কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা কাদের বই পড়ছে?

0

॥সালমান তারেক শাকিল॥
বইমেলা হোক বা বইয়ের দোকান—দলবেঁধে প্রিয় লেখকের বই কিনতে প্রায়ই কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে পড়ে। সপ্তাহান্তে বৃহস্পতিবার বিকালে বা শুক্রবার ঢাকার বইয়ের দোকান, নীলক্ষেত, বাংলাবাজার, কাঁটাবন এলাকায় তাদের আনাগোনার চিত্র এখন নিয়মিত। ‘একটা সময় ছিল কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ক্লাসের বইয়ের বাইরের কিছু পড়তে চাইলেও সুযোগ ছিল কম। সঙ্গে ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বাধা, এমনকি শাস্তিও। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এই বাধায় ছেদ পড়েছে। পড়ার প্রতি ছাত্রদের আগ্রহ বেড়েছে অনেক। টাকা জমিয়ে তারা এখন বাইরের বই কিনে পড়ছে। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করছে বইয়ের পর্যালোচনাও। এই চিত্র এখন কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাভাবিক।’ কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের বইপড়ার চর্চা নিয়ে বলছিলেন এই অঙ্গনের সুপরিচিত তরুণ লেখক সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর। অনলাইনে বই বিক্রির মাধ্যম রকমারি ডটকমে বেস্টসেলার লেখকদের একজন তিনি।
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, সারাদেশে অন্তত ৪৫ হাজার কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গ্রামাঞ্চল থেকে শহর, মফস্বলের মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার্থীরাই পাঠ্যক্রমের বাইরে বাংলায় নানান বই পড়তে আগ্রহী। ঠিক কত সংখ্যক ছাত্র নিয়মিত এসব বই পড়ছে, এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ‘মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা শিক্ষা সমাপন করেছে তাদের মধ্যে অন্য বই পাঠের আগ্রহ বেশি। সত্যিকার অর্থেই এ সময়ে তাদের পাঠাভ্যাস ঈর্ষণীয়’, এমনটা বললেন কওমি ঘরানার পরিচিত একজন লেখক মনযূরুল হক। তার ভাষ্য, ‘শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা শহরের মাদ্রাসাগুলোতে পড়ে, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চতর শ্রেণিগুলোতে যারা পড়েন—তারা আজকাল বই কেনার প্রতি ঝুঁকছেন। সেই তুলনায় যারা গ্রামের মাদ্রাসাগুলোতে পড়ছে— তাদের পড়া হয় কম; তবে সেটা সুযোগ কম থাকার কারণেই।’
ঢাকার কয়েকটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বলছেন, কওমি মাদ্রাসার ভেতর বাইরের বই, পত্রিকা, ম্যাগাজিন পড়তে এখনও বাধা দেওয়া হয়। যদিও উচ্চমাধ্যমিকের পর থেকে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের সুযোগমতো বই কিনে পড়ছে। রাজধানীর একটি কওমি মাদ্রাসা থেকে এবার দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স সমমান) পরীক্ষা দেবেন আবরার ফাহিম (২২)। বই পড়ার পাশাপাশি পত্রিকায় গল্পও লিখছেন তিনি। জানালেন, আগের তুলনায় কওমি শিক্ষার্থীরা গল্প-উপন্যাস পড়ছে বেশি। ‘কিন্তু এসব ক্ষেত্রে মাদ্রাসার কড়াকড়ির কারণে লুকিয়ে পড়তে হচ্ছে ৷ নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে মাদ্রাসাগুলো আগের মতোই আছে। লেখালেখি করতে চায়, এমন ছাত্রের সংখ্যাও অনেক।’ বলছিলেন আবরাম ফাহিম। নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন মালিবাগ জামিয়া শরইয়্যাহ মাদ্রাসার সাবেক শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব। তিনি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে আরবিতে মাস্টার্স করছেন। তিনি বলছেন, ‘যদি সংস্কৃতির (ইসলামি ঘরানা) সঙ্গে না মেলে বা কোনও লেখকের নামের মধ্যে বিশেষ সমস্যা (অমুসলিম লেখক) থাকে, সেক্ষেত্রে বাধা দেওয়া হয়।’ সাকিব আরও বলেন, ‘সাধারণত, নিচের ক্লাসের শিক্ষার্থীদের কাছে বাইরের বই দেখলে শিক্ষকরা সেটা নিয়ে নেয়। উপরের ক্লাসের শিক্ষার্থীদের তেমন কিছু বলে না। আগে যেমন বাংলা বই দেখলেই না করতো, এখন সেটা হচ্ছে না। কেউ কেউ ক্ষতি হবে বলে মনে করেন। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এমন মনোভাব এখন কম।’ বাধা কমে যাওয়ার কারণটা উঠে এসেছে অনুবাদক-লেখক সাকিবের ব্যাখ্যায়— ‘বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠাগার থাকে। মালিবাগ মাদ্রাসার পাঠাগারে সাহিত্যের বই রাখা হতো। মুসলিম লেখকদের বই রাখা হয়। ছাত্ররা নিজেরা অস্থায়ী পাঠাগার করে। আশেপাশে পাঠাগার থেকে বই এনেও পড়ে।’ এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সহ-সভাপতি মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজুর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘একটা সময় ছিল কওমি মাদ্রাসায় সিলেবাসের বাইরে কোনও বই-ই ঢুকতে পারতো না। অনেক কড়াকড়ি ছিল। এখন তা নেই। এখন বরং বাংলা বই পড়তে উৎসাহ দেওয়া হয়। আমাদের সিলেটের মাদ্রাসাগুলোতেও বইপাঠের প্রতিযোগিতা হয়।’
সিলেটের জামিয়া হোসাইনিয়া গহরপুর মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মুসলেহ উদ্দিন জানান, তার প্রতিষ্ঠানসহ সিলেটের অধিকাংশ কওমি প্রতিষ্ঠানে পাঠাগার আছে। সেখানে বাংলা বই আছে। বিভিন্ন বিষয়ের সৃজনশীল, প্রবন্ধ, ইতিহাসসহ নানা বিষয়ের বই আছে। শিক্ষার্থীদের বই পাঠে উৎসাহ দিতে প্রতিযোগিতার আয়োজনও করা হয় তার গহরপুর মাদ্রাসায়। অঞ্চলভেদে ফার্সি বা উর্দু প্রভাবিত মাদ্রাসাগুলোতে এখনও কিছু বাধা আছে বলে মনে করেন আল হাইআতুল উলইয়া লিল জামিআতিল কওমিয়্যাহ’র সদস্য মুসলেহ উদ্দিন রাজু। তিনি বলেন, ‘ঢাকার মাদ্রাসাগুলোতে বাংলা পড়তে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। ছেলেরা দৈনিক পত্রিকায় গল্প-কবিতা লিখছে নিয়মিত।’
কোন বিষয়ে কার বই বেশি পড়া হয়?
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও লেখকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গল্প-উপন্যাস-কবিতার মতো সৃজনশীল বিষয়ের চেয়ে ইতিহাস, প্রবন্ধ ও ধর্মীয় উজ্জীবনীমূলক গ্রন্থগুলো বেশি পড়ে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা।এ ধারার নিয়মিত একজন লেখক নিজের নাম ও পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে উল্লেখ করেন, ‘রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আল মাহমুদ, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ, আহমদ ছফাসহ হালের সাদাত হোসাইনের লেখাও কওমি শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয়। এ ছাড়া, ওসমানি সাম্রাজ্য, খেলাফতের ইতিহাস, ইসলামের নবীদের যুদ্ধের ইতিহাসও আগ্রহ নিয়ে পড়ে।’ বই বিক্রির সাইট রকমারিতে শেষ এক বছরে যে ৩০টি বই বিক্রির শীর্ষে ছিল, এর মধ্যে ১২টি ছিল ধর্মীয় ভাবধারার। গ্রন্থগুলো হচ্ছে, শায়খ আহমাদুল্লাহ রচিত রাসূলুল্লাহ সা.-এর সকাল-সন্ধ্যার দু’আ ও যিকর এবং দোয়ার কার্ড (৭), আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ রচিত ইনসাইড ইসলাম (১৪), আরিফ আজাদের নবি জীবনের গল্প (১৫), জীবন যেখানে যেমন (১৬), জবাব (১৭), মা, মা, মা এবং বাবা (২৫), মিজানুর রহমান আজহারির ম্যাসেজ (১৯), শায়খ আহমাদুল্লাহ’র রামাদ্বান প্ল্যান (২০), সফিউর রহমানের রাসূল-এর শ্রেষ্ঠ সিরাত গ্রন্থ (২৬), খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের রাহে বেলায়েত (২৭), মুনাজাত ও নামাজ (২৮), সহীহ মাসনুন ওযীফা (২৯)। রকমারি ডটকমের বিক্রির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ইসলামি মতাদর্শ কেন্দ্রীক, প্র্যাকটিসিং ইসলাম, ইসলামের ইতিহাস, ইসলামি গল্প ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচর্যামূলক গ্রন্থের বিক্রি অনেক বেশি। আলাদা করে গ্রাহকদের তথ্য সংগ্রহ না রাখলেও কওমি ধারার লেখক ও পাঠকরা বলছেন, উগ্রবাদ বিষয়ের পাঠকের সংখ্যাও কওমি মাদ্রাসায় কম নয়।
রকমারি ডটকমের বেশি বিক্রিত গ্রন্থের একজন সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর জানান, তার লিখিত গ্রন্থগুলোর বিষয় নবী জীবনী, ইসলামের ইতিহাস, বাংলাদেশে ইসলামের ইতিহাস, গল্পভাষ্য, ধর্মদর্শন, শিশুসাহিত্য, তরুণদের জন্য মোটিভেশনাল বই ইত্যাদি। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক লেখকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম’র সাধারণ সম্পাদক আমিন ইকবালের পর্যবেক্ষণ—কওমি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে বইপাঠের ক্ষেত্রে কয়েকটি শ্রেণি আছে। আমিন ইকবাল বলছেন, বড় আকারের একটা শ্রেণি ইসলামি ইতিহাসনির্ভর বই বেশি পড়ে। একইসঙ্গে আত্মউন্নয়ন সম্পর্কিত বইও তাদের পাঠের তালিকায় থাকে। দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠে থাকে সাহিত্য নির্ভর গ্রন্থ। বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় গ্রন্থ (গল্প-উপন্যাস, কবিতা, কলাম, অনুবাদ সাহিত্য) সবই তারা পড়ছে। বিশেষ করে যাদের চিন্তা-চেতনায় কিছুটা আধুনিকতার ছোঁয়া আছে, যারা মাদ্রাসার গণ্ডির বাইরে এসে সৃজনশীল সাহিত্য চর্চা করতে চায়, তাদের অনেক আত্মউন্নয়ন ও ইসলামি ইতিহাসনির্ভর গ্রন্থ পড়ার পাশাপাশি প্রায় সব ঘরানার লেখকের বই-ই পড়ছেন।’ ‘আরেকটা শ্রেণি আছে, যারা শুধু ধর্মীয় বই পাঠ করেন। নারী পাঠকদের ক্ষেত্রে এমনটা বেশি ঘটে। ইসলামের নানা গল্প, আত্মশুদ্ধি, নারীদের বিধিবিধান সংশ্লিষ্ট বইগুলো তাদের বেশি টানে বলে মনে হয়। তবে কিছু ব্যতিক্রমও আছে।’ এমনটা মনে করেন জাতীয় একটি দৈনিকের ধর্ম বিষয়ক পাতার দায়িত্বে থাকা আমিন ইকবাল।
উগ্রপন্থার বইয়ে আগ্রহ বেশি
রকমারি ডটকমে শীর্ষ বিক্রিত বইয়ের একজন লেখকের দাবি, কওমি শিক্ষার্থীরা এক্সট্রিম লিটারেচার তথা উগ্রবাদী সাহিত্য বেশি পছন্দ করে। এক্সট্রিম লেখক, এক্সট্রিম উপন্যাস, যুদ্ধের ইতিহাস পড়ে বেশি। তারা মনে করে, ইসলামের সোনালী দিনের ইতিহাস ফেরাতে এসব পড়তে হবে। আবার হুমায়ূন, শীর্ষেন্দু, সুনীলও পড়ে কেউ-কেউ। তবে এদের সংখ্যা কম। যদিও রকমারির এক কর্মকর্তা বলছেন ভিন্ন কথা। বাংলা ট্রিবিউনের প্রশ্নের জবাবে তার যুক্তি— ‘উগ্রবাদের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত আলী হাসান উসামা বা আতিকুল্লাহদের লিখিত গ্রন্থগুলো উগ্রপন্থী চিহ্নিত হওয়ায় সাইট থেকে সরানো হয়েছে। কিন্তু অন্য লেখক—যারা হয়তো উগ্রবাদী লেখা লিখছেন, কিন্তু প্রশাসনের কোনও বাধা আসেনি বা এ সংক্রান্ত কোনও নির্দেশনা আসেনি, সেক্ষেত্রে কীভাবে তাদের চিহ্নিত করা যাবে? আইনত সে সুযোগ নেই।’ কওমি ধারার একাধিক লেখক বলেন, কওমি মাদ্রাসায় যারা আধুনিক ইসলাম বা সামাজিকভাবে সহনশীল ধর্মচর্চার পক্ষে লেখালেখি করেন, তাদেরকে উগ্রপন্থী লেখকরা ‘দাজ্জাল’ (আরবি বিশেষণ: মিথ্যাবাদী) শ্রেণিভুক্ত বা ‘প্রকৃত ইসলাম নয়’ বলে বাতিল করে দেয়। এই উগ্রপন্থী লেখকদের বইয়ের কাটতিও অনেক। এই ধারার পাঠকরাও মনে করে, ‘কুফরের (আল্লাহকে অস্বীকারকারী) বিরুদ্ধে লড়াই করার রসদ পাওয়া যাবে এসব বইতে।’ বাংলাবাজারের একজন ইসলামি বই প্রকাশক বলেন, “ইসলামি বই প্রকাশনা বিপ্লবের পর্যায়ে চলে গেছে। দশ বছর আগে আমরা কয়েকজন এ প্রকাশনা শুরু করেছিলাম। তখন নিজেরাই বই প্রকাশ করতাম। এখন শতাধিক প্রকাশনা আছে, যারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের এক্সট্রিম লেখকদের গ্রন্থ অনুবাদ করছে।’ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বই কেনা ও পড়া নিয়ে বলেছেন প্রকাশনা সংস্থা প্রকৃতির স্বত্বাধিকারী সৈকত হাবিব। তিনি বলছেন, ‘যারা আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ছে, তারা তো পড়াশোনা করে মূলস্রোতে যুক্ত হচ্ছে। অপরদিকে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বইপাঠের আগ্রহ বেড়েছে। তারাও মনোযোগী পাঠক। কেবল ধর্মীয় বই নয়, বিভিন্ন চিন্তা-চেতনার গ্রন্থ তারা পড়ছে। কবি ও সমালোচক সৈকত হাবিবের ভাষ্য, ‘দেশে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনেকের মধ্যে বিদ্বেষ আছে। তারা কিন্তু মূলস্রোতে আসতে আগ্রহী। যে কারণে তারা সমাজ সচেতন হয়ে উঠতে নানা বই পড়ছে। ফলে কেবল অভিযুক্ত না করে সৌহার্দ্য দেখাতে হবে। জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ রোধ করার ক্ষেত্রে তাদের এই পাঠ্যাভ্যাস খুব জরুরি।’