৎসাহী হচ্ছে কিশোর-তরুণ প্রজন্ম, যা সুখবর নয়। বাংলায় নামের যেন এমন আকাল, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামকরণের ক্ষেত্রেও আমরা ইংরেজির আশ্রয় নিচ্ছি। প্রতিবেদন, আলোচনানুষ্ঠানের কথাপোকথন ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায় সংশ্লিষ্টরা প্রায়শই ইংরেজির আশ্রয় নিচ্ছেন। ইংরেজি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা এবং ইংরেজির সঙ্গে আমাদের কোন বিরোধ নাই। কিন্তু যখন অপ্রয়োজনেই অন্য ভাষা নির্ভরতা কিংবা ভাষার অপপ্রয়োগ বা বিকৃতি ঘটে তখন মনে হয় ভাষা শুদ্ধ প্রয়োগে আইন থাকা জরুরি।
এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, বাংলাদেশের কোন চ্যানেল পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে দেখা যাক বা না যাক বলা যায় তাদের সব চ্যানেল আমরা দেখতে পাই। এটা একটা আগ্রাসন, এর ফলে শুধু বাংলা ভাষাই যে প্রভাবিত হচ্ছে তা নয়, আবহমানকালের সংস্কৃতি, পারিবারিক-সামাজিক ঐতিহ্যও হুমকির মুখে পড়ছে। হিন্দী টিভি চ্যানেলগুলোর আগ্রাসনের কবলে পরেছে শিশু থেকে বৃদ্ধ, প্রায় সবাই । কখন কোন হিন্দী সিরিয়াল দেখানো হবে সেটা বাসার বৃদ্ধ থেকে শুরু করে শিশুরও জানেন। অনেকে হিন্দী ভাষাটা দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে রপ্ত করে ফেলেছেন। কিন্তু আমাদের দুর্বল চিত্তের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এসব বিষয়ে কোন ভাবনা আছে বলে মনেই হয় না। বরং শাহরুখ খান যখন এসে আমাদের হিন্দীতে গালি দিয়ে যান তাই দেখে আমরা সন্তুষ্টচিত্তে বাসায় ফিরি। শাহরুখের বোম্বেটে নাচ দেখার জন্য, হিন্দী গালি শোনার জন্য সবাই মাঠের মধ্যে ঘাস কিংবা ত্রিপলের উপর বসে পড়েন। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কত বিষয়ে আলোচনা হয়, চুক্তি হয়। কখনও আমাদের টিভি চ্যানেল তাদের দেশে দেখানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে শুনি নি। যতদিন বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতে দেখানো হচ্ছে না ততদিন কি ভারতের চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে দেখানো উচিত?
রেডিও চ্যানেলগুলোর কথা কী বলব! যতদূর শুনেছি এবিসি রেডিও বাংলার সঠিক প্রয়োগ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু অন্য চ্যানেলগুলোর অবস্থা এক্ষেত্রে হতাশাজনক। এফএম রেডিও নামক এসব চ্যানেলের জকিরা জোকারের মত ভাষা ব্যবহার করেন। সেটা না হয় বাংলা, না হয় ইংরেজি! এটাও তরুণ প্রজন্মকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশ বেতার এবং সংবাদপত্রগুলো তুলনামূলকভাবে ভাল অবস্থায় আছে। বিচার বিভাগ, আইন ও আদালত মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। কিন্তু রায় যখন ইংরেজিতে লেখা হয় তখনই সমস্যা। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ নিরক্ষর। পাশপাশি যারা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন, তাদেরও বড় অংশ ইংরেজি পড়তে সক্ষম নন। আর যারা পড়তে সক্ষম তাদের অনেকে বুঝতে সক্ষম নন। ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে মনে হয়, দেশের ৫ভাগ মানুষও পরিপূর্ণভাবে ইংরেজি বুঝতে সক্ষম নন। অনেক আদালতই ইংরেজিতে রায় লেখেন সেটা আদালতের রায় দেখে নিশ্চিত হয়েছি। আদালত তো মানুষের জন্য, সেই মানুষের ভাষাই যদি আদালত ব্যবহার না করেন তবে সেটা মানুষের বলে প্রতীয়মান হয় কি? আদালতের সকল পর্যায়েই কি বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়?
গত জানুয়ারি মাসে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানলাম, বগুড়ার অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন এক যান-উদ্ভাবকের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ইংরেজি চুক্তিনামা ও এ বিষয়ক প্রতারণার খবর। এরকম হাজার হাজার উদাহরণ রয়েছে। তাই চুক্তিনামা বা সমঝোতাপত্র অবশ্যই বাংলায় করা উচিত। এরও একটা নিয়ম থাকা উচিত। শুধু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা বা চুক্তি অন্য কোন ভাষায় হতে পারে।
শিক্ষাক্ষেত্র আমাদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। যারা উচ্চশিক্ষা লাভ করেন তারাই কেউ আইনজীবী, কেউ বিচারক, কেউ চিকিৎসক, কেউ শিক্ষক, কেউ প্রশাসক, এরকম বিভিন্ন পেশায় সম্পৃক্ত হন। তাই ছাত্রসমাজকে যদি শৈশব থেকেই ভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে অনুপ্রাণিত করা যায়, তবে তারা পরবর্তী সময়ে কর্মজীবনেও ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সক্রিয় থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। বাংলা ব্যকরণ পড়ালেই ভাষার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ভাষা শহীদের মর্যাদা রক্ষা হয় না। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের বিবেচনায় নেয়া দরকার।
এটা হয়ত খুব হাস্যকর শোনাবে যে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় আইনের কথা বলছি। কিন্তু বাস্তবতা আসলেই তাই। আইন থাকলে চিকিৎসকরা ইংরেজিতে ব্যবস্থপত্র লিখতেন না, আদালত ইংরেজিতে রায় দিতেন না, এফএম রেডিওর জোকাররা বাংলা ভাষার বারোটা বাজাতে সাহস পেত না। আশাকরি, ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সংশ্লিষ্টরা আইন প্রণয়নের বিষযটি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবেন।