গান গেয়ে বিশ্বজয়ী ভারতীয় দলকে পুরস্কৃত করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ভারতসহ গোটা উপমহাদেশকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। তার মৃত্যুতে ভারত তো বটেই গোটা উপমহাদেশের সংগীতাঙ্গনেই নেমেছে শোকের ছায়া। শুধু সঙ্গীতাঙ্গন নয়, ভারতের ক্রিকেটেও বড় দাগ কেটে গেছে লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যু। কেননা তিনি ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট দল তথা ক্রিকেট বোর্ডের পরম বন্ধু। যার সম্মানে ভারতের সব স্টেডিয়ামে সব ম্যাচের জন্য বরাদ্দ থাকতো দুটি করে উইকেট। কেন তাকে দেওয়া হয়েছে এই বিশেষ সম্মান? তা জানতে ফিরে যেতে হবে প্রায় ৪০ বছর আগে, ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের পরের সময়ে। প্রবল পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে লর্ডসের ব্যালকনিতে ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছিলেন ভারতের অধিনায়ক কপিল দেব। ভারতে তখন বইছে উৎসবের জোয়ার। কিন্তু ক্রিকেট বোর্ডের তৎকালীন সভাপতি, ইন্দিরা গান্ধীর কেবিনেটের অন্যতম ক্ষমতাধর মন্ত্রী প্রয়াত এনকেপি সালভের মাথায় ছিল এক দুশ্চিন্তা।
বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্ট জয় করা ভারতীয় দলকে পুরস্কৃত করা তখন জরুরি হয়ে পড়েছিল বোর্ডের জন্য। কিন্তু তখনও ভারতের ক্রিকেট আর্থিক দিক থেকে ধুঁকছিল। এমনকি বিশ্বকাপ চলাকালীন খেলোয়াড়দের দৈনিক ভাতার ২০ পাউন্ড করে দিতেও গলদঘর্ম অবস্থা হতো ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের। সেই বোর্ডের পক্ষে বড় উৎসব করে খেলোয়াড়দের স্বাগত জানানো কিংবা বড় অংকের পুরস্কার দেওয়ার কথা ভাবাই ছিল দুঃসাহসিকতার শামিল। তখনই এগিয়ে আসেন সুরস্রমাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। একটি কনসার্টে গান গাওয়ার মাধ্যমে ভারতীয় বোর্ডকে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করে দেন তিনি। আর্থিক সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে ভারতের ক্রিকেটের এনসাইক্লোপিডিয়া হিসেবে খ্যাত রাজ সিং দুঙ্গারপুরের শরণাপন্ন হন সালভে। তখন আর কোনো পথ না দেখে নিজের কাছের বন্ধু ও ভারতের ক্রিকেটের ভক্ত লতা মঙ্গেশকরকে দিল্লির জওহরলাল নেহেরু স্টেডিয়ামে একটি কনসার্টে গান গাওয়ার অনুরোধ করেন দুঙ্গারপুর। সেই অনুরোধ ফেলতে পারেননি লতা। তার গান গাওয়ার খবরে ভরে যায় পুরো স্টেডিয়াম। মঞ্চে উঠে প্রায় দুই ঘণ্টা গান করেন লতা। এই আয়োজন থেকে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের এতো বেশি আয় হয় যে, তারা বিশ্বকাপ জেতা দলের ১৪ সদস্যের প্রত্যেককে ১ লাখ রুপি করে পুরস্কার দেয়।
তখনকার দিনে ১ লাখ রুপি ছিল অনেক বেশি অর্থ। ঠিক কতটা বেশি তা বোঝাতে প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াকে (পিটিআই) দলের সদস্য সুনিল ভালসন বলেছেন, ‘ওই সময় এটি অনেক বড় অঙ্ক ছিল। আমরা সফরের অর্থ এবং মাসজুড়ে দৈনিক ভাতা জমিয়েও ৬০ হাজার রুপি একত্রিত করতে পারিনি।’ ভালসন আরও যোগ করেন, ‘আমার এখনও মনে আছে, কেউ কেউ বলছিল, আমরা তোমাদের ৫ হাজার রুপি দেবো। কেউ বলছিল ১০ হাজার রুপি দেবো। এগুলো তখন খুবই অপমানজনক ছিল। এরপর লতাজি সেই কনসার্টে গান করলেন। সেই কনসার্টটি আমার অন্যতম স্মরণীয় একটি সন্ধ্যা ছিল যে তাকে সামনাসামনি গান করতে দেখেছি।’ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এবং দুঙ্গারপুর কখনও ভোলেননি সেই বিশ্বকাপের পর কীভাবে বড় লজ্জার হাত থেকে তাদের বাঁচিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। তাই তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ভারতের যেকোনো মাঠে, যেকোনো ম্যাচে লতার জন্য বরাদ্দ রাখা হতো দুটি করে ভিআইপি টিকিট। অবশ্য শুধু সেই কনসার্টে গান করাই নয়, আরও আগে থেকে ভারতের ক্রিকেটের নিয়মিত অনুসারী ছিলেন লতা। মুম্বাইয়ের ক্রিকেটের অন্যতম ইতিহাসবিদ এবং সিনিয়র সাংবাদিক মাকারান্দ ওয়াইগাঙ্কারের স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে কীভাবে সত্তর ও আশির দশকে নিয়মিত সিসিআই স্টেডিয়াম ও ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখতেন লতা। মাকারান্দ বলেছেন, ‘লতাজি এবং তার ভাই সুরকার হৃদিনাথ মঙ্গেশকর নিয়মিত ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে টেস্ট ম্যাচ দেখতেন। এরপর সত্তরের দশকে নিজের ব্যস্ত সূচির মাঝেও খুব কম সময়ই কোনো ম্যাচ মিস করতেন লতা।’ মুম্বাইয়ের কিংবদন্তি ওপেনার মাধব আপ্তে ও রাজ সিং দুঙ্গারপুরের সঙ্গে বসে খেলাগুলো দেখতেন লতা। মুম্বাই থেকে উঠে আসা ক্রিকেটারদের মধ্যে সুনিল গাভাস্কার, দিলিপ ভেংসরকার এবং শচিন টেন্ডুলকারের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল লতার। তাকে অনেক সময় মা সরস্বতী বলেও ডাকতেন শচিন টেন্ডুলকার। প্রায়ই ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়ায় বসে দুঙ্গারপুরের সঙ্গে নানান ক্রিকেটীয় আড্ডায় মশগুল হতেন এ গানের পাখি।
মূল প্রতিবেদন: প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া