মাদক কমাতে মদে ছাড়, সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ দেশে মাদকের ব্যবহার কমাতে অ্যালকোহলে ছাড় দেওয়ার মতামত এসেছে সংসদীয় কমিটিতে। আমেরিকা এবং কানাডায় গাজা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে কমিটির আলোচনায় বলা হয়— মাদক নির্মূল করতে হলে কিছু পলিসি পরিবর্তন করতে হবে। মাদকের বিকল্প কিছু একটা সামনে নিয়ে আসতে হবে। এজন্য অ্যালকোহল, মদ, গাজা এগুলো সম্পর্কে আরও চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। অ্যালকোহলের প্রতি কিছুটা ছাড় দিলে ড্রাগ সেবন কিছুটা কমতে পারে। আলোচনায় মদ, বিয়ার বা অ্যালকোহলের ওপর ট্যাক্স কমানোর প্রস্তাব করা হয়।
গত ৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ১৮তম সভায় এসব আলোচনা হয় বলে বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে। বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত কমিটির ১৯তম বৈঠকে ওই কার্যবিবরণী অনুমোদন দেওয়া হয়। এদিকে সংসদীয় কমিটির ওই আলোচনার প্রেক্ষাপটে যুব সমাজকে মাদক থেকে সরিয়ে আনতে বিকল্প ব্যবস্থা অবশ্যই দরকার বলে উল্লেখ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেছেন, সবগুলো বিষয়ের ওপর সরকার সার্বিক বিবেচনা করেই পদক্ষেপ নেবে। সংসদীয় কমিটির সভাপতি মো. শামসুল হক টুকু অ্যালকোহল সেবন উন্মুক্ত করার বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর বলে মন্তব্য করেন। ওই কমিটির বৈঠকে এসব নিয়ে আলোচনা হলেও বিষয়টি পুরোপুরি সুপারিশে আসেনি। কমিটি তার সুপারিশে শতকার পাঁচ ভাগের নিচে অ্যালকোহল-যুক্ত সকল পানীয়ের বোতল/ক্যানে (হান্টার ও বিয়ারসহ) দৃশ্যমান করে অ্যালকোহলের পরিমাণ উল্লেখ করে মুদ্রণের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উৎপাদনকারী এবং আমদানিকারকদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিতে বলেন। জানা গেছে, কমিটির আগের বৈঠকে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক আব্দুস সবুর মন্ডল অধিদফতরের সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনা করার পর মাদক প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন বলেন, ‘ড্রাগ এবং অ্যালকোহল দুইটি ভিন্ন জিনিস। অ্যালকোহলের প্রতি কিছুটা ছাড় দিলে ড্রাগ সেবন কিছুটা কমতে পারে।’ এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট মতামত ও সুপারিশ প্রয়োজন বলে তিনি মত দেন।
বাংলাদেশে অ্যাকোহলের ওপর শতকরা ৬০০ ভাগ ট্যাক্স নির্ধারণ করা আছে উল্লেখ করে বৈঠকে আইজিপি বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের সব ক্লাবে অ্যালকোহলের লাইসেন্স আছে। কিন্ত তারা কেউ আমদানি করে না। কারণ ট্যাক্স দিতে হয় বেশি। ক্লাবগুলো বেআইনিভাবে চোরাইপথে আসা মদ বিক্রি করে। যার কারণে দাম কম, ক্রেতা বেশি। এতে করে সরকার প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার ট্যাক্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাহলে মদ আমদানির ওপর ট্যাক্স বৃদ্ধি করে কী লাভ হলো। আবার ট্যাক্স কমিয়ে দিলে অথবা মদ উন্মুক্ত করে দিলে ইসলামপন্থী বিভিন্ন দলগুলো আন্দোলনের নেমে যাবে।’ মাদক নির্মূল করতে হলে কিছু পলিসি পরিবর্তন করতে হবে উল্লেখ করে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম বলেন, ‘চোরাইপথে মদ ও বিয়ার ঢাকা শহরের সব ক্লাবে বিক্রি হয়। ক্লাবগুলোর বৈধ লাইসেন্স রয়েছে আমদানি ও বিক্রি করার জন্য। কিন্তু ট্যাক্স দিয়ে কেউ আমদানি করে না।’ মুসলিম দেশ হিসেবে উন্মুক্ত না হলেও কিছুক্ষেত্রে ছাড় দিলে যুব সমাজকে মাদকাসক্ত থেকে কিছুটা কমিয়ে আনা যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। ফেনসিডিল-ইয়াবা বন্ধে সীমান্ত এলাকায় অনেক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও ঠেকানো যাচ্ছে না বিধায় নতুন পরিকল্পনা নেওয়া উচিত বলে তিনি মত দেন। র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমেরিকা এবং কানাডা গাজা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বাংলাদেশের মাদক কখনও বন্ধ করা যাবে না। তবে হয়তো কিছুদিনের জন্য কমিয়ে আনা যেতে পারে। কারণ, মাদকের বিকল্প কিছু একটা সামনে নিয়ে আসতে হবে।’ তাই অ্যালকোহল, মদ, গাজা এগুলো সম্পর্কে আরও চিন্তাভাবনা করা উচিত বলে তিনি মত দেন। কমিটির সদস্য জাতীয় পার্টির এমপি পীর ফজলুর রহমান বলেন, ‘মদ, বিয়ার বা অ্যালকোহলের ওপর ট্যাক্স কমিয়ে দিয়ে যদি রাজস্ব বৃদ্ধি পায়, তাহলে তাই করা উচিত। ড্রাগ অর্থাৎ আইস, ইয়াবা, এলএসডি এগুলো ভয়াবহ ক্ষতিকর মাদক। মদ, বিয়ার, গাজা ইত্যাদিতে যদি ৫% এর নিচে অ্যালকোহল থাকে, তাহলে এগুলো বৈধ ঘোষণা করে দেওয়া উচিত।’ ‘গিয়ার’ নামে ড্রিকংস ৪.৯% অ্যালকোহল দিয়ে বাজারজাত করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। যুব সমাজকে মাদকের নেশা থেকে বাঁচাতে এ সবকিছু বিবেচনা করার জন্য সরকারের কাছে তিনি অনুরোধ করেন।
সংরক্ষিত আসনের রুমানা আলী বলেন, ‘যেসব মাদক হালকা ক্ষতিকর সেগুলো ব্যবহার উন্মুক্ত করা যেতে পারে এবং যেগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে ক্ষতি হয়, সেগুলোকে অনুমোদন দেওয়া উচিত নয়।’ মাদক বন্ধে সরকার দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘যুব সমাজকে মাদকের থেকে সরিয়ে আনতে বিকল্প ব্যবস্থা অবশ্যই দরকার। তবে, আমাদের বুঝতে হবে ক্ষতিকর ড্রাগ কোনটা? এলএসডিম, ইয়াবা, হেরোইন এগুলো ক্ষতিকর বিধায় যারা সেবন করে, তাদের ব্রেন ও লিভার ২ বছরের মধ্যে ড্যামেজ হয়ে যায়। তাই এগুলো থেকে যুব সমাজকে সরানোর উপায় খুঁজে বের করার বিকল্প কী আছে, তা নিয়েও সরকার কাজ করছে। যমুনা গ্রুপের হান্টার ড্রিংকস ৪.৯৯% ঘোষণা দিয়ে বাজারজাত করছে। সবগুলো বিষয়ের ওপর সরকার সার্বিক বিবেচনা করেই পদক্ষেপ নেবে।’ এগুলোর দিকেও সরকার নজর রাখছে বলে তিনি জানান। কমিটির সভাপতি মো. শামসুল হক টুকু বলেন, ‘অ্যালকোহল সেবন উন্মুক্ত করার বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। অ্যালকোহল আমদানিতে ট্যাক্স কমানোর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মত নেওয়া যায়। সেই সঙ্গে চোরাইপথে বা অবৈধ পথে আমদানি হলে লাইসেন্স বাতিলসহ আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। অ্যালকোহল কী পরিমাণ মাত্রায় সেবন করা যায়, তার জন্য বিভিন্ন নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞ রয়েছে। ড্রাগ অর্থাৎ মাদক বলতে যেটা বুঝাচ্ছে, সেটার কারণে দেশের তরুণ সমাজ ধ্বংস হচ্ছে। যে সব মাদক সেবন করলে যুব সমাজ নেস্তগ্রস্থ হয়ে পড়ে, যেমন- ইয়াবা, এলএসডি, আইস, হেরোইন ইত্যাদি বন্ধ করার জন্য কঠোর হতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘৫% এর নিচে অ্যালকোহল যুক্ত বেভারেজ/পানীয় যে সকল প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করছে, তাদের নির্দেশ দেওয়া দরকার যে, সেসব বোতল বা ক্যানে অবশ্যই দৃশ্যামান করে অ্যালকোহলের মাত্রা লিখে দিতে হবে। যাতে অনুমোদিত মাত্রার অ্যালকোহল নিশ্চিত হলেও কেউ অজান্তে অ্যালকোহল গ্রহণ করতে না পারে।’ পরে কমিটির সভায় ৫% এর নিচে অ্যালকোহল-যুক্ত সকল পানীয়ের বোতল/ক্যানে (হান্টার ও গিয়ারসহ) দৃশ্যমান করে অ্যালকোহলের পরিমাণ উল্লেখ করে মুদ্রণ করার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উৎপাদনকারী এবং আমদানিকারকদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়ার সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। মো. শামসুল হক টুকুর সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবারের বৈঠকে কমিটি সদস্য ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ অংশ গ্রহণ করেন।